শিক্ষাবর্ষের আট মাস শেষ, চলছে নবম মাস। এই সময়ে এ বছরই অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে, বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার মতো সব শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে না—অষ্টম শ্রেণির মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারণ হবে।
আবার, প্রতি শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশ নিতে ফি দিতে হবে ৬০০ টাকা। এর মধ্যে বোর্ড ফি ৪০০ টাকা এবং কেন্দ্র ফি ২০০ টাকা। গতকাল বুধবার এই পরীক্ষা সংক্রান্ত নীতিমালাও জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ বলছেন, এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সিদ্ধান্ত শিক্ষাবর্ষ শুরুর সময়ই জানানো উচিত। কিন্তু শিক্ষাবর্ষের একেবারে শেষ সময়ে এসে এমন পরীক্ষার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে। আবার মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত শিক্ষায় বৈষম্য বাড়াতে পারে বলেও আশঙ্কা তাঁদের। এতে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ওই ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপরই মনোযোগ দেবে। ক্লাসের অন্যান্য নজরের বাইরে চলে যেতে পারে। অথচ, শিক্ষাক্রম নির্ধারিত শিখন অর্জনের জন্য পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বেশি সহযোগিতা করা দরকার। এ ছাড়া কোচিং-প্রাইভেটনির্ভরতা বেড়ে গিয়ে অভিভাবকদের ওপর আর্থিক বোঝাও বাড়ার আশঙ্কা আছে।
গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনায় তাদের আরও কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বৃত্তি পরীক্ষায় যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে তাসহ আরও অর্থ মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তি বাড়াতে ব্যয় করা উচিত।রাশেদা কে চৌধূরী, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক
২০১০ সালের আগে আলাদা করে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হতো। এরপর জেএসসি পরীক্ষা চালুর পর সব শিক্ষার্থী বৃত্তির প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। তবে কোচিং-প্রাইভেট নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় সমালোচনা হয়েছিল। করোনার সময় (২০২০ সালে) জেএসসি বন্ধ হওয়ার পর নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে তা আর চালু হয়নি।
অন্যদিকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষাও করোনার সময় বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২২ সালের শেষদিকে হঠাৎ চালু হলেও ফলাফলে ভুল-অসংগতি দেখা দেয়। পরে তা আর হয়নি। সম্প্রতি আবার প্রাথমিক স্তরে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এখন অষ্টম শ্রেণির জন্যও একই সিদ্ধান্ত এল।
শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে মেধা (ট্যালেন্টপুল ও কোটাভিত্তিক (সাধারণ) বৃত্তি দেওয়া হবে। সব ধরনের বৃত্তির ৫০ শতাংশ ছাত্রদের এবং ৫০ শতাংশ ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত।
কোনো বিষয়ে কত নম্বরে পরীক্ষা
নীতিমালা অনুযায়ী পাঁচ বিষয়ের ওপর হবে এই বৃত্তি পরীক্ষা। এই বিষয়গুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়।
এর মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিতের প্রতিটি বিষয়ের নম্বর হবে ১০০ করে। আর বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের পরীক্ষা একসঙ্গে হলেও প্রতিটির নম্বর হবে ৫০ করে। প্রতিটি পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা। তবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময় বরাদ্দ থাকবে।
শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে মেধা (ট্যালেন্টপুল ও কোটাভিত্তিক (সাধারণ) বৃত্তি দেওয়া হবে। সব ধরনের বৃত্তির ৫০ শতাংশ ছাত্রদের এবং ৫০ শতাংশ ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত থাকবে। তবে নির্ধারিত কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেলে ছাত্রের বৃত্তি ছাত্রী দিয়ে এবং ছাত্রীর বৃত্তি ছাত্র দিয়ে পূরণ করা যাবে। এর মধ্যে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি দেওয়া হবে উপজেলা বা থানাভিত্তিক। প্রতিটি উপজেলায় বা থানায় পূর্বনির্ধারিতসংখ্যাক ট্যালেন্টপুল বৃত্তি ওই উপজেলা বা থানার সর্বোচ্চ নম্বরধারী ছাত্র ও ছাত্রীদের মেধাক্রম অনুসারে সমান হারে বণ্টন করা হবে।
কেন্দ্র কোথায়, পরীক্ষা হবে
প্রতিটি উপজেলা সদরে বৃত্তি পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। পরীক্ষা কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক বিদ্যালয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও কেন্দ্রের অবকাঠামো সুবিধা বিবেচনায় প্রয়োজনে একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা যাবে।
শিক্ষাবোর্ডগুলোর অধীনে নেওয়া হবে এই পরীক্ষা। এ বছরই এই পরীক্ষা হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষাবোর্ডগুলোকে জানানো হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত তারিখ ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির আজ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী সোমবার সভা আছে। সেখানেই পরীক্ষার তারিখসহ এ সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে। তবে, এ বছরই পরীক্ষা হবে বলে মন্ত্রণালয় তাদের জানিয়েছে।
‘অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য বাড়বে’
দীর্ঘ বছর ধরে শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।
জানতে চাইলে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বারবার শিক্ষার্থীদের কেন পরীক্ষার গিনিপিগ বানানো হচ্ছে? এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এখনো শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন সঠিক করা যায়নি। সেটি ঠিক না করে কোটাভিত্তিক বৃত্তি (অষ্টম শ্রেণিতে ২৫ শতাংশ এবং প্রাথমিক ৪০ শতাংশ পরীক্ষা দিতে পারবে) পরীক্ষা চালু হলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য আরও বাড়বে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে কেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ফেলা হচ্ছে? অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষার্থীই যাতে ভালো করে শিখতে পারে সেই ব্যবস্থা করা দরকার।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, গরিব ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা বিবেচনা করে তাদের আরও কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বৃত্তি পরীক্ষায় যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে তাসহ আরও অর্থ মিড-ডে মিল ও উপবৃত্তি বাড়াতে ব্যয় করা উচিত।