প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন: মা-বাবার সম্পৃক্ততা যেভাবে শিশুশিক্ষাকে উৎসাহিত করতে পারে
ব্যক্তিমনকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো শিক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ে উত্তম শিক্ষা শিশুদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে পারে। এ কারণে প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশের ভিত্তি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অভীষ্ট ৪-এ ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’র ওপর জোর দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। তবে সর্বশেষ মহামারি শিক্ষা খাতকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। কোভিডের কারণে শিক্ষা খাত বিপর্যস্ত হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ শিশু স্কুল থেকে ছিটকে পড়বে এবং প্রায় ৩০ কোটি শিশু মৌলিক সাক্ষরতা ও সংখ্যাজ্ঞানের দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। শিক্ষা খাতের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন অংশীজনের জন্য, বিশেষ করে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি উদ্বেগজনক বার্তা। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। শিক্ষা একজন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার এবং অসংখ্য সুযোগ-সুবিধার প্রবেশদ্বার হওয়ায় শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার মান উন্নয়নে এখন আমাদের মোটাদাগে দুটি জায়গায় কাজ করতে হবে। এক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা। দুই, প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান।
এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজের একাধিক প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনের সর্বাত্মক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরকারের পাশাপাশি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রথমত, আমরা যখন মানসম্মত শিক্ষা ও প্রাথমিক স্তরে শতভাগ ভর্তির কথা বলি, তখন শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের ভূমিকাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো রকম অত্যুক্তি না করে বলা যায় যে অভিভাবকেরা শিশুদের সর্বপ্রথম শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। শিশুরা বাড়িতে তাদের মা-বাবার কাছ থেকেই বিভিন্ন বিষয়ের প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। বর্তমান সমাজে মা-বাবার এই ভূমিকা কমেনি, বরং বেড়েছে। মা-বাবার ভূমিকাকে যে বিষয় আরও বেশি অপরিহার্য করে তুলেছে, তা হলো কোভিড মহামারি দ্বারা শিক্ষা খাতে সৃষ্ট বিশাল ধস। এখন শুধু বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করে এই সাগরসম ঘাটতি পোষানো একটি দুরূহ কাজে পরিণত হয়েছে।
আর এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখনপ্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য মা-বাবার সম্পৃক্ততা আরও বেশি জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সম্পৃক্ত করার অনেক সুবিধা আছে, যেমন শেখার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি, শিশুদের অধিক কৃতিত্ব অর্জন, উন্নত ফলাফল এবং সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি তাদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে শক্তিশালী অবদান রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডাল্ট কনটিনিউয়িং এডুকেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জনকে ১৫ শতাংশ ত্বরান্বিত করা যেতে পারে এবং একটি শিশুর পড়ার বয়স ছয় মাস পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে।
সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বলতে সন্তানদের শিক্ষণ ও শেখার প্রক্রিয়ায় মা-বাবা ও অভিভাবকদের অংশগ্রহণকে বোঝায়। প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের অভিভাবকেরা সাধারণত তাঁদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যান এবং ক্লাস শেষে বাসায় নিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে স্কুলে ব্যয়িত সময়ে শিশুদের শিক্ষা ও এর গুণমান বৃদ্ধিতে মা-বাবার একটি বিশাল ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বাবা-মায়েরা নিয়মিত ক্লাসে তাঁদের বাচ্চাদের অগ্রগতি ও শিখন ফলাফল সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। মা-বাবার উচিত শিশুদের সম্পর্কে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা এবং তারা কীভাবে বাড়িতে তাদের বাচ্চাদের সহায়তা করতে পারেন, তা শিখতে পারেন। বাবা-মায়েরা সন্তানদের হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার ফলাফল, স্কোরশিট এবং স্কুলে করা সামগ্রিক মূল্যায়ন যাচাই করে তাঁদের বাচ্চাদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে একটি দরকারি অন্তর্দৃষ্টি এবং উপকারী জ্ঞান অর্জন করতে পারেন, যা সন্তানদের শিক্ষাক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
যদি তাঁদের বাচ্চাদের ফলাফল আশানুরূপ না হয়, তবে অভিভাবকদের উচিত শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের উচিত অভিভাবকদের অংশগ্রহণকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো, মতামত ও মূল্যবান পরামর্শকে সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করা এবং শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে তাঁদের প্রতিফলন ঘটানো। অমর্ত্য সেন তাঁর ‘শিশুশিক্ষার ভূমিকা’ বইয়ে বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, কার্যকর শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়তে হবে।
