দেশে বসে বিদেশের চাকরি
করোনাকালে আমরা ‘হোম অফিস’-এর সঙ্গে ভালোই পরিচিত হয়ে উঠেছি। তবে এরও অনেক আগে থেকে ‘অফশোর’ বা ‘রিমোট অফিস’ শব্দগুলো প্রচলিত। এর অর্থ হলো অফিসে না গিয়ে দূর থেকেই অফিসের কাজ করা। করোনাকালে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। এখন দেশে বসেও বিদেশের কাজ করছেন অনেকে। পড়ুন তাঁদের অভিজ্ঞতা।
‘চাকরি তো চাকরিই। তাই মূল বিষয়টা একই রকম। আমার অফিস যুক্তরাজ্যে। আমাদের থেকে সময় ছয় ঘণ্টা পিছিয়ে। তাই অফিস শুরু হয় বেলা দুইটায়। এটা একটা সমস্যা,’ বলেন এস এম ইব্রাহীম। ঢাকায় বসেই যুক্তরাজ্যের একটি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি।
আবার সময়ের এই পার্থক্যকে সুবিধা হিসেবেই দেখেন সৈয়দা সামারা মোরতাদা। তাঁর প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তরও যুক্তরাজ্যে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে নিজের কাজগুলো করতে পারি। দুপুরের পর শুরু করি অফিসের কাজ। এতে অনেক সুবিধা।’
করোনার মহামারিকালে হোম অফিস সম্পর্কে কমবেশি সবাই এখন জানেন। কিন্তু এরও অনেক আগে থেকে ‘অফশোর’, ‘রিমোট অফিস’ শব্দগুলো প্রচলিত। মানে হচ্ছে অফিসে গিয়ে সবাই বসে কাজ না করে দূরে বা অন্য দেশে নিজের ঘরে বসেই অফিস করা। আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠানে এমন ধরনের চাকরি রয়েছে। অফশোর বা রিমোট চাকরি বেশ আগে থেকেই প্রচলিত। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক এনজিওসহ উন্নয়ন খাত, তথ্যপ্রযুক্তি খাত ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে। নিয়মিত বা চুক্তিভিত্তিক হিসেবে কর্মীদের নিয়োগ হয়ে থাকে।
কর্মজীবী মায়েদের জন্য সুবিধা বেশি
এই তো গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা দুই বছর দেশে বসে জাতিসংঘের অফিস ফর প্রজেক্ট সার্ভিসেসের (ইউএনওপিএস) চাকরি করেছেন আসমা আফরিন হক। তাঁর পদের নাম রিজিওনাল স্পেশালিস্ট মনিটরিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স, এশিয়া। সামনে একই প্রতিষ্ঠানের একটি আঞ্চলিক পদে কাজ করতে চলে যাবেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। এরও আগে ৯ বছর দেশেই বিভিন্ন সংস্থার কার্যালয়ে কাজ করেছেন তিনি। বাসায় বসে অফিস করার অভিজ্ঞতা নিয়ে আসমা বলেন, ‘আমি একজন মা। আমি দেখেছি, কর্মজীবী মায়েদের অনেক বেশি সুবিধা দেয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। অফিস করছি, একই সঙ্গে বাচ্চারও দেখাশোনা করছি। অনলাইনে মিটিং হচ্ছে, আমি বাচ্চা কোলে নিয়ে আছি, ওরা ভিডিও কলে দেখতেও পাচ্ছে। এসব ব্যাপারে ওরা খুবই সহযোগিতা করে।’
ইউএন থেকে আসমা আফরিন হকের বাসায় অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ দিয়েছিল। সেসব ব্যবহার করে জেনেভার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিদিনের অফিস করতেন তিনি। আসমা আফরিন বলেন, নারী, বিশেষ করে কর্মজীবী মায়েদের জন্য অফশোর জব খুব সুবিধার। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোয় নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইটে চাকরিপ্রার্থীরা নিজেদের প্রোফাইল খুলতে পারেন। সেসব প্রোফাইল দেখে সাক্ষাৎকারের জন্য কখনো কখনো ডাকাও হয়। আর যখন তারা তাদের ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দেয়, তখন আবেদন করা ভালো। সংস্থাগুলোর নিয়োগ নীতিমালা ও চাহিদার সঙ্গে মিলে গেলে অফশোর চাকরি হয়ে যেতে পারে।
বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের সম্মান বেশি
