দুর্নীতি রুখতে পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি

প্রতিদিন গণমাধ্যমে আমরা যেসব খবর পাই, তার একটা বড় অংশজুড়ে থাকে নেতিবাচক বা খারাপ সংবাদ, যার অধিকাংশ মনুষ্যসৃষ্ট। একটু গভীরে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, এসব মনুষ্যসৃষ্ট ঘটনার পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে মানুষের অনৈতিক কর্মকাণ্ড। আমাদের জীবনের অধিকাংশ সমস্যাই হলো দুষ্কর্মের ফসল আর এসব দুষ্কর্ম হলো দুর্নীতির ফসল।

দুর্নীতি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। অনেকেই দুর্নীতি বলতে শুধু অবৈধ বা অনৈতিক আর্থিক লেনদেনকে বোঝে; কিন্তু যা কিছু নীতির পরিপন্থী বা নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা-ই দুর্নীতি। নিজে সুবিধা না নিয়েও নিকটজনকে অপ্রাপ্য বা অনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, যোগ্যজনকে তার ন্যায্য সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করাও গুরুতর দুর্নীতি। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করাও বড় ধরনের দুর্নীতি। কারণ, দায়িত্ব পালন না করাটা নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

হত্যা, সন্ত্রাস, ঘুষ, দায়িত্বে অবহেলা, লুটতরাজ—এসব ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক ওতপ্রোত ও অবিচ্ছেদ্য। দুর্নীতির প্রভাব পড়ে প্রায় সবার ওপর। ফল পৃথিবীর অধিকাংশ সাধারণ মানুষ দুর্নীতি-অপকীর্তি পছন্দ করে না, কিন্তু প্রতিরোধও করতে পারে না। সরকার দুর্নীতি দমন করতে চাইলেও অনেক সময় সফলতা পায় না। তাহলে দুর্নীতি থেকে মুক্তির উপায় কী? পৃথিবীর অনেক দেশ এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে। এতে প্রমাণিত হয়, এটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

একটা উপায় হতে পারে, সন্দেহজনক সব মানুষের পেছনে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এত পুলিশ কোথায় পাওয়া যাবে? দেশের ১৬-১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কে সন্দেহভাজন, সেটাইবা নির্ণয় করার উপায় কী? আবার যেসব মানুষ পুলিশ প্রহরায় থাকে, তারাও খারাপ কাজে লিপ্ত হয়, এরূপ খবর গণমাধ্যমে আসে মাঝেমধ্যে। আবার যে পুলিশ সদস্য প্রহরায় থাকবেন, তিনিও তো একই সমাজে বেড়ে ওঠা মানুষ, তাঁর মধ্যেও গলদ থাকতে পারে। তাহলে প্রচলিত প্রহরার ব্যবস্থা করে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

সে জন্য আমাদের প্রয়োজন প্রত্যেকের মধ্যে সার্বক্ষণিক নৈতিক প্রহরার ব্যবস্থা করা; অর্থাৎ মানুষের মনোজগতে যদি শক্ত নৈতিকতার ভিত রচনা করতে হবে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই জাগিয়ে তুলতে হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক অতন্দ্র প্রহরী। আইনকানুন, সুশাসন-সুবিচার—এসবই মানবসৃষ্ট; মানুষের দ্বারাই সম্পন্ন বা সম্পাদিত হয়। ফলে মানুষ যদি কাঙ্ক্ষিত স্তরে পরিশুদ্ধ না হয়, তাহলে শুধু নিয়মকানুন তৈরি করে সুফল পাওয়া যাবে না। এ কারণে দেখা যায়, যেসব দেশের নাগরিকদের মধ্যে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ থাকে, সেসব দেশে দুর্নীতি বা অপরাধপ্রবণতাও কম থাকে। কিন্তু একটি দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ প্রোথিত করার উপায় কী? কাজটি যেমন সহজ নয়, তেমনি সময়সাপেক্ষও বটে। রাতারাতি ফল পাওয়ার মতো সহজ কোনো প্রক্রিয়া নেই।

দেশ-বিদেশে যারা বড় বড় অঘটন-অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অধিকাংশই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত। এরা সংখ্যায় লঘু, কিন্তু ক্ষমতায় গুরু। এসব ক্ষমতায়িত এবং শিক্ষিত মানুষেরা কোনো না কোনোভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে; সেখান থেকেই প্রাথমিক শক্তি সঞ্চয় করেছে, যা সে তার দানবে রূপান্তরিত হওয়ার কাজে ব্যবহার করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে জ্ঞান ও দক্ষতা দানের মাধ্যমে শক্তিশালী করেছে; কিন্তু সে শক্তি সঠিক পথে ব্যবহারের শক্ত নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়নি। যদি শৈশবেই মানুষের মধ্যে সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে নৈতিকতার শক্ত ভিত রচনা করা যায়, তাহলে দুর্নীতি এবং দুর্নীতিপ্রসূত অধিকাংশ সমস্যা কমে আসবে।

দুর্নীতিগ্রস্তদের অধিকাংশ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত। তাহলে কি অল্প-শিক্ষিত বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষের মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণতা নেই? অবশ্যই আছে; তবে শিক্ষা কম থাকার কারণে তারা স্বল্প ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং ব্যাপক ক্ষমতার অনৈতিক চর্চার ক্ষমতারহিত। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত ব্যক্তিরা ভালো হলে যেমন ব্যাপক ভালো কাজ করতে পারে, তেমনি তারা খারাপ হলে আবার দানবীয়রূপে ব্যাপক ধ্বংসজ্ঞ চালাতে পারে।

তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা কি নৈতিকতাবোধসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করতে পারছে না? আমাদের দুর্নীতিদানবেরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নানা স্তর পার করে এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা তাদের শক্তি দিয়েছি, কিন্তু নৈতিক সৌন্দর্য ও সততার ধারক হওয়ার শিক্ষা দিতে পারিনি।

শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করা আর মানব সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হলো শুদ্ধ ও নৈতিক আচরণ। একজন অতি গুণী মানুষও যদি নৈতিক আদর্শ বিবর্জিত হয়, তাহলে সে মানুষের শ্রদ্ধা হারায়। নৈতিক আদর্শ বিবর্জিত মানুষেরা নোংরা ক্লেদ উৎপাদন করে, মানুষের মনের গহিনে সৃষ্ট অভক্তির কারণে তার চেহারা পঙ্কিল, কদর্যরূপে উদ্ভাসিত হয়।

আমরা সবাই সহজ ও সুন্দর জীবন চাই। কিন্তু অসুন্দর মননের মানুষ দিয়ে আমরা কখনোই সুন্দর ও স্বাভাবিক সমাজ ও দেশ গড়তে পারি না। আর সমাজ ও দেশকে অসুন্দর রেখে কোনোভাবেই আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে আমরা সুন্দর করে তুলতে পারি না। অনৈতিক চর্চায় লিপ্ত ব্যক্তিরা বড় ভুলটা করে এখানেই। তারা দেশ ও সমাজকে বঞ্চিত, লুণ্ঠিত, কুক্ষিগত, দুর্গন্ধময় ও নিঃস্ব করে দিয়ে শুধু তাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে চায়, যাপন করতে চায় নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবন। এটা অনেকটা পানিতে ডুব দিয়ে গা মোছার মতো। ব্যক্তি এবং পরিবার সমাজ ও দেশের অংশ। তাই সমাজ ও দেশকে দুর্গন্ধময় রেখে নিজে পরিচ্ছন্ন, সুগন্ধিময় জীবন যাপন করা যায় না।

আমরা যদি মানুষের অভিযোগ, অসন্তোষ ও অশান্তির জায়গাগুলো একটু খতিয়ে দেখি তাহলে দেখা যাবে, মানুষের অধিকাংশ অভিযোগ ও অসন্তোষের উৎস আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত ও ক্ষমতায়িত মানুষের অনৈতিক আচরণ ও কর্মকাণ্ড। কোনো বিশেষ পেশার নাম উল্লেখ না করেই বলা যায়, আমাদের প্রায় সব পেশাজীবীই তাদের দায়িত্বে, আচরণে ও কর্মকাণ্ডে যথার্থ নৈতিকতার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না।

অনৈতিক চর্চার পারলৌকিক ক্ষতির কথা আমরা জানি। ইহজগতেও তার প্রভাব সুখকর নয়। একজন মানুষ শুধু খাওয়া-পরার অর্থ জোগাতে অনৈতিক হয়ে ওঠে না; মানুষের খাওয়া-পরার ক্ষমতা খুব সীমিত। তাহলে মানুষ অঢেল অর্থের পাহাড় কেন গড়ে? সমাজের চোখে প্রভাব ও প্রতিপত্তি দেখিয়ে নিজের সম্পর্কে অন্যের মধ্যে উঁচু ধারণা তৈরি করার নেশা এর পেছনের মূল কারণ। কিন্তু একজন অনৈতিক মানুষ অপর একজন অনৈতিক মানুষকেও পছন্দ করে না; বিশ্বাসও করে না। আর যারা নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ, তারা তো একজন অনৈতিক মানুষকে পছন্দ করতেই পারে না। এমনকি যে পরিবার-পরিজনের জন্য অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জন করে, মানুষকে হক থেকে বঞ্চিত করে, সেই পরিবার-পরিজনও মনে মনে ঠিকই তাকে অসৎ ব্যক্তির কাতারে শামিল করে। দুর্নীতির দুর্গন্ধে গড়া প্রাসাদ যত বড় আর ঝকঝকে হয়, তত বেশি তা মানুষের মনে ঘৃণা উদ্রেক করে। মালয়েশিয়া, কানাডায় আবাস গড়লে সেখানেও মানুষের ঘৃণা থেকে বাঁচা যায় না। তাহলে দিন শেষে লাভটা কোথায় যায়? এই সত্য শিক্ষার্থীদের আগেই জানানো উচিত। কারণ, তারাই আগামী দিনের চালিকাশক্তি, দেশের চালক।

তাহলে এ সর্বগ্রাসী অনৈতিক চর্চা থেকে মুক্তির উপায় কী? নৈতিকতার চর্চাকে দৈনন্দিন অভ্যাসে প্রোথিত করার কোনো উপায় কি আছে?

পরিবারে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে এবং পাঠ্যক্রমে নৈতিক শিক্ষা ও তার চর্চাকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যদি নৈতিকতা চর্চার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকে? চর্চাটা তাহলে কোন জায়গা থেকে শুরু হবে—পরিবারে না প্রতিষ্ঠানে? চাইলেই সব পরিবারকে এ কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ করা সহজ নয়। কিন্তু রাষ্ট্র চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরতদের মধ্যে সহজেই বিষয়টি ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আজ যে শিক্ষার্থী কাল সে পরিবার, সমাজ বা দেশের নেতা হবে। আজ যদি তাকে নৈতিকতার শিক্ষায় উজ্জীবিত করা যায়, তাহলে নিশ্চয় সে আগামী দিনে পরিবারে-সমাজে-কর্মক্ষেত্রে এই চর্চার স্বাক্ষর রাখবে। ফলে পাঠ্যক্রমে আজ নৈতিক চর্চা অন্তর্ভুক্ত করলে কালই আমরা তার ফল পাব না। আরও সমস্যা আছে। যে শিক্ষক নৈতিকতা শেখাবেন, তাঁর মধ্যে যদি নৈতিকতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকে, তাহলে তিনি সেটা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রোথিত করতে পারবেন না। তবে এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ফলে ইতিবাচক ফল একটা আসবেই।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সব স্তরেই শিক্ষার্থীদের বয়স ও মনন বিবেচনায় নৈতিক শিক্ষা ও চর্চাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু বইয়ের বাণীতে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, নৈতিক শিক্ষাকে বাস্তব বা প্রায়োগিক চর্চায় রূপান্তর করতে হবে। পরোপকার ও মানবহিতৈষী কাজকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শ্রেণিভেদে কাজের তালিকা থাকবে, যা শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক ক্লাসের মতো বাস্তবে চর্চা করবে এবং তার জন্য নম্বর বরাদ্দ থাকবে। প্রশ্ন আসতে পারে, নৈতিক কর্মকাণ্ড চর্চায় আবার নম্বর কেন?

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কারণে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করে, জ্ঞানচর্চা করে, তার মধ্যে পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জন অন্যতম বড় কারণ। তবে এখানে উদ্দেশ্য পরীক্ষা নয়। এটা একটা কৌশল, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও পরোপকারের চর্চার অভ্যাস প্রোথিত করা যাবে।

আমরা যদি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নৈতিকতাবোধ ও পরোপকারের আদর্শে উজ্জীবিত করতে না পারি, তাহলে আমাদের সব উন্নয়নের লক্ষ্য ব্যাহত হবে।

অনৈতিকতার চর্চা সব নষ্ট গুণের উৎস। নৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত একজন মানুষ কখনো দায়িত্বজ্ঞানহীন, অসৎ, অহংকারী ও অসদাচারী হতে পারে না। ফলে সুন্দর দেশ, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিজীবন নিশ্চিতকরণে মানুষের মধ্যে নৈতিক শিক্ষা ও সৎ গুণের বিকাশ ও চর্চার কোনো বিকল্প নেই

  • লেখক: মো. মুনিবুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়