সন্তানদের শিক্ষায় মা-বাবাকে সম্পৃক্ত করার আগে যে কাজ করতে হবে, তা হলো ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। বিষয়টি বাড়িতে অনুশীলন করা যেতে পারে। বাবা-মায়েদের অবশ্যই স্নেহ, যত্ন ও কর্তব্যপরায়ণতার ভিত্তিতে তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়তে হবে। শিক্ষাবিদ ড. জ্যানেট গুডাল বলেন, কার্যকর মা-বাবার সম্পর্ক মূলত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক। শুধু নির্দিষ্ট দিনে মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগের প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে শিক্ষকদের মা-বাবা ও নিজেদের মধ্যে অর্থবহ দ্বিমুখী মিথস্ক্রিয়া গড়ে তোলার পথ প্রশস্ত করা উচিত।
স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে অভিভাবকেরা ভূমিকা রাখতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, বাবা-মায়েরা স্কুলশিক্ষকদের তাঁদের শিশুদের সম্পর্কে পছন্দ, অপছন্দ, দুর্বলতা, শক্তি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করবেন। একইভাবে স্কুলগুলোও শিশুদের বিকাশ ও অগ্রগতি সম্পর্কে মা-বাবাকে অবহিত করবে। একবার মা-বাবার সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁরা পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের শিখনপ্রক্রিয়ায় গঠনমূলকভাবে অবদান রাখতে পারেন। শিক্ষকদের উচিত অভিভাবকদের মতামত শোনা এবং তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। এই মা-বাবা-শিক্ষক সম্পর্ক অবশ্যই একটি সাধারণ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হবে আর তা হলো শিশুদের একাডেমিক অগ্রগতি। এ লক্ষ্য তখনই অর্জিত হবে, যখন মা-বাবা-শিক্ষক সম্পর্কটি একটি সহযোগিতামূলক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হবে।
২০টির বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে এবং অভিভাবকদের সঙ্গে মত বিনিময় করে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি, সুশীল সমাজ, অভিভাবক, তাঁদের সন্তানসহ অভিভাবকসমাবেশ শিশুদের শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এ রকম সমাবেশে খোলামেলা সংলাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অভিভাবকেরা শিক্ষকদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কার্যকর মতামত ও পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া এ ধরনের খোলামেলা সংলাপ মা-বাবা ও শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়ে তুলবে, যা শিশুদের শেখার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, যা মা-বাবা পালন করতে পারেন, তা হলো এটা পরিষ্কারভাবে সন্তানদের বোঝাতে সক্ষম হওয়া যে তাঁরা ছেলেমেয়েদের শেখার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেন। এ কাজ করার জন্য মা-বাবাকে যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষিত হতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়। সহজে কাজটি করা যেতে পারে। যেমন বাবা-মায়েরা শিশুদের প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জ্ঞান অর্জন করবেন বা প্রতিটি হোমওয়ার্কের উত্তর জানবেন, তেমনটি কাম্য নয়; বরং মা-বাবা যদি সাধারণভাবে বাচ্চাদের বুঝতে দেন যে তাঁরা তাদের শেখানোর বিষয়ে যত্নশীল, তবে তা শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ ও আগ্রহ তৈরি করবে।
এটি করার জন্য সব সাবজেক্টের সব উত্তর জানার দরকার নেই; বরং সহজভাবে দায়িত্ববোধ তৈরির কাজটি করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বাচ্চাদের ‘আজ তুমি কী শিখলে’ জিজ্ঞাসা করার পরিবর্তে মা-বাবা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘আমাকে তিনটি জিনিস বলো, যা তুমি আজ স্কুলে শিখেছ।’ এ ছাড়া সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তিকে উৎসাহিত করার জন্য বাবা-মায়েরা তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলের পাশাপাশি নতুন জিনিস সম্পর্কে কৌতূহল সৃষ্টি এবং নতুন কিছু তৈরিতে সহায়তা করতে পারেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় গভীরভাবে অভিভাবকদের আচরণগুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করে। এ জন্য মা-বাবার মাধ্যমে শিশুরা সৃজনশীল চিন্তা করা, গতানুগতিক প্রক্রিয়ার বাইরে কাজ করা, অন্যের সঙ্গে সদয় আচরণ করা, সহমর্মিতা দেখানো, সময়মতো স্কুলে উপস্থিত হওয়া এবং এ রকম অনেক আচরণের মতো ইতিবাচক অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার সুযোগ পায়।
যেহেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা মা-বাবাকে দেখে শেখে, সেহেতু তাঁরা অভ্যাস ও আচরণের একটি ইতিবাচক প্রভাব প্রদর্শনের মাধ্যমে সন্তানদের কাছে আদর্শ রোল মডেল হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, বাবা-মায়েরা যদি একটি সাধারণ গাণিতিক সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হয়, তা একবার নিজেরা করে দেখান, তবে শিশুরা পরেরবার অনুরূপ সমস্যাগুলো নিজে নিজেই সমাধান করতে পারবে। আবার মা-বাবা যদি একটি প্রাণীর সঙ্গে ভালো আচরণ করেন বা খেতে দেন, সেটা দেখে বাচ্চারাও জীবের প্রতি দয়াশীল হওয়ার শিক্ষা লাভ করে। এই দেখে শেখার অভ্যাস শিশুর মনোজগতে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। কারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নে দক্ষ প্রজন্ম তৈরির লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় শতভাগ প্রাথমিকে ভর্তি ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য। সরকারের এ নীতি ও রূপকল্প দিবালোকের মুখ দেখবে, যদি সময়োপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকারিতার সঙ্গে প্রদান করা যায়। এ কাজ বাস্তবায়নের জন্য মা-বাবা ও শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় ভীষণভাবে প্রয়োজন। দুই অংশীজন যদি হাতে হাত রেখে তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে আমরা উজ্জ্বল ও উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারি।
লেখক: শাহাদাত হুসেইন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কালিহাতী, টাঙ্গাইল