ছাত্র অবস্থায় আমরা যেসব ভুল করি

প্রথম আলো ফাইল ছবি

করোনা সময়ে আপনি কী মিস করছেন? এ প্রশ্ন করেছিলাম আমাদের ফেসবুক গ্রুপের অনেক সদস্যকে, যাঁরা এখনো ছাত্র। সবচেয়ে কমন বিষয় ছিল ক্যাম্পাস। কেউ বলেছেন গ্রুপ স্টাডি। কেউ পড়াশোনার কথা। তবে এসব মিস করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ, আপনি কখনো এভাবে বাড়িতে আটকে ছিলেন না। এখন বাড়িতে বসে আমরা আমাদের সময় কতটুকু কাজে লাগাচ্ছি? সময় কাজে লাগাতে গিয়ে আমরা কি জীবনের প্রয়োজনীয় এ সময়ে কোনো ভুল করছি? ভুল হতেই পারে, কিন্তু ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়াটা ভুলের চেয়েও মস্ত ভুল; সঙ্গে বোকামি ও নির্বোধের পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। আর সফল হতে চাইলে আমাদের অনেক অনেক ভুল করতে হবে, তারপরও হার মানা যাবে না। ওই ভুল থেকে অনবরত শিখে যেতে হবে।

আজ এখানে পাঁচটি মারাত্মক ভুল নিয়ে আলোচনা করব—

১. খারাপ সঙ্গে প্রভাবিত হওয়া

এই গল্পের সত্যতা আমার জানা নেই। আইনস্টাইনের যিনি ড্রাইভার ছিলেন, তিনি একদিন আইনস্টাইনকে বললেন, আপনি প্রতিটি সভায় যে ভাষণ দেন, সেগুলো শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আইনস্টাইন তো অবাক! উনি বললেন, ‘বেশ, তাহলে এর পরের মিটিংয়ে যেখানে যাব, তাঁরা আমাকে চেনেন না, তুমি আমার হয়ে ভাষণ দিয়ো আর আমি ড্রাইভার হয়ে বসে থাকব।’ এরপর সেই সভায় তো ড্রাইভার হুবহু আইনস্টাইনের ভাষণ গড় গড় করে বলে গেলেন। উপস্থিত বিদ্বজ্জনেরা তুমুল করতালি দিলেন। এরপর তাঁরা ড্রাইভারকে আইনস্টাইন ভেবে গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলেন। সেই সময়ে একজন অধ্যাপক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, ওই আপেক্ষিকের যে সংজ্ঞাটা বললেন, আরেকবার সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেবেন?’

আসল আইনস্টাইন দেখলেন বিপদ, এবার তো ড্রাইভার ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু তিনি ড্রাইভারের উত্তর শুনে তাজ্জব হয়ে গেলেন। ড্রাইভার উত্তর দিল।

‘এই সহজ জিনিসটা আপনার মাথায় ঢোকেনি? আমার ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করুন সে বুঝিয়ে দেবে...।

নীতিবাক্য

জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে চলাফেরা করলে আপনিও জ্ঞানী হবেন। আপনি যেমন মানুষের সঙ্গে ঘুরবেন, তেমনই হবেন।
কেমন লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা সঙ্গ করা উচিত? ইমাম গাজ্জালি (রহ.) এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘সবাইকে বন্ধু নির্বাচন করা যাবে না, বরং তিনটি গুণ দেখে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। গুণ তিনটি হলো—
১. বন্ধুকে হতে হবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ
২. বন্ধুর চরিত্র হতে হবে সুন্দর ও মাধুর্যময় এবং
৩. বন্ধুকে হতে হবে নেককার ও পুণ্যবান

ফরাসি এক প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘বন্ধুত্ব হলো তরমুজের মতো। ভালো এক শটিকে পেতে হলে এক কোটি আগে পরীক্ষা করে দেখতে হয়। তাই বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সততা, আমানতদারি, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা প্রভৃতি গুণের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। তাই বন্ধুত্ব যদি করতে হয়, তাহলে ইসলামের নির্দেশনা অনুসারে বন্ধু নির্বাচন করা উচিত।

হলিউডের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ড্রিউ ব্যারিমোর। সাত বছর বয়সে হলিউড ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। যখন তিনি ১১ মাস বয়সের ছিলেন, তখন তাঁকে প্রথম চরিত্রের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। চলচ্চিত্র জগতের সাফল্য তাঁকে খুব নোংরা সামাজিক গোষ্ঠীর কাছে টেনে নিয়েছিল। নাইট লাইফ এবং ডান্স, বার পার্টি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং অবশেষে খুব কম বয়সে তাঁকে ১৮ মাস পুনর্বাসনে থাকতে হয়েছে। নিজের আত্মজীবনী ‘লিটল গার্ল লস্ট’-এ জীবনের এই পর্বে তিনি খুব আফসোস করেছিলেন। একইভাবে, আমরা সবাই বিভিন্ন কুপ্রভাব দ্বারা প্রভাবিত হতে পারি, যা আমাদের অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে পারে। তাই এই সময়টাতে খুব সতর্ক হয়ে চলতে হবে।

Don’t be afraid to walk alone, after all a tiger doesn’t lose sleep over the opinions of sheep.

