কেমন চলছে ফার্স্ট বেঞ্চারদের পড়ালেখা
অনলাইন ক্লাসে ‘ফার্স্ট বেঞ্চ’ বলে কিছু নেই। তাই বলে কি ফার্স্ট বেঞ্চারও থাকবে না? ফার্স্ট বেঞ্চার বলতে সাধারণত পড়ালেখায় যাঁরা মনোযোগী, তাঁদেরকেই বোঝায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই দীর্ঘ বন্ধে পড়ালেখায় মনোযোগ ধরে রেখেছেন। এ বিষয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন আশিকুজ্জামান
জাহানারার মতে প্রতিদিন পড়ার বিকল্প নেই
‘অনলাইন ক্লাসে একটু অসুবিধায় পড়তেই হয়। আগে যেমন সরাসরি শিক্ষক বা বন্ধুদের কাছ থেকে কিংবা সেমিনারে হাজির হয়ে বই-নোট পাওয়া যেত, এখন সে সুযোগ নেই। অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে অনলাইনে পাওয়া জার্নালের ওপর, ’ বলছিলেন ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী জাহানারা আক্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকে ব্যাচের সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়েছেন তিনি।
শুরু থেকে অনলাইনেই স্নাতকোত্তরের ক্লাস করছেন এই মেধাবী শিক্ষার্থী। বললেন, ‘ভালো ফল অর্জন করার ক্ষেত্রে প্রতিদিনের পড়াশোনা প্রতিদিন শেষ না করার বিকল্প নেই।’
জানালেন, করোনাকালের শুরুতেই সহিহভাবে কোরআন পড়ার চর্চা করেছেন তিনি। এরপর যেসব বিষয়ে তিনি দুর্বল, সেগুলোর ওপর জোর দিয়েছেন। যেমন কম্পিউটার, যোগাযোগ, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন, ইত্যাদি।
জাহানারা বলেন, ‘অনেক সময় একাডেমিক পড়াশোনার কারণে আমাদের সাহিত্যবিষয়ক পড়াশোনা হয় না। করোনার সময়ে আমি প্রচুর সাহিত্য পড়ার চেষ্টা করেছি। জার্নাল পড়েছি।’
দিনের পড়া দিনে শেষ করেছেন ইশতিয়াক
ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পরপরই কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক মাঈনুদ্দিন। সিজিপিএর হিসাব অনুযায়ী নিজ ব্যাচে তাঁর অবস্থান চতুর্থ। ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কুমিল্লা বোর্ড থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে দ্বিতীয় হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও ছিলেন অষ্টম অবস্থানে। মুঠোফোনে বলছিলেন, ‘অনলাইন ক্লাস শুরু হওয়ার পর আমার আর সমস্যা হয়নি। আগে থেকেই প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করে রাখার অভ্যাস ছিল। অনলাইন ক্লাসেও সেই অভ্যাস ধরে রেখেছি।’
শুরুতে বেশ অসুবিধায় পড়েছেন, সে কথাও বললেন। আগে যে বইগুলো নীলক্ষেত থেকে সংগ্রহ করতে পারতেন, সেগুলোই দোকানের কারও না কারও সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়েছে।
গত দেড় বছরে পড়ালেখার বাইরে নানা আয়োজনে যুক্ত হয়েছেন তিনি। অনলাইনে সিভি রাইটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন টুলসের কাজ শিখেছেন। বেশ কিছু সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত এই তরুণ।
এখন ইশতিয়াক ঢাকায় আছেন। টিউশনির পাশাপাশি অনলাইন ক্লাসে অংশ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছে তাঁর।
সুলতানার কাছে ক্লাসের গুরুত্ব আগের মতোই
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার ছাত্রী বিবি চাঁদ সুলতানা যখন তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে পড়ছেন, তখনই করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় ক্যাম্পাস। ব্যাচের সর্বোচ্চ সিজিপিএ পাওয়া এই শিক্ষার্থী প্রতিদিন পড়ালেখার জন্য অন্তত এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ রাখেন। পাশাপাশি কোর্স–সম্পর্কিত একাধিক লেকচার অনলাইনে দেখে ফেলেন। শিক্ষকদের পড়ানো বিষয়সংশ্লিষ্ট জার্নাল পেলে সেগুলোতেও চোখ বুলিয়ে নেন।
বিবি চাঁদ সুলতানা বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখাই তো আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। দিনের পড়া দিনে শেষ করলে মানসিকভাবে স্বস্তি পাওয়া যায়।’
