করোনাকালে ভার্চ্যুয়াল শিক্ষাবর্ষ

স্লোভেনিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছার ক্যাম্পাসে লেখক।
ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে জীবন। একদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়ত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে, অন্যদিকে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত সর্বত্র নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিশাল ক্ষতি করেছে, সেটা কোনোভাবে পোষানোর মতো নয়। কেননা, শিক্ষাক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বিপর্যয় দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করে, যা থেকে সহজে উত্তরণ লাভ করা কোনোভাবে সম্ভব নয়।

স্লোভেনিয়াতে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয় গত বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে। এরপর ধীরে ধীরে দেশটির সরকার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে লকডাউনের পথে হাঁটে, ফলে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথম ধাপে করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্লোভেনিয়া ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সফল দেশগুলোর মধ্যে একটি। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে স্লোভেনিয়াতে কোভিড মহামারি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। গত বছরের মার্চ থেকে শুরু করে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ছিল দেড় হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু সেপ্টম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পুনরায় অবনতির পথে হাঁটতে থাকে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়াতে কোভিড মহামারির সেকেন্ড ওয়েভের আঘাত আসে।

প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপে সংক্রমণের হার ছিল কয়েক গুণ বেশি। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪০০–এর কিছু বেশি, অথচ কোভিড মহামারির সেকেন্ড ওয়েভে স্লোভেনিয়াতে কোনো কোনো সময় দৈনিক সংক্রমণ ছিল ২ হাজারের ওপরে।

গত বছরের মার্চ মাস থেকে আমরা তাই ইউনিভার্সিটি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন, যদিও অক্টোবর মাসের প্রথমার্ধে কয়েক দিন সশরীর ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভে করোনার সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে খুব বেশি দিন সশরীর ইউনিভার্সিটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। এবারের শিক্ষাবর্ষটিও তাই শেষ হতে চলেছে পুরোপুরি ভার্চ্যুয়ালি।

অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষের মাত্রা ছিল অনেকটা বেশি। সশরীর ইউনিভার্সিটিতে কোনো ক্লাসে অংশ নেওয়ার যে উপযোগিতা, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসের মাধ্যমে সেটি কোনোভাবে অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের স্কুল অব সায়েন্সের ডিন প্রফেসর ড. সান্দ্রা গার্দোনিও এক অনলাইন সেমিনারে স্পটভাবে এ ধরনের বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন।

সায়েন্সের ভাষা হচ্ছে, ম্যাথেমেটিক্স এবং সায়েন্স ও টেকনোলজিবিষয়ক যেকোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে হলে ম্যাথমেটিক্সে পারদর্শী হওয়া অত্যাবশ্যক।

অনলাইনে ম্যাথমেটিক্সের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায় না। বিশেষত, যিনি শিক্ষক, তাঁকে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, তাঁর শিক্ষার্থীরা আদৌতে কোনো টপিক সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করছেন কি না, সে বিষয়ে অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে যান। ম্যাথমেটিক্স হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যেখানে পরিপূর্ণভাবে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে যেকোনো শিক্ষার্থীকে জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তা ছাড়া নিরবচ্ছিন্নভাবে কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের ডিভাইসের দিকেও মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না যে কারও পক্ষে, অতিরিক্ত মোবাইল ও কম্পিউটারের ব্যবহার চোখের জন্যও ক্ষতিকর। যাঁদের আবার ঘাড়ব্যথার সমস্যা রয়েছে, তাঁদেরকেও টানা দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে থাকতে চিকিৎসকেরা নিরুৎসাহিত প্রদান করেন।

অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে আরও একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে ইন্টারনেট সংযোগ, সব সময় সব জায়গায় একই মাপের ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায় না। এ ছাড়া কারিগরি ত্রুটির বিষয়ও রয়েছে। পাশাপাশি ব্যবহৃত ডিভাইস আপগ্রেডেড নাহলে কাঙ্ক্ষিতভাবে অনলাইন ক্লাসের সুফল পাওয়া যায় না। স্লোভেনিয়ার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান তুলনামূলকভাবে অনেকটা সচ্ছল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও স্লোভেনিয়া পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তাই এ কারণে স্লোভেনিয়াতে বেশির ভাগ জনসাধারণের পক্ষে অনলাইন ক্লাস তেমন একটা প্রতিবন্ধকতার না হলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ভার্চ্যুয়াল ক্লাস গরিবের হাতি পোষার মতো ব্যয়বহুল একটি বিষয়। এ কারণে অনেকে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক হিসেবে আখ্যা দেন। যেসব শিক্ষক বয়সের দিক থেকে অনেকটা সিনিয়র পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে অনেক সময় সঠিকভাবে অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমার ইউনিভার্সিটির অনেক শিক্ষকও অনলাইন ক্লাসের প্রতি এ কারণে আস্থাশীল নন। এ ছাড়া অনলাইনে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা পরিচালনা করাও বেশ দুরূহ একটি বিষয়। কতটুকু স্বচ্ছতার সঙ্গে একজন শিক্ষার্থী কোনো পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন, সেটা যাচাই করা একজন শিক্ষকের পক্ষে অনেক সময় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

কয়েক মাস আগে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, শতকরা ৫০ ভাগের অধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার ওপর অসন্তুষ্ট।

তবে করোনাকালে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল আমাদের ইউনিভার্সিটি বিভিন্নভাবে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সভায় আমাদের ডিন ড. সান্দ্রা গার্দোনিও সব ক্ষেত্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের অধিক গুরুত্ব দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁর অভিমত ছিল, বিদেশি শিক্ষার্থীরা নিজেদের দেশ ছেড়ে স্লোভেনিয়াতে এসেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য, তাই তাঁদের সবার প্রথমে সহায়তা করা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব।

ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছার ইন্টারন্যাশনাল অফিস ও স্কুল অব হিউম্যানিটিজ ভবন
ছবি: সংগৃহীত

বিশেষত মহামারি চলাকালে স্লোভেনিয়া সরকারের পক্ষ থেকে স্লোভেনিয়ান শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার কথা বলা হলেও বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো ঘোষণা না থাকায় তিনি বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাই কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো ধরনের আর্থিক সংকটে পড়েন, বিশেষত যদি কারও বাসাভাড়া পরিশোধে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে তাঁকে কোনো ধরনের সংকোচ ছাড়া ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আমাদের কিছু কিছু কোর্স আছে, বিশেষত ল্যাব কোর্সগুলোতে একজন শিক্ষার্থীকে সশরীর ইউনিভার্সিটিতে উপস্থিত থাকতে হয়। এ ধরনের কোর্সের ক্ষেত্রে তিনি স্বল্প পরিসরে ইউনিভার্সিটি খোলা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। ল্যাব ক্লাসগুলোকে এভাবে সাজানো হয়, যেন কোনো ক্লাসে একজন শিক্ষার্থী ও একজন প্রশিক্ষকের বাইরে অন্য কেউ উপস্থিত থাকতে না পারেন।

ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে সবাইকে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হয়েছিল এবং ল্যাব ক্লাসগুলোর ক্ষেত্রেও বিদেশি শিক্ষার্থীদের সবার আগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। তাড়াতাড়ি ল্যাব কোর্স সম্পন্ন করে কোনো শিক্ষার্থী যাতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া এ ধরনের সংটক মুহূর্তে নিজ দেশ ও পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরে যেতে পারেন, সে জন্য এ ধরনের উদ্যোগের কথা তিনি বারবার উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়া আগামী অক্টোবরের আগে করোনা প্রতিরোধে সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই। যেকোনো প্রয়োজনে তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। দূতাবাসের পক্ষ থেকে করোনা মহামারির সূচনালগ্নে স্লোভেনিয়া ও হাঙ্গেরিতে বসবাস করা সেলফ ফাইন্যান্সিং শিক্ষার্থীদের ১৫০ ইউরো করে অর্থসাহায্য প্রদান করা হয়। দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন রাহাত বিন জামান এবং দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ও দূতালয় প্রধান তারাজুল ইসলাম সার্বক্ষণিক স্লোভেনিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া ও স্লোভাকিয়ায় বসবাস করা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। এ ধরনের ক্রান্তি সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেকোনো সমস্যা সমাধানে দূতাবাসের ভূমিকা ছিল প্রশংসা করার মতো। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সব নাগরিককে কী ধরনের সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, সে বিষয়েও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল দূতাবাসের পক্ষ থেকে।

কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, করোনাকালে অতিক্রম করা এবারের শিক্ষাবর্ষ নিয়ে আমার অভিমত কী? তাহলে আমি বলব, আমি অনলাইন ক্লাসের পক্ষপাতি নই। এটা ঠিক যে বিগত দুই সেমিস্টারে কোনো ধরনের ল্যাব ক্লাস না থাকায় স্লোভেনিয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশে থেকে আমার পক্ষে পুরো শিক্ষাবর্ষ শেষ করার সুযোগ হয়েছে। একাধারে এত দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করার সুযোগ হয়তোবা আগামী দিনে আর আসবে না। তবে আমি মনে করি, আমি যদি সশরীর ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করার সুযোগ পেতাম, তাহলে কোনো একটি সাবজেক্টের ওপর যে ধরনের দক্ষতা তৈরি হতো, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। তাই কোনো সাবজেক্টে পাস করার পরও ওই সাবজেক্টের ওপর আমার জ্ঞানের স্তর অনেকটা নিচে থাকবে। অনলাইন ক্লাস মাঝেমধ্যে বিরক্তিকরও হয়। অনেক সময় মনে হয়, শিক্ষকেরা কোনো ধরনের কাগজ–কলম কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডের সংস্পর্শ ছাড়া কেবল স্লাইড কিংবা বইয়ের থেকে রিডিং পড়ে ক্লাসের সমাপ্তি টানলেন। আমার অনেক সহপাঠীও অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমের ফলে হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা চলতি শিক্ষাবর্ষকে বর্ধিত করবেন, অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত দুটি সেমিস্টারকে পুনরায় আগামী শিক্ষাবর্ষে চালিয়ে যাবেন।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।