চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা—বিশ্ব অর্থনীতির বাঘা বাঘা সব নাম। অথচ এদেরকেই কিনা পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ! আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড–২০২০ প্রতিযোগিতায় এই অর্জন এসেছে বাংলাদেশের একদল কিশোর–কিশোরীর হাত ধরে।
এ বছর আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড হওয়ার কথা ছিল কাজাখস্তানে, কিন্তু করোনা মহামারির কারণে শেষ পর্যন্ত তা অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। আর সেখানেই দ্বিতীয়বারের মতো অংশ নেওয়া বাংলাদেশ দল জিতে নেয় ৪টি একক ও ১টি দলগত ব্রোঞ্জ পদক।
এ বছর বাংলাদেশ দলে ছিল এসএফএক্স গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দর্পণ বড়ুয়া, ইসফার জাওয়াদ, ফারিহা জামান, সানিডেল স্কুলের সৈয়দ নাজিফ ইশরাক ও সানবিমস স্কুলের ফারাজ চোধুরী। তারা সবাই বর্তমানে এ লেভেলের শিক্ষার্থী। সঙ্গে দলনেতা হিসেবে ছিল মো. আল-আমিন পারভেজ ও আখতার আহমেদ।
২০১৯ সালে রাশিয়ায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াডে প্রথম অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতেও সেবার ২৯টি দলের মধ্যে ১৫তম স্থান অর্জন করে। সেখান থেকে ফিরে আসার পরই শুরু হয় পরের আসরের প্রস্তুতি।
বাংলাদেশ ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি মো. আল-আমিন পারভেজ জানান, ‘বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এ বছরের জাতীয় পর্ব পুরোটাই অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। প্রায় ৮০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম পর্ব। সেখানে থেকে ২৬ জনকে বাছাই করে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। তারপর জাতীয় ক্যাম্পে জায়গা করে নেয় ১০ জন। সাত দিনের এই ক্যাম্প শেষে আমরা ৫ সদস্যের বাংলাদেশ দল নির্বাচিত করি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য।’
অলিম্পিয়াড নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হচ্ছিল দলের সদস্য সৈয়দ নাজিফ ইশরাকের সঙ্গে। সে বলল, ‘২০১৯ সালে প্রথম ফেসবুক ও সংবাদপত্র থেকে আন্তর্জাতিক ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড সম্পর্কে জানতে পারি। নিজের জ্ঞান পরীক্ষা করার জন্যই আসলে ন্যাশনাল অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া।’
শুধু পদক নয়, ‘সীমানা পেরোনো বন্ধুত্ব’ এই প্রতিযোগিতার অন্যতম অর্জন। ‘ভেবেছিলাম কোভিড-১৯–এর জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বেশি আনন্দ পাব না। কিন্তু তারা বেশ সুন্দর একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল, যেখানে অন্যান্য দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। অনেক মেধাবী প্রতিযোগীর সঙ্গেই ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে’, বলছিল ইশরাক।
২০১৮ সালের শেষ দিকে ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড কমিটি গঠনের পর বেশ দ্রুতই সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ বছর ভালো ফলাফলের আশা ছিল সবারই। কিন্তু বাংলাদেশকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে আসতে পেরে গর্বিত পুরো দলই। অনলাইনে হলেও সবাই মিলে একসঙ্গে বসে প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নেওয়ায় অনেক আনন্দময় মুহূর্ত উপভোগ করেছে প্রতিযোগীরা। তা ছাড়া অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী এরিক মাসকিন ও এস্টার ডুফলো—দুজনের বক্তব্য শোনা ও প্রশ্ন করার সুযোগও পেয়েছে তারা। সেই সঙ্গে একক ও দলগতভাবে জেতা পাঁচ-পাঁচটি পদক তো আছেই।
অন্যান্য দেশে কীভাবে অর্থনীতি শেখানো হয় এবং তারা কীভাবে তা কাজে লাগায়, জানার জন্যই মূলত এই অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ। একদম নতুন ধরনের প্রতিযোগিতা হওয়ায় শুরুতেই আগ্রহ জাগে, কেমন হয় অলিম্পিয়াডের প্রশ্নগুলো। প্রতিযোগীরা জানায়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাটি মূলত অর্থনীতি, ফিন্যান্সিয়াল লিটারেসি ও বিজনেস কেস স্টাডি নিয়ে হয়। তবে প্রশ্নগুলো অনেকটা আমাদের দেশে যে ধরনের পাঠ্যক্রমে অর্থনীতি ও ফিন্যান্স পড়ানো হয়, তার চেয়ে একটু অন্য ধাঁচের। তা ছাড়া কিছু প্রশ্ন থাকে বিশ্ব অর্থনীতি প্রসঙ্গে, আবার কিছু থাকে বিভিন্ন অর্থনীতির কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলো তো আছেই। এসব জানার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় ভাগ্যটাও নাকি বেশ বড়সড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়!
এবার আমরা এক-দুটি পদক পাব বলে আশা রেখেছিলাম, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই পদক জয় করে আনায় খুবই ভালো লেগেছে। জাতীয় ক্যাম্পেও এ বছর আমরা ছেলেমেয়েদের বেশ কঠোর পরিশ্রম করিয়েছিলাম, যার সুফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড কমিটির চেয়ারম্যান
বাংলাদেশ ইকোনমিকস অলিম্পিয়াড কমিটির চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘এবার আমরা এক-দুটি পদক পাব বলে আশা রেখেছিলাম, কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই পদক জয় করে আনায় খুবই ভালো লেগেছে। জাতীয় ক্যাম্পেও এ বছর আমরা ছেলেমেয়েদের বেশ কঠোর পরিশ্রম করিয়েছিলাম, যার সুফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি।’
কমিটি চাচ্ছে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো দেশের আনাচে–কানাচে থাকা অর্থনীতিপ্রেমী ছেলেমেয়েদের তুলে আনতে। কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বললেন, ‘ন্যাশনাল রাউন্ডটা অনলাইনে হওয়ায় নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এবার ঢাকার বাইরের অনেকেই ঠিকমতো অংশগ্রহণ করতে পারেনি। আমাদের মূল লক্ষ্য এখন তাদেরকে খুঁজে বের করা।’
করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে অর্থনীতির রদবদল বড় ভূমিকা রাখবে, সে কথা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে। দর্পণ বড়ুয়া, ইসফার জাওয়াদ, ফারিহা জামান, সৈয়দ নাজিফ ইশরাক, ফারাজ চৌধুরীরা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ায় অংশ নেবে, সেই আশা নিশ্চয়ই আমরা করতে পারি।