যুক্তরাজ্যভিত্তিক নাউ-হেয়ার গ্রুপ লিমিটেডে ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন ঢাকার এস এম ইব্রাহীম। তাঁর অফিস উত্তরায়, নিজের বাসায়। এর আগে বাংলাদেশে সামহোয়ার ইন গ্রুপে চাকরি করেছেন। সেটা ছেড়ে ঢাকায় বসে নরওয়ের একটি প্রতিষ্ঠানে এবং তারপর ঢাকায় কম্পিউটার জগৎ লিমিটেডে চাকরি করেছেন। পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী ইব্রাহীম এখন নাউ-হেয়ার গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) অব ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৫ জন প্রকৌশলীর একটা দল চালান। দলের সদস্যরাও বিভিন্ন দেশে বসে চাকরি করছেন।
ইব্রাহীম বলেন, ‘স্বাধীনতা বেশি। সময়ের একটা সমস্যা হয়। আমাদের সবাইকে জিএমটির (গ্রিনিচ মান সময়) সঙ্গে মিলিয়ে অফিস করতে হয়। যুক্তরাজ্যে এই প্রতিষ্ঠানের ছোট একটা অফিস রয়েছে। সেখানে প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা (সিটিও) বসেন। বছরে এক-দুবার আমাদের মিটআপ হয়।’
ইব্রাহীম জানান, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ঘরে বসে বিদেশে চাকরি করার সুযোগ এখন বেশি। সফটওয়্যার ছাড়াও সৃজনশীল লেখা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ অফিসের বিভিন্ন কাজের জন্য এমন চাকরি মেলে। প্রথম তিন বছর ডেভেলপার হিসেবে চাকরি করেছেন ইব্রাহীম। তখন স্বাধীনতা বেশি ছিল। এখন দলনেতা, তাই নিজেকে সময় ব্যবস্থাপনা করতে হয় বেশি।
দেশি ও বিদেশি চাকরির মধ্যে কাজের পরিবেশের পার্থক্যের কথা বলেন এস এম ইব্রাহীম। সেখানে আবারও স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করলেন। যোগ করলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের অনেক বেশি সম্মান দেওয়া হয়। যৌক্তিক ক্ষেত্রে সিটিও আর একজন নবীন কর্মীর মতামতের সমান মূল্য দেওয়া হয়।
চাকরির জন্য নিজের বাসাতেই দরকারি যন্ত্রপাতি বসিয়ে নিয়েছেন ইব্রাহীম। একটা বড় ও একটা ছোট পর্দার মনিটর, দুটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ, ল্যাপটপ ইত্যাদি নিয়ে বাসা থেকেই তিনি প্রতিদিন অফিস করছেন বিলেতে।
নিজের মতো সময় ব্যবস্থাপনা করা যায়
২০২০ সাল থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিডিসাইডস প্রতিষ্ঠানে রিজিওনাল মুভমেন্ট সাপোর্টার পদে চাকরি করছেন সৈয়দা সামারা মোরতাদা। এর আগে ইউএন উইমেনে কাজ করেছেন ঢাকায়, অফিসে গিয়ে। শিডিসাইডস মূলত নারীদের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার আদায়ের একটি বৈশ্বিক আন্দোলন।
সামারা বলেন, ‘নিজের মতো করে সময় ব্যবস্থাপনা করতে পারি। আমার প্রধান অফিসের সঙ্গে সময়ের পার্থক্য ছয় ঘণ্টা। তাই সুবিধাই হয়। আগে কিছু হলেই অফিসে মিটিং করো, এই চাকরিতেও মিটিং করতে হয়, তবে জুমে। হয়তো সহকর্মীদের সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হচ্ছে না, তবে ভিডিও কলে বা জুম মিটিংয়ে তো সব সময়ই দেখা হচ্ছে। মনে হয়, আমার পাশেই আছে সবাই।’
সামারা যোগ করেন, ‘আমি অফিস করেও বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে পারি। নির্দিষ্ট সময় বাঁধা অফিসে সেটা সম্ভব হতো না। আমি মনে করি, অফিসের নয়টা-পাঁচটার সময়সূচি পরিবর্তন করার সময় এখন এসেছে।’
নিজের কাজ নিজের ওপর
যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপ ওয়াচকুকিংয়ে কাজ করেন চৌধুরী মো. সামি আল মুন্তাহীর। অনুষ্ঠান বা আয়োজন পরিকল্পনা করে দেয় এই স্টার্টআপ। মুন্তাহীর কাজ করেন ব্যাকএন্ড ডেভেলপার হিসেবে। চুক্তিভিত্তিক চাকরি। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি। পাঁচ দিনে ৩৫ কর্মঘণ্টা। লম্বা ছুটি নিলে সেটা অবৈতনিক।
২০১৯ সালে রেডিট ডটকম ওয়েবসাইটে ওয়াচকুকিংয়ের দেওয়া নতুন ডেভেলপার বা প্রোগ্রামারদের প্রশিক্ষণের একটি বিজ্ঞপ্তি দেখেন মুন্তাহীর। প্রশিক্ষণের পর প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ মিলবে। ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে সেখানে ছয় মাস কাজ করি, বিনা বেতনে। এরপর দেশের একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।’ ওয়াচকুকিংয়ের প্রধান নির্বাহী তখন তাঁকে চাকরির প্রস্তাব দেন। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে সেখানে যোগ দেন মুন্তাহীর।
মুন্তাহীর বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময় মেনে পাঁচ দিনে ৩৫ ঘণ্টার কাজ করলেই হলো। নিজের ঘরই এখন আমার অফিস। কাজের সময় চ্যাটিংয়েই যোগাযোগ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে।’ ঘরে বসে বিদেশে অফিস করার বড় সুবিধা কী? মুন্তাহীর জানান, নিজের কাজ নিজের ওপরই নির্ভর করে। কোনো খবরদারি নেই, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নেই। ‘কিছুদিন আগে আমি ও আমার পরিবারের সবাই করোনায় আক্রান্ত হই। নিজে একসময় সুস্থ হলেও অন্যদের যত্ন নিতে হতো। সে সময় তিন সপ্তাহ কোনো কাজ করতে পারিনি। আমার অফিস তখন খুবই সহযোগিতা করেছে,’ বলেন তিনি।
মুন্তাহীরের মতে, অফশোর চাকরি পুরোটাই ব্যবহারিক। সনদপত্রের মূল্য তেমন নেই। কাজে কতটা দক্ষ, তাই বড় কথা।
আছে খণ্ডকালীন চাকরিও
যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক জিডিপিতে (গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড) ২০০৮ সালে থেকে তথ্যপ্রযুক্তি পরামর্শক হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি করেন অমি আজাদ। জিডিপি সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থার আন্তর্জাতিক মান অর্জন বিষয়ে সহায়তা করে। ঢাকায় বসে জিডিপির পুরো আইটি সিস্টেমের দেখভাল করেন অমি ও তাঁর দল। দলের সদস্যরাও যাঁর যাঁর বাসায় বসে চাকরি করেন।
অমি বলেন, ‘করোনার আগে তো তাদের অফিসের এবং বাইরের আইটি সিস্টেমের পুরোটাই আমরা দেখতাম। করোনার পর বিভিন্ন দেশে জিডিপির প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ হয় গেল। তখন আমরা অনলাইনে সব রকমের প্রশিক্ষণ সব দেশে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিই। এ কাজে দেশি প্রতিষ্ঠান জুমশেপারের একটি সফটওয়্যারও আমরা ব্যবহার করি।’
দেশে বসে বিদেশে এমন খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগও রয়েছে অনেক। অমি জানান, লিংকডইনে তাঁর প্রোফাইল দেখে জিডিপি তাঁকে খুঁজে নিয়েছে।
এমন চাকরি করতে চাইলে
বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দূরে বসে চাকরির সুযোগ রয়েছে। তবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি), উন্নয়ন খাত, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় এ ধরনের কাজের সুযোগ বেশি।
আন্তর্জাতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে নিজের প্রোফাইল তৈরির সুযোগ থাকলে সেটি তৈরি করে রাখা ভালো।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটে রিমোট বা অফশোর চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে আবেদন করে রাখতে হবে।
এ ধরনের চাকরিতে সনদের চেয়ে কাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বেশি প্রয়োজন।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষায়িত কাজের জন্য ভেন্ডর সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ।
লিংকডইনে নিজের পেশাদারি মানের প্রোফাইল তৈরি ও তা নিয়মিত হালনাগাদ করা ভালো। পেশাজীবীদের এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অফশোর চাকরির বিজ্ঞাপনও পাওয়া যায়।