শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে এইচএসসি পরীক্ষার্থীর ভাবনা

অনলাইন ক্লাস প্রতীকী ছবি
ছবি: প্রথম আলো

করোনার কারণে প্রায় ১১ মাস ধরে ‘ঘরবন্দী’। এই ঘরবন্দী শুধু কলেজ-কোচিংয়ের বেলাতেই সীমাবদ্ধ হলেও দিনকাল খুব বেশি ভালো যাচ্ছে না। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। আমি যেহেতু উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে হয়তো আর দুমাস পরই আমাকে খুঁজে পাওয়া যেত বোর্ড পরীক্ষার হলে। কিন্তু সময় বদলেছে, এখন আমাকে খুঁজে ঠিকই পাওয়া যায়, কিন্তু সাড়ে ৫ ইঞ্চি মোবাইল স্ক্রিনের পেছনে। ক্যালেন্ডারের পাতাতেও বোর্ড পরীক্ষা জুলাই আর আগস্টের মধ্যখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। করোনার এই কঠিন সময়েও সুস্থ আছি, এটি সৃষ্টিকর্তার এক নেয়ামত বটে, কিন্তু কোথায় যেন অবসাদ আর হতাশা জেঁকে বসে। বেশির ভাগ মানুষই হয়তো বলবে, ‘স্কুল-কলেজ নাই, ঝামেলা নাই, কিসের হতাশা?’ তাহলে বলছি শুনুন।

২০২০ সালের মার্চ মাস। দেশের বেশ নামকরা এক কলেজের শিক্ষার্থী আমি আর আমার বন্ধুরা তখন বেশ জোরেশোরেই প্রথম বর্ষের ‘ইয়ার ফাইনাল’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছি। শিক্ষকেরা বলেছেন, এপ্রিলের শুরুতেই নেওয়া হবে সেই কাঙ্ক্ষিত পরীক্ষা। আমাদের কলেজের ধারা অনুসারে তখন আমাদের সায়েন্সের ফার্স্ট পেপার পড়ানো হয়েছে। সেকেন্ড পেপার যে ধরা হয়নি এমন না, বড়জোর প্রতি পেপারের ১ বা ২ চ্যাপটার। জুলাইয়ে প্রথম কলেজে ঢোকার পর থেকে মার্চ পর্যন্ত দুটো পরীক্ষা দিয়েছিলাম আমরা। তাই ইয়ার ফাইনালকে সামনে রেখে আমরা সবেমাত্র নিজেদের গুছিয়ে নিতে শুরু করেছি। কিন্তু হঠাৎই বেড়ে গেল করোনার সংক্রমণ। জীবনের মূল্য যেহেতু লেখাপড়ার চাইতেও বেশি, তাই সরকারের পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র দেরি না করে স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলো। আমাদের আনন্দ আর পায় কে! কারণ ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত আমাদের একমাত্র ‘টার্গেট’ ছিল, যেকোনো মূল্যেই সেকেন্ড ইয়ারে ওঠা!

এরপর দিন গেল। কলেজ থেকে অনলাইনে পড়ানো শুরু হলো। ইউটিউবে ক্লাস হয়। ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে বসলে কেমন যেন অচেনা মনে হয় সবকিছু। স্ক্রিনের সামনে আর যা-ই হোক, পড়াশোনা আর হয়ে ওঠে না। দিন কাটতে থাকে, রোজার ঈদ চলে যায়, কোরবানির ঈদ আসে। ঘরবন্দী ঈদ উদযাপন করি সবাই। এর মাঝে খবর আসে, কলেজ থেকে ‘অটো পাস’ দিয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটিও সরকারের নির্দেশনায়। আমরা আবারও খুশি হয়ে উঠি! জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার এই বুঝি সমাপ্তি। নাহ, আদতে তা হয় না। এই পুরো সময় ফেসবুকে কখনো খবর আসছে অমুক ক্লাসমেট পুরো পরিবারসহ করোনায় আক্রান্ত। কখনো-বা জানতে পারি, কারও বাবা, দাদা-দাদি এমনকি প্রিয় মা হারিয়ে গেছে করোনার আগ্রাসী ছোবলে। আমাদের মন খারাপ হয়, মনে হয়, কবে শেষ হবে এই কঠিন সময়ের!
একবার শুনলাম, করোনার কঠিন সময় অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। হলোও তা-ই। আমার বান্ধবীদের অনেকেই এই জাদুর শহর ঢাকার মায়া ত্যাগ করে গ্রামে চলে গেল। নেট তো দূরে থাক, ফোনকলেও পাওয়া যায় না অনেককেই। একটা সময় গিয়ে মনে হলো, আমরা এতটা আধুনিক যুগে এসেও সামান্য এক অণুজীবের কারণে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে উঠেছি। ক্যালেন্ডারের পাতায় ধুলো জমল। এর মাঝে খবর এল, এইচএসসি ব্যাচ ২০২০ দের ‘অটোপাস’ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ব্যাচমেটদের মতো আমারও মাথায় শুধু আকাশ নয়, মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল সবই ভেঙে পড়ল। কেননা কাগজ-কলমে এখন আমরাই ‘এইচএসসি’ ক্যান্ডিডেট বা সহজ বাংলায় বললে ‘বোর্ড-পরীক্ষার্থী’। তবুও আমরা ভাবলাম, নভেম্বরে কলেজ খুলে দিলে আমরা হয়তো যে ৭/৮ মাস নষ্ট হয়েছে সেটি পূরণ করতে পারব।

কিন্তু না, সরকার বা শিক্ষামন্ত্রীর সদিচ্ছা থাকলেও, আমাদের সবার জীবনের কথা চিন্তা করে খোলা হলো না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাস চলে গেল, ‘নিউ ইয়ার’ও চলে এল। ও হ্যাঁ, ডিসেম্বরে একবার আমাকে বাসায় যে স্যার পড়াতেন তাঁর কাছে দীর্ঘ ১০ মাস পর ‘জুম’ অ্যাপে ক্লাস করা শুরু করলাম। অন্যদিকে কোচিংগুলোর ফেসবুক পেজ/জুম লিংকে ভাবলাম একটু ঢুঁ মেরে দেখি। তাতে বুঝলাম, এই অনলাইন জীবনের সঙ্গে অনেকেই খুব চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে। কেউ আংশিক পারছে, কেউ পারছে না। হিসাব কষে দেখলাম, আমি দু-দলের মধ্যেই পড়ে গেছি।

নতুন বছরে আমাকে পড়ানো সেই ঢাবির ভাইয়া জানালেন, অনলাইনে পড়ানো তাঁর জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁরই এক বন্ধুকে বলে দেবেন যেন আমাকে ‘অফলাইন’-এই পড়ায়। বেশ, নতুন এক ভাইয়া এলেন পড়াতে, তা-ও জানুয়ারি মাসের অর্ধেক সময় চলে যাওয়ার পর। কথায় কথায় জানা গেল, কৃষক পরিবারের সেই ভাইয়া ঢাকায় একটা মেস ভাড়া নিয়ে থাকছেন। কারণ আর কিছু না, তার গ্রামে ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা। তিনি ঢাবির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র হওয়ায় তাঁর পরীক্ষা চলছিল। এমন একদিন ‘নেট চলে গিয়েছিল’ বলে শতচেষ্টা করেও তিনি পরীক্ষার খাতা সাবমিট করতে পারেননি। যেহেতু হল বন্ধ, তাই একমাত্র ভরসা মেস, আর সেই মেস ভাড়া উঠে আসবে আমার মতো শিক্ষার্থীকে টিউশন করিয়ে। এ তো গেল আমার ‘হোম টিউটর’ এর কথা।

এর ফাঁকে একটু আমার সদ্য ক্লাস ৬-এ ওঠা ভাইয়ের কথা বলা যাক। আমার এই ছোট ভাইয়ের পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা হয়নি। এতে সে যতবার-ই পারে, ততবারই দুজন মানুষের জন্য দোয়া করে। এক. প্রধানমন্ত্রী, দুই. শিক্ষামন্ত্রী। তো আমার ভাইয়ের অঙ্ক ও ইংরেজিভীতি দূর করার জন্য ঢাবির অন্য এক ভাইয়া ওকে বাসায় এসে পড়াতেন। করোনার কারণে তিনি তাঁর গ্রামে চলে গেলেও ভাইকে পড়ানো অব্যাহত রাখেন। তিনি বর্তমান নিয়মের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইনেই পড়ান। কিন্তু নেটওয়ার্ক বিড়ম্বনা এড়াতে প্রায়ই তাকে দেখা যায় এক খোলা মাঠে পড়াতে, যেখানে আশপাশে গরুর ঘাস খাওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এ কথাগুলোর একটাও মিথ্যে নয়, তবে এগুলো হলো বর্তমান জীবনের বাস্তবতা।

এখন আবারও কলেজজীবনে ফিরি। সামনের ফেব্রুয়ারি থেকে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে মাউশির পক্ষ থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। এখন কিছু ভালো-মন্দ দিকের আলোচনা করা যাক।
আমি যে কলেজে পড়ি তাতে শুধু মূল প্রভাতি শাখাতেই শাখা আছে ১০টি। আর প্রতিটি শাখাতে ছাত্রীর সংখ্যা গড়ে ১৬৫+ । আমরা সাধারণত প্রতি বেঞ্চে ২ জন বসে ক্লাস করি। তাই আমাদের ক্লাসে বেঞ্চের সংখ্যা ৮০-৮৫’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। যদি কলেজ খুলে দেওয়া হয়, প্রতি সেকশনে আমরা হয়তো ৮০ জন করে বসতে পারব। তাহলে ক্লাসরুমের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এতগুলো ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকদের স্বাভাবিকভাবেই পড়ানোর গতি অনেকটাই ধীর হয়ে উঠবে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার্থীরাই এত দিন পর নিজ সহপাঠীদের সাক্ষাৎ পেয়ে কোনোমতেই প্রথম সপ্তাহে ক্লাসে ‘পূর্ণ’ মনোযোগ দিতে পারবে না। সেই সঙ্গে এত দিন পর ক্লাসে উপস্থিত থেকে ক্লাস করার সঙ্গেও মানিয়ে নিতে সময় লাগবে।

ধরলাম এটি গেল ক্লাসের চিত্র। কিন্তু টিফিন টাইমে কী হবে? প্রতিটি শিক্ষার্থী কি বাড়ি থেকে খাবার আনতে পারবে? ক্যানটিনে স্বাভাবিক সময়েই যে পরিমাণ ভিড় থাকে, সেটি এই করোনার সময় এড়ানো কি আদতে সম্ভব হবে? ধরে নিলাম, নিয়মকানুন মেনে চললে সেটিও সম্ভব।

