বিচারের বাণী আর কত কাঁদবে?

প্রতীকী ছবি

‘হত্যার হুমকি দিয়ে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ’—গত ২৪ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংবাদের শিরোনাম। না চাইলেও নিয়মিত এমন সংবাদ দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখ-মন। আমরা জানি, ঘটনার আদলগুলো একই রকম। তারপরও পত্রিকার পাতা কাছে টেনে ধরি। মনোযোগ দিয়ে কিশোরীদের কষ্টের কথা পড়ি। এই মহামারির সময় মানুষ যেখানে নিরাপদ জীবনের কথা ভেবে জীবনযাপন নিয়ে চিন্তা করছে, সেখানে অপরাধারীরা সেই আগের মতোই।

মহামারির এই সময়েও েগল এপ্রিল মাসে দেশে ৩৭১টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ১৩৭টি। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯ জন। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) ১ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি এসব তথ্য জানায়।

২৪ এপ্রিল প্রথম আলোর ওই সংবাদের ঘটনাটি হলো গাজীপুরের কালীগঞ্জে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৪) হত্যার হুমকি দিয়ে গত দেড় বছর যাবৎ ধর্ষণ করে আসছিলেন নুরুল ইসলাম নামের তারই এক পরিচিতজন। ধর্ষণে রাজি না হলে কিশোরী এবং তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে লাশ গুম করা হবে, এই ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে ফাঁদে ফেলেন তিনি। ১৫ এপ্রিল রাতে কিশোরীর ঘরে প্রবেশ করলেই চিৎকার দিয়ে ওঠে কিশোরী। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আইনের আশ্রয় নেয় মেয়েটির পরিবার। এই সংবাদের শেষ লাইনে দেখতে পাই নুরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।

একই সংবাদের পরের অংশ হলো রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রীকে (১৩) অপহরণের পর দুই দিন আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ। এই সংবাদের শেষ লাইনটিতেও খেয়াল করলাম, আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে পুলিশ।

পুলিশের অভিযান চলছে, গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে, এই দুটি তথ্য কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না আসলে গাফিলতিটা কোন জায়গায়? মানুষ নিরুপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নেয়। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচ-দীর্ঘসূত্রতায় তারা হাল ছেড়ে দেয়। অপরাধীরা আবার দাপিয়ে বেড়ায়। এমন অপরাধ সমাজে তখন আবার নিয়মিত ঘটতে থাকে।

আমরা যদি একটু ফিরে দেখি, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইলের সখীপুরে নবম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আরও কয়েকবার ধর্ষণ করা হয়েছে। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে ঘটনা প্রকাশ পায়।

২০২০ সালের জুলাই মাসে ঢাকার দোহার উপজেলায় হত্যার ভয় দেখিয়ে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে একাধিকবার ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল স্থানীয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ৮ এপ্রিল সিলেটের জকিগঞ্জে দশম শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ছাত্রীর এলাকার প্রভাবশালীর ছেলে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চাপ ছিল পরিবারে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য পরিবারটি বাধ্য হয় তাদের মেয়েকে সিলেট এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি করাতে।

কতটা অসহায় আমাদের কিশোরীরা। তাদের পরিবারের সদস্যরা। নাড়িছেঁড়া ধনটিকে তুলে নিয়ে যাবে, ধর্ষণ করে রক্তাক্ত করবে কিন্তু মানসম্মান, প্রভাবশালীর চাপের মুখে ঘটনা ধামাচাপা দিতে হবে পরিবারকে। নীরবে সয়ে যেতে হবে ভুক্তভোগী কিশোরীকে। নিজেকে গুটিয়ে, নিজ অস্তিত্বকে নিয়ে সদা ভয়ে-আতঙ্কে থেকে একজন কিশোরী তার জীবন টেনে নিয়ে যায়। মনের দিক থেকে সে আর কখনো আতঙ্কহীন হতে পারে না। যুগ যুগ ধরে তাই তো দেখে আসছি। কিন্তু সেই ধারা কি অব্যাহত থাকবে? নাকি সমাজের-রাষ্ট্রের এটিও একটি স্বাভাবিক ধারা হিসেবে চলমান থাকবে? বছরব্যাপী দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনাগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায়টা কী?

সামাজিক মূল্যবোধের সমাধানটি মনে উঁকি দিলেও প্রধান যে সমাধান তা হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ। একমাত্র এর মাধ্যমেই কলুষিত ঘটনাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কীভাবে পরিবারগুলো আইনের আশ্রয় নেবে, বিচারের জন্য দাঁড়াবে, তার পরামর্শ দেন জাতীয় মানবাধিকার সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী।

সালমা আলী বলেন, এই মামলাগুলোতে দেখা যায় দীর্ঘসূত্রতা। ধর্ষণের শিকার পরিবারগুলো বিচারের জন্য আসতে দেরি করে। এলেও আলামত-প্রমাণের মারপ্যাঁচে পড়ে যান। নিপীড়নের শিকার মেয়েটি এবং তার পরিবার কোণঠাসা হয়ে থাকে। অপরাধীরা ঠিকই ঘুরে বেড়ায় এবং নিপীড়িত পরিবারকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে থাকে।

এই আইনজীবী মনে করেন, দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণ মামলার শাস্তি দিতে হবে। যে আইনের প্রয়োগ হবে না, শুধু ভয় দেখানোর জন্য—এমন আইন দরকার নেই।আইনের পাশাপাশি বাস্তবায়নযোগ্য বিধিবিধান করতে হবে। সরকার চাইলেই দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে।