এ যুগের গুরু-শিষ্য

কেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন পেরোনোর পর উচ্চশিক্ষা বা পেশার ক্ষেত্রে একজন মেন্টর বা পরামর্শদাতা প্রয়োজন? এ প্রসঙ্গে লিখেছেন ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারের সহযোগী অধ্যাপক এহসান হক, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান ফাউন্ডেশনের কর্মী ফাহমিদা চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস–এর অধ্যাপক সাইফ ইসলাম এবং কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নাভিন মুরশিদ।

জুম মিটিংয়ে এক হয়েছিলেন উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষকেরা

বাংলাদেশে শিক্ষার্থী হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা বেশ মজার। ভালো কোনো স্কুলে ভর্তি হতে হবে—ভর্তি হয়ে গেলেন কোচিং সেন্টারে। এসএসসি পরীক্ষার পর তিন মাসের বিরতি, তখনো আছে কলেজ ভর্তি কোচিংয়ের ব্যবস্থা। উচ্চমাধ্যমিকের পরের ভর্তি কোচিংকে তো আমরা ‘ভর্তিযুদ্ধের’ প্রস্তুতিও বলি। বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রকৌশল, ব্যবসায় শিক্ষা, কলা, পড়ালেখার সব শাখার জন্যই আছে বছরব্যাপী কোচিং, সঙ্গে ‘শতভাগ সাফল্যের’ নিশ্চয়তা। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে হলে তো কথাই নেই। ‘স্পোকেন ইংলিশ’–এর নানা কোর্স, স্যাট, জিম্যাট, জিআরই, টোয়েফল, আইইএলটিএস...কত রকম কোচিং।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনোর পর কিংবা পেশাজীবনে প্রবেশের পর ‘কোচিং’ ব্যাপারটা হারিয়ে যায়। ভাবখানা এমন, এখন সামনের দিনগুলো একেবারেই ঝঞ্ঝাহীন, নিশ্চিত। রূপকথার মতো শুধু এগিয়ে যাওয়া।
কিন্তু ব্যাপারটা সত্যিই কি তাই? আদতে কিন্তু জীবনের নানা পর্যায়েই আমাদের ‘কোচিং’ প্রয়োজন। শুধু পরীক্ষা পাসের জন্য বা ভালো জায়গায় ভর্তির জন্য নয়; জীবনের বিভিন্ন পদক্ষেপে দরকার কোনো না কোনো ধরনের ‘মেন্টর’ অর্থাৎ পরামর্শদাতা। নিঃস্বার্থ পরামর্শদাতা।
নতুন চাকরি পেয়ে আপনি আনন্দিত। কিন্তু ভেবে দেখেছেন, পরবর্তী পদোন্নতির জন্য আপনাকে কী করতে হবে? কিংবা কী করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বোচ্চ স্তরে উঠবেন? সামনে আর কী কী পদক্ষেপ নিতে হতে পারে?
ব্যবসা করছেন? ব্যবসাকে আরও লাভজনক করে বিস্তারের আর কী সুযোগ থাকতে পারে? আমাদের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ধাপে এমন কাউকে কি কাছে পাওয়া সম্ভব, যে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নিরপেক্ষভাবে আপনাকে কিছু উপদেশ দিতে পারেন? যাঁর উপদেশ এবং প্রজ্ঞার বলে আপনি মামা-চাচার জোর ছাড়াই নিজের মেধা এবং মননকে পুঁজি করে সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন? এই মানুষগুলোকেই বলা হয় ‘মেন্টর’ বা পরামর্শদাতা । অনেকটা প্রাচীনকালের গুরু-শিষ্য ধরনের, কিন্তু আধুনিক কালের মোড়কে, ভিন্ন প্যাকেজিংয়ে বলতে পারেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে জীবনে ‘মেন্টর’ পাব কী করে?
উপযুক্ত ‘মেন্টর’ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যোগ্য যাঁরা ‘মেন্টর’ আছেন, তাঁরা অনেকেই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত। সম্পর্কে মামা-চাচা-খালা না হলে আপনার পক্ষে তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়া অসম্ভব।
তাহলে উপায় কী? উপায় কিন্তু আছে। সেটা হলো নিজেদের প্রয়োজনে সঠিক নেটওয়ার্ক তৈরি করে নেওয়া। তারই একটি প্রচেষ্টা আমরা শুরু করেছি।
উত্তর আমেরিকায় অনেক মেধাবী বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখন পিএইচডি সম্পন্ন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। সাধারণত তাঁদের পদের নাম সহকারী অধ্যাপক। অবশ্য অনেক বাংলাদেশি ১০-২০ বছর বা তারও আগে ঢুকেছেন এবং বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক অথবা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন। ফেসবুকে এই বাংলাদেশি একাডেমিকদের একটি গ্রুপও আছে, যার সদস্যসংখ্যা ৩৫০ ছুঁই ছুঁই। এখানে যাঁরা জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক আছেন, তাঁরা হয়তো জুনিয়র বাংলাদেশি অধ্যাপকদের ‘মেন্টর’ হওয়ার যোগ্যতা এবং ইচ্ছা রাখেন। তাঁরা অনেকভাবে সহায়তা করতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু ঘটা করে আনুষ্ঠানিকভাবে সবার মধ্যে সমন্বয় সাধন করবে কে?
তিন মাস আগে পরীক্ষামূলকভাবে আমরা একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। কে কে মেন্টরশিপ খুঁজছেন বলে একটি পোল চালিয়েছিলাম ফেসবুকের ওই গ্রুপে। সঙ্গে সঙ্গে হাত তুললেন ৭০ জন উদীয়মান সহকারী অধ্যাপক। সেই সঙ্গে আরেকটি পোল চলল। কোনো জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক কি আছেন, যিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো সদিচ্ছায় জুনিয়র সহকারী অধ্যাপকদের একটু গাইড করবেন বা নির্দেশনা দেবেন? সঙ্গে সঙ্গে হাত তুললেন ৪০ জন স্বনামধন্য জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক।

তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার কাজ করছেন প্রভোস্ট, ডিন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে। সবাই বাংলাদেশের অলিগলি থেকে উঠে আসা চড়াই–উতরাই পেরোনো মাটির মানুষ। সঙ্গে আছে গবেষণা, শিক্ষকতা, অনুদান লেখার প্রচুর অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা। এই সদিচ্ছাকে পুঁজি করে কিছুদিনের চেষ্টায় তৈরি করা হলো ৫০টির মতো ‘মেন্টর-মেন্টি’ (গুরু-শিষ্য) সম্পর্ক।
সম্পর্ক তৈরি করেই তো কাজ শেষ হবে না। সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে। তাই গত ১৩ মার্চ দুপুরে আহ্বান করা হলো এক ভার্চ্যুয়াল মিলনমেলা, পরিচিতি মেলাও বলা যেতে পারে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে ছুটির দিন বলে খুব বেশি অংশগ্রহণকারী হয়তো পাওয়া যাবে না। আমাদের অবাক করে দিয়ে হাজির হলেন উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ জনের বেশি বিভিন্ন স্তরের অধ্যাপক। তাঁদের অধিকাংশই একে অপরকে চেনেন না। উদ্যোক্তাদের অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতির (সাকল্যে পাঁচ মিনিট) পর সবাইকে দ্রুত ধাতস্থ করার জন্য যথেচ্ছভাবে বেশ কয়েকজনকে মাইক্রোফোন অন করে গান গাইতে বলা হলো। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গাইলেন দেশের গান, জাতীয় সংগীত থেকে শুরু করে, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’, ‘আমরা করব জয়’। এর মধ্যে একজন গাইলেন সদ্য মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশি সিনেমার গান। একজন গাইলেন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে উঠলেন, ‘কেন, একলা কেন, দল বেঁধে চলব বলেই না এখানে জড়ো হয়েছি!’ সবার হো হো হাসিতে যখন আড্ডা জমজমাট, তখনই বুঝতে পারলাম, এবার কাজের কথা বলার সময়।
আমাদের মধ্যে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মাদ করিম, তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস ডার্টমুথে প্রভোস্ট হিসেবে নিয়োজিত আছেন। অধ্যাপক করিমের বক্তব্যের পর সবাইকে বিভক্ত করে দেওয়া হলো ছোট ছোট দলে (জুমের ব্রেক আউট রুম)। সঙ্গে রইল কিছু নির্দিষ্ট ‘অ্যাজেন্ডা’ এবং সখ্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
এক ঘণ্টায় অনুষ্ঠান শেষ করে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরও বিদায় নিচ্ছিলেন না কেউ। সবার মধ্যেই প্রশ্ন, কীভাবে বাংলাদেশি একাডেমিক হিসেবে আমরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারি, কী করে আমি আমার পারদর্শিতা ভাগাভাগি করে নিলে অন্যের উপকার হয়? এর মধ্যে চলল সামনে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল বিষয়ে সুস্থ মতানৈক্য ও বিতর্ক।
উত্তর আমেরিকায় একাডেমিকদের নিয়ে আমাদের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ এ পর্যন্ত সফল হয়েছে বলা যায়। নতুন (গত কয়েক বছরের মধ্যে) নিয়োগ পাওয়া সহকারী অধ্যাপকদের যদি সঠিক নির্দেশনা এবং মেন্টরশিপ মেলে, তাহলে তাঁরাই ভবিষ্যতে মেন্টর হিসেবে আবির্ভূত হবেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমাদের এই ছোট উদ্যোগটি একপর্যায়ে ছড়িয়ে যাবে এক বিস্ফোরণের মতো।
আমাদের এই সদ্য পরীক্ষিত মডেলটি খুব সহজেই যে কেউ পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত একাডেমিকরাও এই রকম মেন্টরশিপের ব্যবস্থা করতে পারেন। পিএইচডির পর যাঁরা পোস্ট-ডক হিসেবে কাজ করছেন, তাঁদেরও ‘মেন্টর’ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও যুক্ত করে দেওয়া যায় উপযুক্ত এবং মেধাবী মেন্টরদের সঙ্গে। বাংলাদেশের শহরের বাইরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া যায় দেশে বা বিদেশে অবস্থানরত মেধাবী গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের।
প্রশ্ন থাকতে পারে, মানুষ তাঁর মূল্যবান সময় নিজের সাফল্যের পেছনে ব্যয় না করে অন্যের সাফল্যের পেছনে কেন ব্যয় করবে? আমরা বলি, কেন করবে না? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রবাদটি তো বাংলাতেই আছে, না কি?
পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই সফলতার মুখ দেখেছেন অন্যের সাহায্যে এবং অনুসঙ্গে। তাঁদের অনেকেই এই সৌভাগ্যের জন্য কৃতজ্ঞ এবং পরোপকারের জন্য, প্রতিদান দেওয়ার জন্য উদ্‌গ্রীব। আবার অনেকে আছেন যাঁরা নিজেরা তেমনভাবে মেন্টরশিপের সুবিধা-সৌভাগ্য পাননি, তা সত্ত্বেও তাঁরা সফলতার মুখ দেখেছেন এবং নতুন প্রজন্মকে পথ দেখানোর জন্য সময় দিতে প্রস্তুত আছেন। তাঁরা আমাদের মধ্যেই আছেন। দরকার শুধু সমন্বয়।