কিন্তু ছুটির সময় কী হবে? প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী, তাদের সঙ্গে আসা একজন অভিভাবক, কখনো ড্রাইভার কিংবা কখনো রিকশাচালক—সব মিলিয়ে কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাদ দিলেও প্রায় হাজার চারেক লোক দিনে দুবার একত্র হবেন। সেই সঙ্গে কলেজ গেটের বাইরে উপস্থিত থাকা ফুচকা-ঝালমুড়ির দোকানের কথা না হয় বাদই দিলাম। এই ভিড় কি এড়ানো সম্ভব? ভিড় ঠেকানো সম্ভব না হলে আমার জীবনের নিরাপত্তা কি দেওয়া সম্ভব হবে? আর হ্যাঁ, ঢাকা শহরের প্রতিটি কলেজ এলাকায় কিন্তু শুধু একটি কলেজই থাকে না। আরও অনেক অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও থাকে। এতগুলো মানুষ যে ‘শিক্ষা’র সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে একত্র হবে, তাদের কারোরই কি করোনা হওয়ার ঝুঁকি নেই?
এবারের বইমেলা আর বাণিজ্য মেলার আয়োজন নিয়ে সবাই চিন্তিত। তবে শিক্ষার্থীদের দিনে দুবার, সপ্তাহে পাঁচ দিন—মিলনমেলা নিয়ে কেউ-ই হয়তো চিন্তিত না।
আমি বলছি না স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকুক। সেই ২০২০ সালের মার্চের পর থেকে আমার অনেক বান্ধবীই গ্রামে চলে গেছে। অনেকেই আছে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস করতে পারেনি। অনেকেই আছে কলেজের বেতন পর্যন্ত দিতে পারেনি এমনকি সেকেন্ড ইয়ারের বই পর্যন্ত কিনতে পারেনি। তাদের জন্য হলেও কলেজ খুলে দেওয়া উচিত। তবে মাত্র তিন মাস ক্লাস করিয়ে এরপর বোর্ড পরীক্ষায় বসানোর সিদ্ধান্ত কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে আমার ভয়। কারণ হাতে থাকা বাকি তিন মাসে আমরা এই অফলাইনে করা ক্লাসের পড়া রেডি করব, নাকি যে পড়া এক বছর আগে আমরা ‘কভার’ করতে পারিনি, সেটা পড়ব?
অনলাইনে পড়াশোনার পুরো ব্যাপারটিই দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন। হ্যাঁ, কমবেশি সব কলেজই সিলেবাস প্রায় শেষ করে ফেলেছে। কিন্তু ৩৬ টাকা দিয়ে ১ জিবি এমবি কিনে মাত্র ২ টা জুম ক্লাস করা সবার পক্ষে সম্ভব না। যেখানে প্রতিটি কলেজেই একদিনে জুম ক্লাস হয়েছে ৪টার বেশি।

যারা নীতিনির্ধারক আছেন, তাঁদের সব শিক্ষার্থীর দিকটাই বোঝা উচিত। বোর্ড পরীক্ষা জীবনে একবারই আসে। কেন একটি বৈশ্বিক সমস্যার কারণে আমরা একজন শিক্ষার্থীকে হলেও পেছনে ফেলে এগোব? যেখানে পুরো সিলেবাস কমপ্লিট করার পরও পর্যাপ্ত সময় পেয়েই এইচএসসি ব্যাচ ২০ পরীক্ষা ছাড়াই পাসের মতো সিদ্ধান্ত পেয়েছে। আমাদের মতো যারা বোর্ড পরীক্ষার্থী, তারা কেন দ্বিতীয় বর্ষের টেস্ট পরীক্ষা তো দূরে থাক, তাদের প্রথম বর্ষের ইয়ার ফাইনাল না দিয়েই বোর্ড পরীক্ষার হলে বসবে?
নীতিনির্ধারকদের এই মুহূর্তে উচিত প্রতিটি কলেজের অন্তত একজন প্রতিনিধি শিক্ষকের সঙ্গে বসে সিলেবাস কতটুকু শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছেছিল, তার একটা হিসাব নেওয়া। এরপর সিলেবাস কমানো প্রয়োজন কি না, কিংবা কতটুকু সময় হলে একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর পক্ষে সেই সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষায় বসা সম্ভব, তা নির্ধারণ করা। কোনো ভাবেই কোনো সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের শুধু শারীরিক সুস্থতা-ই নয়, মানসিক সুস্থতাতেও যেন আঘাত না দেয়, সেদিকে লক্ষ রাখা উচিত। কেননা ‘এইচএসসি’ শুধু একটি পরীক্ষা-ই নয়, ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়ার একমাত্র এবং অন্যতম পথ।
*লেখক: সুমাইয়া হোসেন, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন কলেজ