নতুন শিক্ষাক্রম কি নতুন প্রজন্মকে জ্ঞান ও চিন্তার পথ দেখাবে

একটা সমাজের সবচেয়ে সুন্দর উপাদান আসলে কী? সেটা হচ্ছে মননশীল মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মননশীল মানুষ আসলে কীভাবে তৈরি হয়? তারা কি আকাশ থেকে ভেসে আসে? অথবা তাদের কি কিনতে পাওয়া যায়? মননশীল মানুষ আসলে সমাজের জন্য তৈরি করতে হয়। মানুষের প্রথম শিক্ষাজীবন, বিশেষ করে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি তার পরবর্তী জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সময় তার চিন্তার ভিত তৈরি হয়, আর এর দায়িত্ব সম্পূর্ণ সমাজের। মা–বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধব—কারোরই নয়, আর এ জন্যই সমাজকে ঘিরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
যেমন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঠিক এমনই একটা সমাজের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান।

সরকারি প্রতিষ্ঠান মানে সরকারের নয়, বরং জনগণের টাকায় জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে এ রকম প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে সমাজের চিন্তাবিদ, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিজ্ঞ মানুষেরা। যাঁরা ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতার ইগোকে বর্জন করে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শুনে ও অর্জন করে নিজেদের সিদ্ধান্তের ইগোকে পাশ কাটিয়ে জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে।

এখানে বলে রাখা ভালো, নতুন শিক্ষাক্রমের সব কটি বিষয় নিয়ে আলোকপাত এ ছোট পরিসরে করা সম্ভব নয় এবং এ মুহূর্তে এ বিষয়ে আমার প্রয়োজনীয় গবেষণা করার সময় ও সুযোগ নেই। কাজেই, আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না এবং বিজ্ঞান শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রেখে যাব, যা আসলেই চিন্তার দাবি রাখে। এ দুটি বিষয় নিয়ে বিশেষ করে কথা বলার কারণ সম্পর্কে আগেই বলেছি—একটা সমাজের চমৎকার সব মননশীল মানুষ তৈরি করতে হলে শিশুদের প্রতি যত্নের কোনো বিকল্প নেই।

যা হোক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, এ সিদ্ধান্ত দেখে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, আসলেই এ মন্ত্রণালয়ে নতুনদের নিয়ে ভাববার মতো চিন্তাবিদ রয়েছেন এবং এই শিক্ষাক্রমকে যাঁরা তৈরি করে দিয়েছেন, তাঁদের সদিচ্ছাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিষয়টি চমৎকার ও সময়োপযোগী হলেও কার্যকারিতার দিক থেকে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের অন্য সব প্রোজেক্টের মতোই হতে যাচ্ছে।

উদাহরণ দিলে জিনিসটা আরও বেশি পরিষ্কার হবে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে আমাদের শহরের বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনের নীতির সঙ্গে বাস্তব জীবনে ব্যবহার ও প্রয়োগের বিশাল তফাত এবং এর কারণও ঠিক একই। উন্নত সমাজ থেকে কপি করে আনা, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে শিক্ষা বা চর্চা দরকার, তার কোনোটিই আমাদের সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই।

যেমন ঢাকা শহরে প্রতিটি মোড়ে মোড়ে উন্নত ট্রাফিক লাইট আছে এবং এগুলো কাজও করছে। লাল বাতি জ্বলছে, হলুদ বাতি থেকে সবুজ বাতিতে যাচ্ছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, এসব বাতির ব্যবহার আমি নিজে দেশে থাকতে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়েও জানার আগ্রহ বোধ করিনি। বরং পৃথিবীর আরেক প্রান্তে গিয়ে দেশের এ বাতির ব্যবহার বুঝতে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আজ ৫০ বছরেও কোনো গবেষণা কি দেখাতে পারবে, যেখানে এক দিনের জন্য হলেও ট্র্যাফিক পুলিশ ছাড়া শুধু ট্র্যাফিক লাইট দিয়ে যান চলাচল হয়েছে।

বাংলাদেশে চমৎকার একটা পরিবেশ আইন পাস করা হয়েছে। এটা হচ্ছে আমাদের এখানকার নদীগুলো মানুষের মতো অধিকার পাবে, মানে নদীর কোনো ক্ষতি হলে যে কেউ নদীর পক্ষ হয়ে কোর্টে মামলা করতে পারবে। অল্প কিছু দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আইন তো হলো, কিন্তু আমাদের নদীগুলোর অবস্থা কী? শিশু অধিকার আইন বাংলাদেশে অনেক উন্নত দেশের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে আইনের প্রয়োগ কী বলে? নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তিন–চার মাস মানুষ তখন পলিথিন থেকে দূরে ছিল, কিন্তু তারপর ‘যেই লাউ সেই কদু’। আমাদের এই অঞ্চলে চমৎকার একটা ধর্ম আছে, যার নাম ইসলাম। প্রায় অধিকাংশ বাংলাদেশি মুসলিম।

ইসলাম ধর্মে খুব ভালোভাবে লেখা হয়েছে মিথ্যা কথা, অন্যায় থেকে দূরে থাকার কথা। যেখানে প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম এবং মুসলমান ভাই ভাই, সেখানে আমরা নির্দ্বিধায় এঁকে অন্যের সঙ্গে মিথ্যা বলে যাচ্ছি এবং মাপে কম থেকে শুরু করে ভাই ভাইকে ভেজাল খাইয়ে যাচ্ছি। আরও সহজ কথায় যদি বলতে হয়, তাহলে ধরা যাক, চমৎকার পলিসি তৈরি করা হলো, যেখানে বাংলাদেশের সব শিশুশিক্ষার্থী চিন্তাশীল হবে। পলিসি তৈরি করলেই কী হয়ে যাবে? আমরা সবাই জানি, প্ল্যান বা পরিকল্পনা আসলে কিছুই না যদি না তার পেছনে ভালো জোগান বা রিসোর্স থাকে।

তার মানে ভালো পলিসি সমাজের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না যতক্ষণ না পর্যন্ত ওই ভালো পলিসি মানার জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি হয়। পরীক্ষা বা জবাবদিহি ছাড়া কোনো সামাজিক পদ্ধতি, বিশেষ করে সরকারি কোনো কাজ প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের এ সমাজে জবাবদিহি বলে আসলে কিছুই নেই। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না, এর মানে হচ্ছে শিশুদের জবাবদিহি থেকে মুক্ত করা হবে, যা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু যে বাচ্চারা আগামীর দিনের কান্ডারি, তাদের এই খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময় বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষক নামের মানুষের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো, তাদের জবাবদিহির কাঠামো কি তৈরি করা হয়েছে?

যদি সেটা না করা হয়, তাহলে তাঁরা আসলে কীভাবে শিক্ষাকে সময়োপযোগী করবেন। এরই মধ্যে দেশে বিভিন্ন শিক্ষামাধ্যম যেমন মাদ্রাসা, কারিগরি, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম তৈরি করে শিক্ষা ও চিন্তার বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে আমরা বিভিন্ন সময়ে গুজব ও বিভিন্ন বিশ্বাসের নামে মিথ্যা ছড়িয়ে সামাজিক অশান্তি তৈরির মাধ্যমে হারে হারে টের পাচ্ছি, কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া শিক্ষকদের কোনো নির্দেশনা না দিয়ে ও তৈরি না করে এই কোমলমতি শিশুদের যদি তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে তা জাতির একধরনের সুইসাইড হবে।

কোনো নির্দেশনা ও সেই নির্দেশনার পেছনে গবেষণার উপাত্ত না থাকার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুর বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা তৈরি হবে। এতে দুটি জিনিস হবে—চিন্তার ব্যবধান আকাশ-পাতাল হবে এবং সমাজে আরও ভালোভাবে প্রমাণিত হবে যে টাকা বা অর্থই আসল। এতে রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা লোপ পাবে। কারণ, যেহেতু পরীক্ষা নেই ও তার সঙ্গে কোনো নির্দেশনা নেই যে এই তিন বছর শিশুদের কী কী শেখানো হবে, সেহেতু মা–বাবারা আরও ভয়ংকর প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি শুরু করবেন। তাঁরা একরকম ঘরেই স্কুল খুলে বসবেন বিভিন্ন প্রাইভেট টিউটর দিয়ে।

এগুলো বোঝার জন্য বড় কিছু হওয়া লাগে না। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে সহজেই এগুলো অনুমান করা সম্ভব। যেমন আমাদের দেশের সাধারণ ব্যবসায়ী মানুষেরা কেন এত লোভী? কেন তাঁরা অন্যকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা অর্জন করেন? কারণ, রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তার অভাব।

