বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে যুক্তদের বড় অংশই ঝরে যাওয়ার ঝুঁকিতে: মাহবুব মোর্শেদ

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা দেশের ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০২১ সালের তথ্য সংগ্রহ করেছে। তাতে দেখা গেছে, করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। অন্যদের অনুপস্থিতির সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ।

ড. মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। আর শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার শিক্ষার্থী। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে জড়িয়ে যাওয়া এবং পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার কারণ কী হতে পারে বলে মনে করেন?

মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ: এখানে অবশ্যই করোনা মহামারির একটি প্রভাব রয়েছে। তবে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম করোনা মহামারির আগেও ছিল। এখন হয়তো এটি আরও বেড়েছে। এর একটি বড় কারণ হতে পারে অর্থনৈতিক। কারণ, করোনা মহামারিতে অনেক পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য কমেছে। অনেক পরিবার শিশুদের শ্রমে যুক্ত করেছে বা বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হয়েছে। আরেকটি কারণ হতে পারে সামাজিক নিরাপত্তা। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হয়েছে। এ রকম নানামুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে। পাশাপাশি আরেকটি বিষয় বলব সেটি হলো, করোনা মহামারির কারণে আমাদের প্রথাগত শিক্ষা ঠিকমতো কাজ করেনি। তুলনামূলকভাবে সামর্থ্যবান পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরা অনলাইনে বা অন্য পদ্ধতির দূর শিক্ষণে শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাটি বেশি পেয়েছে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কিন্তু এই সুবিধা তেমন পায়নি। অর্থাৎ করোনার এই সময়ে শিক্ষা তাদের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে হয়তো বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। উপরন্তু বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: সাধারণত নিয়ম হলো বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ওপরের ক্লাসে উঠতে দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে যেহেতু বিপুল শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অংশই নেয়নি, উপরন্তু বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে জড়িয়ে গেছে, সে ক্ষেত্রে কি এসব শিক্ষার্থী ঝরে যাবে বলে মনে করেন?

মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ: সবাই না হলেও একটি বড় অংশই স্থায়ীভাবে ঝরে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। কেউ কেউ হয়তো ফিরে আসতে পারে। তাই এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এসব শিক্ষার্থীকে ফিরিয়ে আনার জন্য আশু কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?

মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ: আমি বলব, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে (টার্গেটেড), সমন্বিত ও এ–সংক্রান্ত সব বিষয়কে মাথায় নিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। টার্গেটেড বলতে, প্রথমেই যারা স্থায়ীভাবে ঝরে যাওয়ার বেশি ঝুঁকিতে আছে, তাদের সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হবে। একেক এলাকার কারণ একেক রকম হতে পারে। যেমন রাজশাহীতে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে জড়িয়ে যাওয়ার হার বেশি। তাই স্থানীয় বাস্তবতা চিহ্নিত করতে হবে। এরপর সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ বলতে বোঝাচ্ছি, এখন যেমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের ধরন আলাদা বা বিচ্ছিন্ন। হয়তো দেখা গেল শিক্ষা মন্ত্রণালয় একভাবে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, আবার মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আরেকভাবে কাজ করছে। তাই এখানে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা করে সেটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে সমাজ, পরিবার, বিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে সমন্বিত করে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিতভাবে তদারক করতে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ভবিষ্যতে আর যেন কোনো শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ না হয় বা শিশুশ্রমে যুক্ত না হয়, সে জন্য কী করা উচিত?

মুহাম্মদ মাহবুব মোর্শেদ: আমাদের পরিকল্পনাগুলো হয়ে থাকে, মূলত কোনো একটি ঘটনা ঘটলে তারপর সেটি নিয়ে কাজ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। কিন্তু এ বিষয়ে আগে থেকেই কৌশল ঠিক করে কাজ করতে হবে। আগে থেকেই বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ার মতো ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করতে হবে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কমিউনিটি কিন্তু বলতে পারে, কারা ঝুঁকিতে আছে। তাই এ ধরনের শিক্ষার্থীদের আগে থেকেই চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই ব্যবস্থা হতে পারে আর্থিক প্রণোদনা, সামাজিক সচেতনতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিখন-শেখানো কার্যক্রম। অর্থাৎ, আগে থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে হয়তো এ ধরনের চিত্র কম দেখতে পাব।

আরও পড়ুন