কর্মসংস্থানের বিবেচনায় শিক্ষাকে সাজাতে হবে

● দক্ষিণ এশিয়ায় জিডিপির বিবেচনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম ব্যয় বাংলাদেশের।

● কারিগরি শিক্ষাকে শিল্পচাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে এগোতে হবে।

● ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ নামে আলাদা একটি খাত তৈরিতে জোর দিতে হবে।

অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ

দেশে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে মানসম্মত ও সর্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রাও (এসডিজি-৪) বটে। তবে করোনার বাস্তবতা ও নানা তথ্যপ্রযুক্তির আবির্ভাবে শ্রমবাজারেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। এ অবস্থায় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে দরকার সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ও যথাযথ বিনিয়োগ। দীর্ঘ মেয়াদে মানবসম্পদ উন্নয়নে যেসব মূল নিয়ামক কাজ করে সেগুলো হলো শিক্ষায় বিনিয়োগ, শিক্ষার মান ও শিক্ষার সঙ্গে শোভন এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের যোগসূত্র।

আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, একটি দেশের শিক্ষা বাজেট সে দেশের মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০ শতাংশ বা জাতীয় আয়ের ৪-৬ শতাংশ হওয়া উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে ব্যয় সবচেয়ে কম। জিডিপির বিবেচনায় শিক্ষা খাতে ভুটানে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, ভারতে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, নেপালে ৪ দশমিক ১ শতাংশ ও পাকিস্তানে ২ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যয় করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। এবারও বরাদ্দ জিডিপির ২ শতাংশের কম।

প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের বরাদ্দ শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দের প্রায় ৩৯ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৪৫ শতাংশ বরাদ্দের নির্দেশনা আছে। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগে করোনার প্রভাবও মাথায় রাখতে হবে। ব্র্যাকের ২০২১ সালের এক গবেষণা বলছে, ওই সময় বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এদের অনেকে আর ক্লাসে ফেরেনি। সরকারের কাছে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে উপবৃত্তির টাকা পাওয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মায়ের ডেটাবেজ আছে। ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারকে শনাক্ত করতে এই ডেটাবেজ কাজে লাগানো যেতে পারে।

বিনিয়োগের মান নিশ্চিত করতে হবে

শিক্ষার মান বাড়াতে হলে বিনিয়োগের গুণগতমান নিশ্চিত করা জরুরি। বিনিয়োগের ‘ভ্যালু ফর মানি’ নিশ্চিত করতে হলে সব স্তরে শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। প্রতিবছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় ব্যয় হয়। এ ছাড়া শিক্ষকদের নানা প্রশিক্ষণ দেয় সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান। শ্রেণিমুখী শিক্ষা মাথায় রেখে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি কার্যক্রম নিতে হবে।

শ্রমবাজার ও শিল্পমুখী শিক্ষা

গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষায় লব্ধ জ্ঞান ও কর্মসংস্থানে প্রয়োজনীয় দক্ষতায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। টিআইবির তথ্য অনুসারে, তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪০-৫০ হাজার বিদেশি কাজ করেন। পাঁচ দশক পার হলেও এই খাতে দেশি জনবল তৈরি হয়নি। স্পষ্টতই আমাদের শিক্ষাকার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের দক্ষতার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকের প্রায় ৭৩ শতাংশ স্বল্প দক্ষ।

এখন করণীয় হচ্ছে, শিক্ষাকার্যক্রমকে আরও চাকরিমুখী ও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থানের সঙ্গে যোগসূত্র করা। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রায় ১৪ শতাংশ, যা ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারিগরি শিক্ষাকার্যক্রমকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেমন তৈরি পোশাক, চামড়াশিল্প, অ্যাগ্রো ফুড প্রসেসিং, অটোমোবাইল ইত্যাদি শিল্পচাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে এগোলে সুফল পাওয়া যাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাজারোপযোগী কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্বল্পমেয়াদি কোর্স চালু এবং এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ তৈরির জন্য উপবৃত্তি ও ইনসেনটিভ দেওয়া যেতে পারে।

এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান (২০২২) অনুযায়ী, এক হাজার মানুষের জন্য চারজনের বেশি চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ দরকার। বাংলাদেশে আছে একজনের সামান্য বেশি। কীভাবে শিক্ষার্থীদের উৎপাদনশীলন কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সেদিকে জোর দিতে হবে।

যেসব দেশ শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নত, তাদের গবেষণা ও উন্নয়ন নামে আলাদা একটা খাত আছে। বিশ্বে প্রায় ১২৫টি দেশ এই খাতে বছরে অন্তত ১০০ কোটি ডলার ব্যয় করে। এই খাতে যারা যত বেশি ব্যয় করে, তারা তত বেশি উন্নত। সেই তালিকায় নেপালও আছে। কিন্তু বাংলাদেশ নেই। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পাশাপাশি বাজেটে ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ নামে আলাদা একটি খাত তৈরিতে জোর দিতে হবে।

সর্বোপরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা মাথায় রেখে তরুণ জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে পরিণত করার সাফল্যের ওপর দেশের সামগ্রিক সাফল্য নির্ভর করছে। শিক্ষা ও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের দক্ষ জনবল বিনির্মাণে সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক: এম আবু ইউসুফ, অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট।

ই-মেইল: [email protected]