তাঁরা মনে করেন, যদি অর্থ না থাকে, তাহলে শেষ সময়ে কেউ দেখবে না অথবা খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা তাঁরা পাবেন না। এক অর্থে এসব মানুষের আসলে সেইভাবে দোষ নেই, বরং আমরা রাষ্ট্র গঠনে মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এবার এভাবে যদি বাচ্চাদের পড়াশোনা দিকের তাকান, তাহলে শহরের সামর্থ্যবান ১০টি পরিবারের মধ্যে আমি বলব ৯টি পরিবারই চায় সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে। কিন্তু এই ১০টি পরিবারের কারোরই শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা নেই।

এ জন্যই কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাচ্চাদের মাসিক বেতন দেশের ফার্স্ট ক্লাস অফিসারের (চাকরির শুরুর সময়ের বেতন) থেকে বেশি। এই পরিবারগুলো জানে শুধু রেজাল্ট বা পরীক্ষার ফলাফল। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৈরি শিক্ষাক্রম কি এক রাতে তাঁদের মানসিকতা পরিবর্তন করে দেবে? কখনোই নয়, বরং তাঁরা তাঁদের নিয়মের বাইরে চিন্তা করতে পারবেন না। ফলে লোভী ব্যবসায়ীর মতো জীবন নিশ্চিত করার জন্য আরও শিক্ষক দিয়ে সন্তানদের আরও প্রতিযোগী করে তুলবে। অন্যদিকে গ্রাম বা অনুন্নত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অথই সমুদ্রে পড়বে। শিক্ষাবৈষম্য বাড়বে চরমভাবে। প্রাইভেট সেক্টর শিক্ষানৈতিকতাকে গ্রাস করবে। লোভী ধনী ব্যবসায়ীরা শিক্ষা বিক্রি করা শুরু করবে। রাষ্ট্র তার পবিত্রতা হারাবে।

যা হোক, এ নিয়ে লিখলে পাতার পর পাতা লিখতে হবে। যেহেতু সেই সুযোগ এখানে নেই, কাজেই ছোট করে কিছু পরামর্শ রেখে যাচ্ছি। পুরো দেশজুড়ে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত আটটি জিনিস থাকা অত্যাবশ্যক।

১.

রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার অধিকার সমান এবং তা নিশ্চিত করা: সবাইকে ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ–নির্বিশেষে এলাকা অনুযায়ী একই স্কুলে ভর্তি হতে হবে বাধ্যতামূলক। এতে সমাজে ছোট বয়সেই বিচ্ছিন্নতা বা বৈষম্য শেখানো হবে না। যেহেতু পরীক্ষা নেই, তার মানে জীবন ও সমাজ বোঝা হবে প্রথম অগ্রাধিকার। পরবর্তীকালে এলাকার স্কুলের ছাড়পত্রের ওপর ভিত্তি করে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করা হবে।

২.

প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে তাদের জন্য আলাদা শিক্ষা সেল অথবা তত্ত্বাবধায়ন তৈরি করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এ–জাতীয় কমিটি গঠিত হবে চিন্তাবিদ, প্রবীণ ও নবীন শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে। তাদের সিদ্ধান্ত হবে পাবলিকলি এবং সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গবেষণা হতে হবে প্রধান চালিকা শক্তি। যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে তাদের তা জাতীয় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে জনগণকে বোঝাতে হবে।

তারপর আলোচনা ও যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ৬ মাস অন্তর অন্তর তাদের কাজের অডিট হবে এবং প্রতিবছর শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের ভোটের মাধ্যমে নতুন কমিটি বাছাই করতে হবে। এসব লোকদের কোনো বয়সের ধরাবাঁধা নিয়ম থাকবে না এবং তাঁদের বেতন যদি কোটি টাকা হয়, তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু জবাবদিহি থাকতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিটি স্তরে। আমলা বা রাজনীতি থেকে তাঁরা মুক্ত থাকবেন। শুধু যুক্তি ও বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে তাঁদের পলিসি গ্রহণ করা হবে।

৩.

বাচ্চাদের প্রতিটি স্কুলের গভর্নিং বোর্ড থাকবে এলাকার ধর্মীয় চিন্তাবিদ, শিল্পী, লেখক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে। তাঁদের সমন্বয় করবেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী কেউ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক অথবা কলেজের কোনো প্রভাষক।

তাঁদের প্রত্যেকেরই শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে আর এ রকম না পাওয়া গেলে ওই স্কুলের সবচেয়ে মানবিক শিক্ষককে ট্রেনিং দিয়ে বোর্ডের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দিতে হবে, যা দুই বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করতে হবে।

৪.

শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য জাতীয় ক্যাম্পিং আয়োজন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা ভালো ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে শিক্ষক বাছাই করা যেতে পারে। তাঁদের বেতন একজন ফার্স্ট ক্লাস অফিসারের থেকে কম হবে না, বরং এক টাকা হলেও বেশি হবে। তবে তাঁদের কাজ পারমানেন্ট না হয়ে বরং কার্যক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।

৫.

যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে নিজ এলাকার কর্মজীবী মানুষ, ধর্মীয় উপাসনালয় (মসজিদ, মন্দির, গির্জা ইত্যাদি), শহর বা গ্রাম, গান, কবিতা, সিনেমা, জীবনযাপনের পদ্ধতি, পুলিশ, ট্রাফিক প্রভৃতির সঙ্গে বাচ্চাদের হাতে–কলমে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখতে হবে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের সংস্পর্শে এসে আরও বেশি মানবিক হবে জনগণকে সেবা প্রদানে। সপ্তাহে এক দিন শিক্ষকেরা বের হবেন বাচ্চাদের নিয়ে নিজ এলাকা পরিদর্শনে এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মাধ্যমে জীবন ও সমাজকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। এসব কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভলান্টিয়ার হওয়ার সুযোগ রাখতে হবে।

৬.

প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে পাবলিক স্পেসে চলাফেরার সময় ক্যামেরা দিয়ে মনিটর করতে হবে তাদের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে।

৭.

তারা যে সমাজের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা প্রমাণ রাখার জন্য তিন মাসে এক দিন যেদিন তারা বের হবে মিউজিয়াম অথবা দর্শনীয় স্থান অথবা সরকারি–বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান ভ্রমণে, সেদিন ইউনিয়ন বা শহরের মেয়রের অফিস তাদের ভিআইপি করে সেসব স্থানে পৌঁছে দেবে এবং খাবার থেকে শুরু করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।

৮.

প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একই রকম শিক্ষার সিলেবাস ও কর্মকাণ্ড অনুসরণ করতে হবে, যা মূলত ধর্ম, সমাজ, শিল্প-সংস্কৃতির সমন্বয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের কৃষকের সঙ্গে পরিচয় হবে প্রথম অগ্রাধিকার। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হতে হবে বিজ্ঞানকে বোঝা। দেশের সব রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি বিজ্ঞান গবেষণা তাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং প্রতি মাসে তাদের মতো করে বোঝানোর জন্য একটা বিজ্ঞানভিত্তিক সেমিনার থাকতে পারে। তৃতীয় বিষয়টি হওয়া উচিত ভাষা ও অঙ্ক।

সবশেষে ‘কোনো শিক্ষার্থীর বয়স ১২ বছর পূর্ণ না হলে এবং ১৮ বছরের বেশি হলে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবে না। এ বিষয় মাথায় রেখে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন করার কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।’ বয়স বেঁধে দেওয়ার যে নিয়ম করা হয়েছে, তা আসলে জনগণকে আলো থেকে বঞ্চিত করবে। কুসংস্কার আরও বাড়বে।

শেখার কি আদৌ কোনো বয়স আছে? রাষ্ট্র যদি এ রকম বয়স বেঁধে দেয় যে এত বছর হয়ে গেলে আর শিক্ষা অর্জন করা যাবে না, সেটা আবার ২০ বছরের মধ্যে। ৬০-৭০ হলেও একটা কথা ছিল। এ বয়সে যদি তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র চায় তার জনগণ শিক্ষিত না হয়ে শ্রমিক হোক। এ বিষয়ে তীব্র নিন্দা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখনই বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রমিকের দেশ আর এই নিয়মে চললে ১০ বছরের মধ্যে আমাদের দেশ পৃথিবীর অন্যতম শ্রমিকের কারখানা হবে।

এসব বাস্তবায়নে যদি পদ্মা সেতুর তিন গুণ খরচ গুনতে হয়, তাহলে সেটাই হবে জাতি গঠনের সবচেয়ে উপযুক্ত বাস্তবায়ন। আমার বিশ্বাস, আমাদের মন্ত্রণালয় ও সরকার দলীয় সংগঠনে চমৎকার সব চিন্তাশীল মানুষ আছেন। নিয়ম তৈরি করা হয় ভাঙার জন্য। তাঁরা আরেকটু চিন্তাশীল ও মানবিক হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে ভেবে দেখবেন। যুক্তিসংগত হলে নিয়ম পরিবর্তন করবেন, এ আশাই করছি।

নুরুজ্জামান খান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক, হাঙ্গেরিয়ান ফাইন আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা