এই চা আমার কাপের না
মা-বাবার ইচ্ছায় কিংবা স্রেফ হুজুগের বশে অনেক সময় একটা বিষয় বেছে নিই, যেটা কয়েক বছর পর আর ভালো লাগে না। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তারিক মনজুর
নাইনে উঠে সায়েন্স নিল তুষার। মফস্বলের স্কুলে পড়ত। সবাই বলেছিল, মেধাবীরা সায়েন্স নিয়ে পড়ে। তুষার তাই সায়েন্স-কমার্স-আর্টস ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই ভর্তি হলো সায়েন্সে। এসএসসিতে রেজাল্ট ভালো করতে পারেনি। ফলে ওর মনে হতে লাগল, ও মেধাবী নয়। কলেজে ওঠার পর এবার কেউ কেউ পরামর্শ দিল আর্টস নিয়ে পড়তে। এত দিনে অবশ্য আর্টস-কমার্সের পার্থক্য ভালো বুঝতে শিখেছে। আর্টস নিয়ে পড়ে সে এইচএসসিতে যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করল। ভেবেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়েও আর্টসে পড়বে। কিন্তু মুশকিল হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স-কমার্স-আর্টস এবং আরও অনেক কিছু আছে; পড়ার সময় একটি বিষয় বেছে নিতে হয়।
পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করার আগে হাতে চলে আসে ফটোকপি আর নোট। এমন দুর্বল নোট, যা পড়ে পাস করা যায়, কিন্তু লিখে যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করা যায় না। তারপর দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে উঠতেই মনে হয়, দূর ছাই! কী পড়ছি, আর কী করছি। এই বিষয় আমার জন্য নয়। ইটস নট মাই কাপ অব টি!
কোন বিষয় নিয়ে পড়ব
তুষার যে সমস্যায় পড়েছে, সেই সমস্যার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর মেধাতালিকা আসে। এখান থেকে নতুন করে হিসাব শুরু হয়, কোন বিষয় নিয়ে পড়ব। পাড়া–প্রতিবেশী বলে একরকম, বড় ভাইবোন বলে একরকম, আবার মা-বাবা বলেন আরেক রকম। তা ছাড়া চাইলেই যেকোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যায়, ব্যাপারটি সেরকমও নয়।
ভর্তি হওয়ার পরের সমস্যা
একটা বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস শুরু হয়। স্কুল-কলেজের মতো ঘণ্টা বাজিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয় না। একেক স্যার একেক সময়ে ক্লাস নেন। তারপর কোন বই থেকে কী পড়তে হবে, বুঝতে না বুঝতে পরীক্ষা চলে আসে। পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করার আগে হাতে চলে আসে ফটোকপি আর নোট। এমন দুর্বল নোট, যা পড়ে পাস করা যায়, কিন্তু লিখে যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করা যায় না। তারপর দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে উঠতেই মনে হয়, দূর ছাই! কী পড়ছি, আর কী করছি। এই বিষয় আমার জন্য নয়। ইটস নট মাই কাপ অব টি!
তাহলে আমার কাপ কোনটি
অন্যের কাপে চা খেয়ে ঠিক স্বস্তি আসে না। মনমতো বিষয়ে পড়তে না পারলে সেই পড়াতে আগ্রহও তৈরি হয় না। কেবল পাস করার জন্যই তখন পড়তে হয়। অনেকে গভীর হতাশা আর বিষণ্নতায় ভোগে। অনেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হওয়ার আগেই সব বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে উঠে–পড়ে লাগে। বাস্তবতা হলো, চাকরিজীবনেও নিজের পড়াশোনা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। আর চাকরি করতে করতেও মনে হয়, এমন কাজ কি আমি করতে চেয়েছিলাম?
তাই সবার আগে পরিকল্পনা
প্রথমেই দরকার পরিকল্পনা। স্কুল-কলেজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অন্যের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হয়। ফলে সিদ্ধান্তটুকু নিজের পছন্দসই না–ও হতে পারে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আসার পর নিজের পছন্দের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। হুজুগে পড়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মা-বাবা, বড় ভাইবোন, কিংবা অন্যের মতকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, বিষয়টি কেউ পড়িয়ে দিয়ে যাবে না; পড়তে হবে নিজেকেই। তাই বিষয় বাছাইয়ের সময় সবার আগে নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ভালো বিষয়, খারাপ বিষয়
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ভালো সাবজেক্ট’ আর ‘খারাপ সাবজেক্ট’ বলে দুই ধরনের শব্দ চালু আছে। তাই কোনো কোনো বিষয়ে কার আগে কে ভর্তি হবে, এই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। আবার কোনো কোনো বিষয়ে ঠেলেও কাউকে ভর্তি করা যায় না। ব্যাপারটাকে অবশ্য এত সরলভাবে দেখা উচিত হবে না। এটা ঠিক, চাকরির বাজারে কোনো কোনো বিষয়ের চাহিদা বেশি। তবে, একই সঙ্গে এটাও ঠিক, নিজের পছন্দটাই আসল। তা সে ছাত্রজীবন হোক আর চাকরিজীবনই হোক। তাই পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করলে ভালো ফল করা সম্ভব হয় সহজে; আর পড়াশোনাটাও হয় আনন্দময়।
তবু একটু সমস্যা আছে
একটু সমস্যা অবশ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাইলেই যেকোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। এমনকি ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ওপরের দিকে থেকেও পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। কারণ, আইন, ইংরেজি, অর্থনীতি বা বাংলা—যে বিষয়ই হোক না কেন, কোনো বিষয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য ভর্তি পরীক্ষার একেকটি বিষয়ে আলাদাভাবে নির্ধারিত নম্বর পেতে হয়। তাই ভর্তি পরীক্ষায় বসার আগে এসব শর্ত ভালো করে জেনে নিতে হবে।
ভবিষ্যৎ পেশা
ভবিষ্যতে কোন পেশায় যেতে ইচ্ছুক, এর ওপর নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় বাছাই করা উচিত। অনেকে নিজের পছন্দসই বিষয় পাওয়ার জন্য পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে প্রাইভেটে ভর্তি হয়। কিংবা ‘দামি সাবজেক্ট’ মনে করে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল, কম্পিউটার বিজ্ঞান বা বিবিএতে ভর্তি হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব সিদ্ধান্ত ভালো কি মন্দ, বোঝার জন্য নিজের ভবিষ্যৎ পেশার দিকে আগেভাগে দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেই কাপটা নিজের কি না, নিশ্চিত হতে পারলে দ্বিধা দূর হবে—বর্তমানের পড়াশোনায় আর ভবিষ্যতের কাজে স্বস্তি আসবে।