প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোথাও তালা, কোথাও পরীক্ষা

মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার থানা পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফাঁকা শ্রেণিকক্ষ। ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ছবি: আবু সাঈদ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ বেতন বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। এর মধ্যে আজ বুধবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন তাঁরা। এর ফলে আজ তৃতীয় দিনের মতো দেশের অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। তবে ঢাকাসহ অনেক বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রধান শিক্ষকেরা ‘কোনোমতো’ পরীক্ষা চালিয়ে নিচ্ছেন।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকেরা পাঠদান করেন। সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। শিক্ষক রয়েছেন পৌনে চার লাখের বেশি। সহকারী শিক্ষকের অনুমোদিত পদ ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২১৬টি, বর্তমানে কর্মরত ৩ লাখ ৫২ হাজার ২০৮ জন।

গত ২৭ নভেম্বর থেকে তিন দফা দাবিতে কর্মবিরতি শুরু করে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’। গত সোমবার তারা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও শুরু করে। এই পরিষদ এখন বিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

সরেজমিন চিত্র

মেহেরপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনরত সহকারী শিক্ষকেরা। সকালে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ফটক, অফিসকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলে থাকায় তারা ভেতরে ঢুকতে পারেনি। অনেকে অভিভাবকের সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

গাংনী উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমাইল হোসেন বলে, ‘পরীক্ষা দিতে এসে দেখি কক্ষে তালা ঝুলছে। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’

নওপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হামিদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষক নেতারা বলেছেন পরীক্ষা বন্ধ রাখতে। এ কারণে পরীক্ষা হচ্ছে না। গাংনী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জয়নুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আজ সিলেটের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সহকারী শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তবে তাঁরা কোনো ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন না। ১ ডিসেম্বর থেকে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার ধর্মপাশা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজমুল হায়দার ও মধ্যনগর উপজেলার সাউদপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২ ডিসেম্বর থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সহকারী শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে থাকায় প্রধান শিক্ষকেরা কোনো রকমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু এতে সমস্যা হচ্ছে।

তবে ঢাকার অনেক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শিশুরা পরীক্ষা দিচ্ছে। প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল নাঈমা বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর শেষ হবে পরীক্ষা।

প্রায় একই দাবিতে সহকারী শিক্ষকদের আরেকটি সংগঠন ‘সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে ২৩ থেকে ২৭ নভেম্বর কর্মবিরতি পালন করেছিল। ঐক্য পরিষদের একজন আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে তাঁরাও বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি শুরু করবেন।

খুলনা সিটি করপোরেশন এলাকার বাস্তুহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসেছে। ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

প্রাথমিক শিক্ষকদের তিন দফা দাবি হলো সহকারী শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেল আপাতত ১১তম গ্রেড দেওয়া, চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতার নিরসন এবং সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি দেওয়া। বর্তমানে সহকারী শিক্ষকেরা ১৩তম গ্রেডে আছেন (শুরুর মূল বেতন ১১ হাজার টাকা)।

মন্ত্রণালয়ের অবস্থান

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আজ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে কাজে যোগদানের নির্দেশনা দিয়েছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, সহকারী শিক্ষকদের ১১তম গ্রেডে উন্নীত করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য বেতন কমিশনের সভাপতিকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে। পে কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই অর্থ বিভাগ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে গত ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে জানানো হয়েছে। চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতার নিরসন এবং সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতির বিষয়ে ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওইসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও দেখা যাচ্ছে সহকারী শিক্ষকদের কয়েকটি সংগঠন চলমান বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ না করে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করছে। কোথাও কোথাও পরীক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক শিক্ষকদের ওপর হামলা ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মসূচি গ্রহণ সরকারি চাকরি আইন, আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী ও ফৌজদারি আইনেও বিবেচ্য। এ পরিস্থিতিতে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের অবিলম্বে কাজে যোগদান করে শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রান্তিকের পরীক্ষা গ্রহণসংক্রান্ত বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্যথায় এ ধরনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে চাকরি আইন এবং আচরণ বিধিমালা ও ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে, ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

{প্রতিনিধি, মেহেরপুর, প্রতিনিধি, সিলেট, প্রতিনিধি, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ}