সারোয়ার হোসেন খান: এক মেধাবী তরুণের গল্প

সারোয়ার ও তাঁর পরিবার
ছবি: সংগৃহীত

সারোয়ার বেড়ে উঠেছেন একটি শিক্ষিত ও মেধাবী পরিবারে। মা, বাবা আর বড় বোন—এই নিয়ে তাঁদের ছোট্ট সুখের সংসার। মা জিনাত রায়হানা আর বাবা তারেকুল আলম খান দুজনেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মা ছিলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী আর বাবা হিসাববিজ্ঞান বিভাগে। মা-বাবার কাছ থেকে তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের নানা গল্প শুনতে শুনতে হয়তো শিশু সারোয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, একদিন সেও ভর্তি হবে দেশসেরা এই বিদ্যাপীঠে।

শিশু বয়সে স্বপ্ন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। সাকিব-মাশরাফিদের দেখে সারোয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, তিনি হবেন একজন ক্রিকেটার। লাল-সবুজ ভালোবেসে দাপিয়ে বেড়াবেন সবুজ মাঠ। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁর ভাবনায় আসে পরিবর্তন। ক্রমে মনোযোগী হয়ে ওঠেন লেখাপড়ায়। দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের কঠিন অনুশাসন, শিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধান আর মা-বাবার অনুপ্রেরণায় নিজেকে তৈরি করতে থাকেন জেএসসি পরীক্ষার জন্য। বৃত্তি নিয়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হন এই পাবলিক পরীক্ষায়।

এ ফলাফলে সারোয়ার হন উজ্জীবিত, আরও আত্মবিশ্বাসী। এসএসসি পরীক্ষার জন্য নবম শ্রেণি থেকে শুরু করেন প্রস্তুতি। বাড়তি অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন বড় বোন তাহসিন তাবাসসুম। দারুণ মেধাবী তাহসিন জীবনের সব পরীক্ষায় ক্রমাগত রেখে চলেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর। মাধ্যমিকে ঢাকা বোর্ডে মেধাতালিকায় অর্জন করেন ১৬তম স্থান। হলিক্রস কলেজ থেকে বৃত্তি নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তাহসিন বর্তমানে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত।

এসএসসি পরীক্ষায় মেধার স্বাক্ষর রেখে ঢাকা মহানগরীর ছাত্রদের মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষা (বিজনেস স্টাডিজ) বিভাগে সারোয়ার অর্জন করেন ১ম স্থান। ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। এর মধ্যে হানা দেয় করোনা মহামারি। ব্যাহত হয় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম।

চারদিকে কেমন একটা গুমোট, ভীতিকর পরিবেশ। এ রকম এক দুঃসময়ে নিজের মনোবল অটুট রেখে সারোয়ার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য। আসে কাঙ্ক্ষিত ফল। ঢাকা বোর্ডে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে মেধাতালিকায় অর্জন করেন তৃতীয় স্থান।

এরপর শুরু হয় স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি। হাজারো ভর্তি–ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রী; তার তুলনায় আসনসংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘গ’ ইউনিটে (ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) ৯৩০টি আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ২৯ হাজার ৯৯৭ জন। অর্থাৎ ১টি আসনের জন্য লড়েছেন ৩২ শিক্ষার্থী। বলাবাহুল্য, তাঁরা সবাই মেধাবী। রীতিমতো এক যুদ্ধ। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না প্রতিযোগিতাটা ছিল কত তীব্র! এ যেন বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর তিন–চার মাস আগে থেকেই সারোয়ার ভর্তি পরীক্ষার জন্য নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন, বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর কিছুটা দুর্বলতা আছে। সে অনুযায়ী এ দুই বিষয়ে বিশেষ জোর দেন।

হিসাববিজ্ঞান, ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং ও বিমা—এ বিষয়গুলোতে তাঁর জ্ঞান এবং দক্ষতা আগে থেকেই ছিল। তথাপি এসব বিষয়েও চালিয়ে যেতে থাকেন নিয়মিত চর্চা। সারোয়ারের মতে, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পাঠ্যবইয়ের ওপর থাকতে হবে সর্বোচ্চ দখল। কেননা, পাঠ্যপুস্তক থেকেই একজন শিক্ষার্থীর মৌলিক জ্ঞানের ভিত তৈরি হয়। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বইও প্রস্তুতির জন্য বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখে। প্রযুক্তি, যেমন ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাব বেশ ইতিবাচক। তিনি মনে করেন, যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে ইন্টারনেট বেশ কার্যকর। মাঝেমধ্যে গ্রুপ স্টাডি কোনো বিষয়কে আরও ভালোভাবে আয়ত্ত করতে সাহায্য করে।

সারোয়ার হোসেন খান
ছবি: সংগৃহীত

সারোয়ার মনে করেন, ইতিবাচক মানসিকতা যে কোনো প্রতিযোগিতায় সাফল্যের পূর্বশর্ত। সফল হব কি হব না এ নিয়ে টেনশন মানসিক ধকল সৃষ্টি করে, যা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে অন্তরায় হতে পারে। সে কারণে ঠান্ডা মাথায়, ধীরস্থিরভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্যে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে সারোয়ার আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন এবং সেখানে ব্যবসায় প্রশাসন (বিবিএ) বিভাগে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হন।

তবে, তাঁর স্বপ্ন যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সে লক্ষ্যে তিনি প্রস্তুতি অব্যাহত রাখেন। পরীক্ষা আশানুরূপ হয়। অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০২২ সালের ৩ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিটের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। ভর্তির জন্য নর্বাচিত সফল শিক্ষার্থীদের তালিকার সবার ওপরে নাম সারোয়ার হোসেন খান। ভর্তি পরীক্ষায় সারোয়ার অর্জন করেন প্রথম স্থান। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল ১১৬ দশমিক ৭৫, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনুষ্ঠিত ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটে অংশগ্রহণকারী সব পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর। এ যেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার, নিজের সঙ্গে নিজের এক অলিখিত প্রতিযোগিতা।

ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে সারোয়ার বলেন, তাঁর আপাত লক্ষ্য স্নাতক পর্যায়ে একটি সম্মানজনক ফলাফল অর্জন করা। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে কী বেছে নেবেন। পছন্দের তালিকায় রয়েছে— একাডেমিক অর্থাৎ শিক্ষা ও গবেষণা পেশা, করপোরেট নির্বাহী এবং সরকারি চাকরি।

সারোয়ার নিশ্চয়ই তাঁর স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাবেন দৃপ্ত পদক্ষেপে। তাঁর মতো মেধাবী তরুণদের হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে প্রিয় স্বদেশ।

*লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত