অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা নিতে কালক্ষেপণের সুযোগ আছে কি

ছবি: সংগৃহীত

স্বাভাবিক সময়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কারণে কিছু না কিছু সেশনজটে ভুগে থাকেন। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেশনজটও ইতিমধ্যে মহামারি আকার ধারণ করেছে। অনেকের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা রয়েছে, অনেকের চাকরিতে আবেদনের বয়স চলে পার হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করছে। এতে তাঁদের শারীরিক–মানসিক অবসাদ গ্রাস করতে পারে এবং তাঁরা নিজেদের জীবনকে বিভিন্নভাবে ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারেন।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার জন্য দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এ পদ্ধতি দেশের প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ নতুন এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার (নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব, ইন্টারনেটের ধীরগতি, ইন্টারনেট ডাটার উচ্চমূল্য, মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বলতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণে অনীহা ইত্যাদি) কারণে সম্পূর্ণরূপে ফলপ্রসূ না হলেও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধন ধরে রাখতে সহায়তা করেছে।

কিন্তু একটি সেমিস্টারের সিলেবাস অনুযায়ী ক্লাস শেষ হওয়ার পর বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ না করলে এ পদ্ধতি মোটেই ফলপ্রসূ হবে না। বিষয়টি আমার আগের লেখাগুলোতে উল্লেখ করেছিলাম। আমার ধারণা, বস্তুত হয়েছেও তা–ই।

করোনা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ক্যাম্পাস কবে খুলবে, শিক্ষার্থীরা কবে ক্লাসরুমে ফেরত যাবেন এবং এটা সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু সরাসরি পরীক্ষার পরিবর্তে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের মতো সিদ্ধান্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল নিজেই নিতে পারত এবং ইউজিসির সঙ্গে সমন্বয় করতে পারত। গত প্রায় ১৫ মাসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলোচিত–সমালোচিত অনেক ঘটনা ঘটলেও উপেক্ষিত থেকে গেছে শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, আমাদের শিক্ষার্থীরা। তবে দেরিতে হলেও ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় তাদের ধন্যবাদ।

আলোচ্য বিষয় হলো পরীক্ষা কীভাবে গ্রহণ করা হবে এবং পরীক্ষায় প্রশ্নের ধরন কী হবে। এর জন্য নানাবিধ সাজেশন এসেছে। পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ওয়েব ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন অন রেখে পরীক্ষা নেওয়া। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, উচ্চগতির ইন্টারনেট পরিষেবা ইত্যাদি নিশ্চিত না করে বর্তমান বাস্তবতায় এটা মোটেই সম্ভব নয়। উপরন্তু অনেকে যায়গায় মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল থাকায় উচ্চগতির ইন্টারনেটসুবিধা দিলেও পরীক্ষার্থীরা হয়তো সুষ্ঠুভাবে ও সময়মতো তাঁদের পরীক্ষা শেষ করতে পারবেন না।
প্রশ্নের ধরন নিয়েও অনেক সাজেশন বা প্রস্তাবনা এসেছে, যেমন সৃজনশীল অ্যাসাইনমেন্ট, বহুনির্বাচনী প্রশ্ন, মৌখিক পরীক্ষা ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই প্রশ্নের ধরন নির্দিষ্ট বিভাগীয় পরীক্ষা কমিটির কাছ ছেড়ে দেওয়াই উচিত হবে বলে মনে হয়।
তাহলে কীভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা উচিত
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমার ব্যক্তিগত অনলাইন ক্লাসের অভিজ্ঞতা ও কুইজ এবং মিড–সেমিস্টার পরীক্ষার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে চাই। আমি গত ছয় মাসে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন লেভেল ও সেমিস্টারের ক্লাস নিয়েছি এবং অনলাইনেই শিক্ষার্থীদের কুইজ ও মিড-সিমেস্টার পরীক্ষা গ্রহণ করেছি। প্রথমত সম্পূর্ণ সিলেবাস (একটি কোর্স বাদে) শেষ করেছি। তারপর কুইজ ও মিড-সিমেস্টার পরীক্ষা অ্যাসাইনমেন্ট আকারে গ্রহণ করেছি। শিক্ষার্থীরা প্রশ্নের উত্তর হাতে লিখে এবং ছবি উঠিয়ে বা স্ক্যান করে গুগল ক্লাসরুমে নির্দিষ্ট সময়ে সাবমিট করেছেন।

উৎস: লেখকের নিজস্ব শ্রেণিকক্ষের তথ্যানুসারে

ওপরের চিত্র থেকে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান, বিভিন্ন ক্লাসে গড় উপস্থিতির হার ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শতভাগ শিক্ষার্থী উল্লেখিত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে শতভাগ ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অপর দিকে সিলেবাস শেষ করার পর কুইজ এবং মিড-সিমেস্টার পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতাম, কোন প্রশ্নের উত্তর কতটুকু লিখতে হবে। সবকিছু আলোচনার পর এবং প্রয়োজনীয় রিসোর্স সরবরাহের পরও কুইজ ও মিড-সিমেস্টার পরীক্ষার গড় নম্বর ছিল ৭০-৭৫ শতাংশের মধ্যে। এর মানে এই নয় যে শিক্ষার্থীরা এর চেয়ে বেশি পেতে পারবেন না বা পারেননি। এর মানে হলো তাঁরা হয়তো শতভাগ চেষ্টা করেননি।
সুতরাং বাস্তবতার নিরিখে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা হলো সম্ভাব্য দ্রুততায় অনলাইনেই সিমেস্টার ফাইনাল পরীক্ষার আয়োজন করতে হবে। অকাম রেজর অনুসারে ‘সবচেয়ে সহজ বা সরল সমাধানই হলো প্রায় সব সময়ই সর্বোত্তম’। তাই সহজভাবে বললে, সিলেবাসের মধ্যে থেকে কোর্স শিক্ষক যেকোনো ফরমেটে প্রশ্ন প্রণয়নের পর বিভাগীয় পরীক্ষা কমিটি তার মডারেশন সম্পন্ন করবে। যেহেতু ওপেন বুক এক্সাম হবে, সেহেতু প্রয়োজনে একটি কোর্সের জন্য একাধিক সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা যেতে পারে এবং গ্রুপ করে তা পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অ্যাসাইন করা যাবে। এমন হতে পারে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, কোনো বিকল্প প্রশ্ন না–ও থাকতে পারে। এরপর কোর্স শিক্ষক বা পরীক্ষা কমিটি গুগল ক্লাসরুমে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তা অ্যাসাইন করবেন।

পরীক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (৩, ২ বা ১ ঘণ্টার মধ্যে) এ–ফোর অফসেট কাগজে তাঁদের উত্তর লিখে শেষ করবেন। উত্তর অবশ্যই হাতে লিখতে হবে। উত্তরপত্রের প্রতি পৃষ্ঠায় অবশ্যই পরীক্ষার্থীর আইডি নম্বর ও পৃষ্ঠা নম্বর লিখতে হবে। এরপর তাঁরা ১০ মিনিট সময় পাবেন উত্তরপত্রের ছবি উঠানোর জন্য অথবা মোবাইল স্ক্যানারের মাধ্যমে স্ক্যান করার জন্য। আশা করা যায়, ইতিমধ্যে শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে ন্যূনতম একটি স্মার্টফোন রয়েছে। যাঁদের ছিল না, তাঁরাও ইউজিসি প্রদত্ত সফট লোনের মাধ্যমে এত দিনে একটি স্মার্টফোনের মালিকানা লাভ করার কথা।

এরপর পরীক্ষার্থীরা সেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তাঁদের উত্তরপত্রের ছবিগুলো অথবা স্ক্যান করা কপি শিক্ষকের গুগল ক্লাসরুমে সাবমিট করবেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর কেউ তা সাবমিট করলে তাঁকে অনুপস্থিত হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কোনো অজুহাত বিবেচনায় না–ও নেওয়া হতে পারে।

যেহেতু একাধিক পরীক্ষার্থী একই প্রশ্নে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন, সেহেতু তাঁদের উত্তর একই ধরনের হতে পারে। তবে পরীক্ষার্থীরা তাঁদের উত্তরপত্র সাবমিট করার পর বিভাগীয় পরীক্ষা কমিটি উত্তরপত্রগুলো প্রিন্ট করবেন এবং হাতের লেখা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন যে কেউ অন্যেরটা নিজের বলে সাবমিট করেননি। যদি হাতের লেখা হুবহু মিল পাওয়া যায়, তবে উভয় পরীক্ষার্থীই বহিষ্কৃত হিসেবে বিবেচিত হবেন।

এরপর বিভাগীয় পরীক্ষা কমিটি সংশ্লিষ্ট কোর্স শিক্ষকের কাছে উত্তরপত্রগুলো মূল্যায়নের জন্য হস্তান্তর করবেন। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত (একাধিক মূল্যায়নকারী অথবা অন্তঃস্থ ও বহিঃস্থ পরীক্ষক) পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। সবশেষে নম্বরপত্র ও প্রিন্ট করা উত্তরপত্র প্রচলিত নিয়মে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা শাখায় জমা দিতে হবে।
তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো পরীক্ষার্থীদের শতভাগ সহযোগিতার মনোভাব পোষণ করতে হবে। অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন শিক্ষকদের জন্য সময়সাপেক্ষ ও চ্যালেঞ্জিং হবে। তাই শিক্ষার্থীদের অসদুপায় অবলম্বন থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে এবং যত দিন অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা চলবে, তত দিন বার্ষিক পরীক্ষায় রিপিট বা ক্যারি অন পদ্ধতি উঠিয়ে দিতে হবে।

একই পদ্ধতি অনুসরণ করে বা কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যবহারিক ও মৌখিক পরীক্ষাগুলো গ্রহণ করতে পারে। এতে দ্রুততম সময়ে পরীক্ষাগুলো গ্রহণ ও মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

উপরিউক্ত সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করার প্রয়োজন হলে সেটাও অতি দ্রুত করতে হবে। সবকিছুর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসির নির্দেশের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হবে, এ রকম যেকোনো সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমেই গ্রহণ করতে পারে এবং করা উচিত। তবে ইউজিসির সঙ্গে সমন্বয় করেই করা ভালো।
পরিশেষে আমাদের যত অর্জনই থাকুক না কেন, আমরা যদি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সুন্দর বাসযোগ্য একটি পৃথিবী না রেখে যেতে পারি এবং তাদের চলার পথকে সুগম করতে না পারি, তবে সব অর্জনই ব্যর্থ হবে। তাই আর কালক্ষেপণ নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভালোর জন্য, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করণীয়, তা যার যার অবস্থান থেকে করতে হবে।

*লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। [email protected]