২: ছাত্র অবস্থায় উপার্জন করতে না শেখা

বেনটন গ্রামার স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি বড় ভাই রয় ডিজনির সঙ্গে পত্রিকা বিলি করার কাজ শুরু করেন ওয়াল্ট ডিজনি। এই চরম দুঃসময়ে তাঁর বড় ভাই রয় ডিজনিকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোয় পাশে পেয়েছেন। ভাইয়ের প্রতি তাঁর বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা দুটোই ছিল বেশ। ভোররাতে উঠে বেরিয়ে পড়তেন পত্রিকা বিক্রি করতে। কাজ শেষে ছোট একটা ঘুমের পর আবার রওনা হতেন স্কুলে।

স্কুল থেকে ফিরে আবারও পেপার বিক্রির কাজ। টানা ছয় বছর এই ক্লান্তিকর কাজ করে যান তিনি। ক্লান্তির জন্য কখনো কখনো ক্লাসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। কিন্তু আঁকাআঁকির প্রতি তাঁর ভালোবাসা কমেনি কখনোই। আর্ট ক্লাসে চমৎকার সব স্কেচ করে অবাক করে দিতেন শিক্ষকদের। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নটাকে তিলে তিলে বড় করতে থাকেন চর্চার মাধ্যমে। নিউজ পেপার বিক্রির সুবিধায় কার্টুন এঁকে পেপারেও ছাপাতেন মাঝেমধ্যে। কিছু বাড়তি আয়ও হয়ে যেত।

এরপর তো বাকিটা ইতিহাস। সেই ডিজনি নিজেকে কোন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা কারও অজানা নয়।

আপনি যদি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর প্রান্তে বা আপনি ইতিমধ্যে ছাত্র অবস্থায় থাকেন, তবে অবশ্যই কিছু পকেট খরচের অর্থ উপার্জন করা নিয়ে আপনার অবশ্যই চিন্তাভাবনা করা উচিত। ওপরে ডিজনির গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি। ছাত্র অবস্থায় ইন্টার্নশিপ, খণ্ডকালীন চাকরি, অনলাইন চাকরি বা এমনকি ছোটখাটো ব্যবসার চেষ্টা করুন। মোটকথা হলো নতুন নতুন দক্ষতা অর্জন করা। সর্বোপরি, এগিয়ে যাওয়ার প্রথম ধাপটি এখান থেকেই শুরু করা।
The secret of getting ahead is to just get started.

৩: পছন্দের ক্যারিয়ার নিয়ে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া

আপনি বড় হয়ে কী হতে চান? ছাত্র অবস্থায় এই প্রশ্ন শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। কোনো প্রকার কনফিউশন না রেখে এক কথায় উত্তর দিন, ‘আমি জানি না।’

ইলন মাস্ক, বিল গেটস, ড. ইউনূস—তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পড়াশোনা আর বর্তমান ক্যারিয়ার লাইফ এক নয়। একজন ইলন মাস্ক ছোটবেলায় টেসলার মতো গাড়ি কোম্পানির প্রধান কিংবা বিল গেটস সফটওয়্যার কোম্পানির প্রধান, ড. ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সারা বিশ্বের জন্য সামাজিক অর্থনীতির জন্য কাজ করবেন, তা কখনো ভাবেননি।
আমাদের বড় ভুলটি তখন ঘটে, যখন ‘হার্ড মেন্টালিটি’ আমাদের ঘিরে ধরে। আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবতে পারি না। বেনজমিন ফ্রাঙ্কলিনের ভাষায়, ‘If everyone is thinking alike, then no one is thinking.’

সুতরাং ‘আমি জানি না’ বলাটা দোষ নয়। বরং চারপাশ থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্যারিয়ার গঠনের জন্য বিভিন্ন ধাপ পার হওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভবিষ্যতের জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত হওয়া চাই। আর প্রস্তুত হতে চাইলে অতীতের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এগোতে হবে বর্তমান থেকে যা শিখছি, তা নিয়ে। শুধু যন্ত্রের মতো সব মুখস্থ করলে আমাদের আর যন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। চেষ্টা করতে হবে সৃষ্টিশীল হতে। নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতার পরিচর্যা করতে হবে, আরও গঠনমূলক হতে হবে।

৪: কোনো বিষয়ে গভীর চিন্তাভাবনার অভ্যাস গড়ে না তোলা

গুগলে যদি প্রশ্ন করি, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত? আই ফোনে সিরিকে জিজ্ঞাসা করি, সূর্য ডুবে গেল কেন? এদের উত্তর শুনে আমরা আশ্চর্য হয়ে যায়। আমরা ভাবতে থাকি! অথচ এই গুগল, সিরি—এগুলো আমাদের মতোই মানুষের ভিন্ন ও উন্নত চিন্তা ভাবনার ফসল।

বাগানে একটি আপেলগাছের নিচে বসে ভাবছিলেন এক বিজ্ঞানী। হঠাৎ করেই একটা আপেল টুপ করে পড়ল সেই বিজ্ঞানীর পায়ের কাছে। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথায় জাগল প্রশ্ন, আপেলটা নিচে পড়ল কেন? অন্য কোনো দিকে, অর্থাৎ ওপর দিকেও তো যেতে পারত!

এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিল যুগান্তকারী এক তত্ত্ব। জন্ম নিল মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের। এই গল্প কিন্তু সবার জানা। তবে শুধু গল্পটাই নয়, স্কুলপড়ুয়া প্রায় সব ছেলেমেয়েই জানে সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম—আইজ্যাক নিউটন।

তাই প্রশ্ন করার অভ্যাস জাগিয়ে তুলুন। অন্যরা কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। এমএসএফে কাজ করার সময় প্রতি মাসে আমাদের অনেক মিটিং অ্যাটেন্ড করতে হতো। মিটিং শেষে বিদেশি প্রজেক্ট ম্যানেজাররা জিজ্ঞাসা করতেন, আপনাদের কারও কোনো প্রশ্ন আছে? একমাত্র আমিই সব সময় দাঁড়াতাম এবং প্রশ্ন করতাম আর সবার হাসির পাত্র হতাম। অনেকেই বলত কারও কোনো প্রশ্ন না থাকলেও সাঈদের একটা প্রশ্ন থাকবেই। এমনকি ম্যানেজাররা বলতেন, আমি জানি তোমার কাছে থেকে প্রশ্ন আসবে। আমি এগুলো কখনো তোয়াক্কা করতাম। কিন্তু আমার প্রশ্নগুলোর কারণে অনেক সমস্যার সমাধান হতো। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, He who asks questions remains a fool for five minutes, but he who does not ask, remains a fool forever.

৫: ডিজিটাল সম্পর্ক

স্মার্টফোন হাতে নিয়ে লাইফ স্মার্ট করতে গিয়ে পারিবারিক জীবনে আনস্মার্ট হয়ে যাচ্ছি। কোথায় বেড়ালাম, কোথায় খেলাম, সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট, এরপর অপেক্ষা কখন লাইক আসে, কখন কমেন্ট আসে। দিন শেষে কাউন্ট করি কী পরিমাণ লাইক, শেয়ার, কমেন্ট হয়েছে। থামুন। এটা জীবন নয়। মেসেঞ্জারে রাতের পর রাত জেগে চ্যাট করে রিলেশনশিপ তৈরি, এরপর নেট দুনিয়ায় ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারকের খপ্পরে পড়া এখন আর নতুন কিছু নয়। আমাদের মোবাইল ফোন অন্যের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল রিলেশন যতই কাছে করুক না কেন, কাছের মানুষকে দিনের পর দিন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

একটা কথা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, লাইভ ইন্টারঅ্যাকশন কেবল আমাদের কথাবার্তার দক্ষতাই নয়, সামগ্রিকভাবে আমাদের ব্যক্তিত্বকেও উন্নত করে। এ ছাড়া, চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটা প্রমাণিত যে লাইভ ইন্টারঅ্যাকশন নিজের দেহ ও মন–মানসিকতাকে উন্নত, সুখী ও সুষম অবস্থার দিকে পরিচালিত করে।

আপনার মোবাইল ফোন আপনাকে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ক্যামেরা, ক্যালেন্ডার, ঘড়ি ও অ্যালার্ম ঘড়ি দিয়েছে, কিন্তু এটি আপনাকে কখনো প্রকৃত বন্ধু এবং পরিবার দেবে না।

সামগ্রিকভাবে ওপরের এই ভুলগুলো আমরা যত দিন চালিয়ে যাব, তত দিন ঠিকই মনে হবে। যেদিন দেরি হয়ে যাবে, সেদিন আর শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

  • লেখা: সৈয়দ জাহেদ হোসেইন, জনস্বাস্থ্যকর্মী