‘স্কুল কি আমগো লাইগা নাকি’

Md. Rashedul Alam Rasel

ছেলেটির নাম রুবেল। বয়স ১১ বা ১২। এই বয়সের ছেলেদের দিকে তাকালেই কেন জানি ছাত্র–ছাত্র একটা ভাব লক্ষ করা যায়, কিন্তু তাকে দেখে মোটেও সে রকম মনে হয় না।
পায়ে রাজ্যের ধুলামাখা, হাতে কালি, চুল উষ্কখুষ্ক। এ রকম কাউকে দেখে ছাত্র ভাবার কারণ নেই। তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করি।
-কিরে থাকিস কই?
সে হাত দিয়ে একদিকে দেখিয়ে বলে, ‘উই তো, উইখানে।’
-স্কুলে যাস না?
রুবেল ফিক করে হেসে দেয়, বলে, ‘স্কুল কি আমগো লাইগা নাকি?’
তার কথাটা শুনে একটা  প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। কিছুক্ষণ লাগে আমার তার কথা বুঝতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলি, করিস কী?
-বাপের লগে কাম করি, এইডা–ওইডা কুড়াই।
- বড় হয়ে কী হতে চাস?
-ডাক্তার হমু, অনেক টেকা কামামু।
এবার আমি হেসে বলি, পড়ালেখা না করে ডাক্তার হবি ক্যামনে রে ব্যাটা?
রুবেল উত্তর না দিয়ে পালিয়ে যায়, সে বুঝতে পেরেছে আমি মানুষটা মোটেও সুবিধার না।

এ রকম একটা-দুইটা বা হাজারটা নয়, বরং লাখো রুবেল ছড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। স্কুল বা পড়ালেখা যাদের কাছে অনেক দূরের বিষয়।

হাতে–কলমে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রাইমারি পর্যায়ে স্কুলে ভর্তির শতভাগ। যদিও তা যথেষ্ট তর্কসাপেক্ষ।

Md. Rashedul Alam Rasel

এই প্রতিবেদন লেখার সময় আমি সর্বশেষ এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া (২০১৯ ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা ছোটখাটো কেসস্টাডি করেছি। ব্যাচটি পিএসসি দিয়েছিল ২০১১ সালে, জেএসসি ২০১৪ সালে, এসএসসি ২০১৭ সালে এবং সর্বশেষ এইচএসসি ২০১৯ সালে। ২০১১ সালে পিএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ২৬ লাখের অধিক। ২০১৪ সালের জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ২১ লাখ। অর্থাৎ, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লাখ বা ১৯ শতাংশ।

২০১৭ সালে এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল ১৭ লাখ। অর্থাৎ, এখানে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ লাখ বা ১৯ শতাংশ। এবং ২০১৯ সালে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ। অর্থাৎ, ঝরে পড়েছে ৪ লাখ বা ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।

তাহলে ২০১১ সালে পিএসসি দেওয়া ২৬ লাখের অধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১৯ সালে এইচএসসি দিয়েছে মাত্র ১৩ লাখ শিক্ষার্থী, যা ৫০ শতাংশের কম।

অর্থাৎ, বাকি ৫০ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত! কারও কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই এই বাকি ৫০ ভাগ ছাত্র এখন কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত। এদের কেউ হয়তো শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে, কেউ রাস্তায় রাস্তায় টোকাইগিরি করে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে আর কেউ হয়তো নিজেকে লিপ্ত করে ফেলেছে অনৈতিক বা অন্যায়মূলক কর্মকাণ্ডে। আর এটা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়, তাদের থেকেই বের হবে ভবিষ্যতের চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, গ্যাংলিডার ইত্যাদি।
ঢাকা শহরের রাস্তায়, ফুটপাতে প্রতিদিন দেখা মেলে অসংখ্য পথশিশুর। আমাদের মনে একবারও প্রশ্ন আসে না, এসব শিশু থাকে কোথায়? তারা কীভাবে জীবন যাপন করছে? যাদের মা-বাবা নেই, তারা কোথায় আশ্রয় পাচ্ছে? তারা খাবার পাচ্ছে কোথায়?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে একটা সূক্ষ্ম ঈঙ্গিত পাওয়া যায় এসব শিশুর কোনো গ্যাং বা গ্রুপের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার। তারা বড় হয় এলাকার বড় ভাইদের ছায়ায়।

আরেক ভাগ শিশু–কিশোর জড়িয়ে পড়ে শিশুশ্রমে। ঠিক ‘জড়িয়ে পড়ে’ বলা যাবে না। কেননা, এদের কেউই সাধারণত স্বেচ্ছায় নিজেদের শিশুশ্রমে জড়ায় না। বেশির ভাগ সময়ই পরিবারের চাপে তারা বিদ্যালয়ে যাওয়া ছেড়ে দেয়। এর প্রধান কারণ অনেক অসচ্ছল পরিবারের বাবা–মায়ের ধারণা, পড়ালেখা করে কী হবে? তাদের সন্তান তো আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। তার চেয়ে বরং এখন থেকে কাজ শিখিয়ে দেওয়া ভালো, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে আর তার পাশাপাশি কিছু আয়–রোজগারও হলো।

২০১১ সালে পিএসসি পরীক্ষা দেয় ২৬ লাখের অধিক শিক্ষার্থী আর এইচএসসি দিচ্ছে কেবল ১৩ লাখ, আমাদের চোখের সামনে বাকি ১৩ লাখ শিশু–কিশোর অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

অন্য ১৩ লাখ শিশু-কিশোরকে হয়তো রাতারাতি গ্র্যাজুয়েট করে ফেলা সরকারের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশের পথশিশু বা সুবিধাবঞ্চিত শিশু–কিশোরদের জন্য বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে।

পথশিশুদের জন্য করা শিক্ষাব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পাঠ্যবই শেষ করে পরীক্ষা দিতে হয় না। ফলে সেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো মার্কস পাওয়ার জন্য পড়ালেখা করে না বা তাদের সে জন্য পড়ানোও হয় না।

যতটুকু গণিত শেখা দরকার টুকটাক হিসাবের জন্য, বিজ্ঞানের যতটুকু সাধারণ বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখা দরকার, যা তাদের জীবনে চলার পথে কাজে লাগবে। যতটুকু জ্ঞান সমাজ ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে জানা দরকার, কেবল এ মৌলিক জ্ঞানগুলো শেখানোই এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য।

এতে দুটি লাভ হয়।

প্রথমত, তারা কিছুটা হলেও সুশিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারে এবং অনুধাবন করতে পারে যে শিক্ষা কেবল বড়লোকদের বিষয় না, এটা মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কম বা বেশি হোক, সবার জীবনেই এর বাস্তব প্রয়োগ রয়েছে। ফলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন করে তোলে।

দ্বিতীয়ত, দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থার ওপর একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন সম্পূর্ণ নিরক্ষর ব্যক্তি থেকে একজন স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তি অবশ্যই তার জীবনে অধিকতর সফলতা বয়ে আনতে পারে। যার সামগ্রিক প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে।

দায়িত্ব কেবল সরকারের না, আমাদের সবার। যত দিন না পর্যন্ত আমরা রুবেলদের মুখ থেকে সেই কথা তুলে নিতে পারছি, ‘স্কুল কি আমগো লাইগা নাকি?’ তত দিন পর্যন্ত আমরা ব্যর্থ, আমাদের সমাজ ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা দূর করাই এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।

লেখক: মো. সাজ্জাদুর রহমান উত্তরা, ঢাকা
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, যুগান্তর, বাংলানিউজ