ঘরে বসে তালিকা তৈরি করে নিজের পছন্দের বেশ কিছু বিষয় শিখে নিয়েছেন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘প্রথম কয়েক মাস প্রচুর টিভি সিরিজ আর সিনেমা দেখেছি, বই পড়েছি, অনলাইনে গেম খেলেছি। তখনো অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়নি। একসময় মনে হলো সময়টা তো কাজে লাগানো উচিত। তখন ঘরে বসে গ্রাফিকস ও অ্যানিমেশনের কাজ শেখা শুরু করি।’ ইউটিউব দেখেই ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা কিংবা কোডিংয়ের মতো কাজ শিখেছেন তিনি। ভিনদেশি বৃত্তিগুলোর খোঁজ নিয়েছেন। অনলাইনেই শিখেছেন জার্মান ভাষা। অনলাইনভিত্তিক সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। বিবি চাঁদ সুলতানা বলছিলেন, ‘কতটুকু দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছি, জানি না। তবে করোনাকাল আমাকে আরও ধৈর্যশীল করেছে।’
হাল ছাড়েননি হাসিব
দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রপ্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবদুল আল হাসিব। ব্যাচের সর্বোচ্চ সিজিপিএ পাওয়া এই শিক্ষার্থী করোনাকালের শুরুতেই গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় চলে গিয়েছিলেন। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় পড়ালেখায় একটু ক্ষতি তো হয়েছেই। বিভাগের সিনিয়রদের সহায়তা নিয়ে কিংবা কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কাজ শিখে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।
সব সময় কাগুজে বইয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কম্পিউটারে বা মোবাইলে পিডিএফ পড়ে নাকি তাঁর মন ভরে না। হাসিব বলছিলেন, ‘হয়তো মোবাইলে একটা কিছু পড়ছি, হঠাৎ টুং করে কোনো একটা নোটিফিকেশন এল। ফলে মনোযোগ ধরে রাখা যায় না। তাই আমি সিনিয়র ভাইদের সহায়তা নিয়ে আমার বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জনে জোর দিয়েছি।’ প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন গুছিয়ে রাখেন। কুইজ পরীক্ষাগুলোকে আগের মতোই গুরুত্ব দেন। তাই চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে হাসিবকে সমস্যায় পড়তে হয় না।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে হাসিবের বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। কঠিন একটা সময় গেছে হাসিবদের। পারিবারিক অসচ্ছলতা দূর করতে টিউশনি শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি বন্ধুরা মিলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তাও করেছেন। নিজেকে প্রস্তুত করার পাশাপাশি পরিবারে সহায়তাও করেছেন এই মেধাবী তরুণ।
অনলাইনের সুবিধাটাই কাজে লাগাচ্ছেন ঋত্বিকা
সৈয়দা ঋত্বিকা মাহমুদের সিজিপিএ ৩.৯৩। ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের স্থাপত্যের শিক্ষার্থী তিনি। স্থাপত্য বিষয়টা তো অনেকটাই ব্যবহারিকনির্ভর। করোনায় যেখানে ক্যাম্পাস বন্ধ, নিজের উদ্যম ধরে রেখে কীভাবে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন তিনি?
চূড়ান্ত বর্ষের এই শিক্ষার্থী বললেন, ‘আমাদের অনেক রকম সৃজনশীল কাজ করতে হয়। মুশকিল হলো আগে সিনিয়রদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় কিংবা ক্যাম্পাসে যখন-তখন শিক্ষকদের পরামর্শ নিয়ে আমরা আইডিয়া পেয়ে যেতাম। এই জায়গায় একটু ঘাটতি হয়েছে। এখন মনে হয় রোবটের মতো শুধু অ্যাসাইনমেন্ট সাবমিট করে যাচ্ছি। আর আমাদের পড়ালেখার মধ্যে রাখতে শিক্ষকেরাও একের পর এক অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েই যাচ্ছেন। আগে এতটা চাপ ছিল না। কিংবা হয়তো ছিল, কিন্তু এতটা অনুভব হতো না।’
সমস্যা ভুলে অনলাইন ক্লাসের সুবিধাটুকুই কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন ঋত্বিকা। এখন যেহেতু ক্লাস রেকর্ড করা থাকে, পরে চাইলে যেকোনো সময় দেখে নেওয়া যায়, তাই এটা তাঁর খুব কাজে আসছে। ঋত্বিকা বলেন, ‘স্থাপত্য নিয়ে কোথায় কী প্রতিযোগিতা হচ্ছে, কে কী প্রকল্প করছে—এসব খবর আগেও আমরা রাখতাম। কিন্তু অনলাইনের সুবাদে এখন সেসবের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত থাকছি।’