রোকেয়ার হাত ধরে এগিয়ে চলেছে নারীশিক্ষা

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের সূচনালগ্নে নারীশিক্ষা, নারী জাগরণ, নারীর স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার পক্ষেÿপ্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। মুসলমান সমাজের অনগ্রসর যুগে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল একক, ব্যতিক্রমী ও অনন্যসাধারণ। অনতিদীর্ঘ জীবনের সবটুকু তিনি উৎসর্গ করেছেন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি ও সাহিত্যসাধনায়।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহিরউদ্দীন মোহাম্মদ আবু সাবের মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে রক্ষণশীল ছিলেন। এ ছাড়া তিনি যে সামাজিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন, সেখানে মুসলমান মেয়েদের গৃহের অর্গলমুক্ত হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানীর সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন ইংরেজ শিক্ষয়িত্রীর কাছে কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের ভ্রুকুটির জন্য তা-ও বন্ধ করে দিতে হয়। পরবর্তী সময়ে বড় ভাইবোনদের সমর্থন ও সহায়তায় বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। ১৮৯৮ সালে ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় বিহারের ভাগলপুর নিবাসী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন স্বামীর সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয় এবং সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে।

রোকেয়ার সমগ্র সাহিত্যকর্মে সমকালীন সমাজের কুসংস্কার, অবরোধ প্রথা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের কুফল, নারীর অধিকার ও নারী জাগরণ সম্পর্কে তাঁর প্রাগ্রসর ধ্যানধারণা, নারীশিক্ষার পক্ষেÿতাঁর নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন দেখা যায়।

পুরুষশাসিত সমাজে নারীর দুরবস্থা এবং দৈহিক, মানসিক জড়ত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় যে শিক্ষা, বিষয়টি তিনি তাঁর বিভিন্ন রচনায় তীক্ষ্ণ ভাষায় ও তির্যক ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। বাংলায় মুসলমান নারীদের শিক্ষার প্রচলিত ব্যবস্থা সম্পর্কে রোকেয়া দুঃখ করে ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বলেন, ‘আমাদের জন্য এ দেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ—প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কোরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না। কেবল স্মরণ শক্তির সাহায্যে টিয়া পাখির মতো আবৃত্তি করা। বঙ্গ দেশেও বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরম সীমা সলমা চুমকির কারুকার্য উলের জুতো-মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।’

পাশাপাশি রোকেয়া এই অভিযোগ করেছেন যে মুসলমান সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন ভঙ্গ করে নারীকে পার্থিব ও অপার্থিব সব সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তৎকালীন সমাজের ঔদাসীন্যের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারগুলোও রোকেয়াকে বিচলিত করে।
সমসাময়িককালে নারীসমাজের শিক্ষালাভের সুযোগের অভাব রোকেয়াকে ব্যথিত করেছে। তাই আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘আমাদের শয়নকক্ষেÿযেমন সূর্য্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রূপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ একপ্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারেন—কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরূপ সুধাভান্ডারের দ্বার কখনও সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত হইবে কি?’

অশিক্ষা ও অজ্ঞানতাকে বেগম রোকেয়া নারীসমাজের পরাধীন অবস্থার জন্য দায়ী করে বলেন, ‘শিক্ষার অভাবে আমরা স্বাধীনতা লাভের অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত রাখিতেন। এখন দূরদর্শী ভ্রাতাগণ বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ইহাতে তাঁহাদের ক্ষতি ও অবনতি হইতেছে।’ তিনি অলংকারের টাকা দিয়ে নারীদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। যোগ্য অর্ধাঙ্গী, দাম্পত্য জীবনের সুসমন্বয়, সুগৃহিণী হওয়া এবং সুপুত্র গঠনের জন্যও নারীশিক্ষা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে ‘সুগৃহিণী’ প্রবন্ধ লিখেছেন। সুসন্তান গঠনেও স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা এবং জীবনাদর্শে অসাম্প্রদায়িকতা ছিল রোকেয়ার অভীষ্ট। তাই তাঁর দীপ্ত উচ্চারণ, ‘শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। ঈশ্বর স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়াছেন সেইÿক্ষমতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা। ঐ গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যবহার করা দোষ।”

এ ছাড়া শিক্ষার উদ্দেশ্য ও আদর্শসম্পর্কিত আরও কিছু রচনায় তিনি প্রাচীন ও আধুনিক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষানীতির সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। রোকেয়ার ইংরেজি রচনা, ‘Educational Ideals for Modern Indian girl’-এ তিনি মহাভারতের গুরুগৃহ থেকে শুরু করে আধুনিক আবাসিক বিদ্যালয়সমূহের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন। এই রচনায় তাঁর শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা, দূরদৃষ্টি ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় সুস্পষ্ট। রোকেয়ার পরিকল্পিত স্ত্রীশিক্ষার সিলেবাসেও নানাবিধ বিষয় (শিশুপালন, পুষ্টিবিজ্ঞান, উত্তাপতত্ত্ব, উদ্যান পরিচর্যা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান, সংগীত, চিত্রশিল্প) স্থান লাভ করেছে। এমনকি ‘সুলতানার স্বপ্ন’তে তিনি সমরবিদ্যা এবং সৌরশক্তির ব্যবহারে নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শি‌ক্ষিকা এবং ছাত্রীদের অভূতপূর্ব সাফল্যের বিবরণ দিয়েছেন।

রোকেয়া দেখেছিলেন বাঙালি নারীর যাবতীয় দৈন্য ও দুর্গতির একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষার প্রতি ঔদাস্য। তাঁর এই উপলব্ধি থেকেই দুর্দশা মোচনের উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। তবে এ জন্য তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল স্বার্থান্ধ সমাজের নির্মম নিন্দা ও সমালোচনা। ‘যুবতী বিধবা স্কুল স্থাপন করে রূপ-যৌবনের বিজ্ঞাপন প্রচার করছেন’—এমন কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার হয়েছিল রোকেয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো বাধা-বিরোধিতাই তাঁকে অবদমিত করতে পারেনি।

অন্ধকার পথে তিনি একাই চলেছিলেন আলোকশিখা হাতে নিয়ে। তিনি হাসিমুখে বলতেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেন নিন্দা গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুতে তাহাকে আঘাত করিতে না পারে, মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে।’ বিরূপ সমালোচনা এবং নানাবিধ সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে সে যুগের মুসলমান মেয়েদের শিক্ষালাভের অন্যতম পীঠস্থানে পরিণত করেন।

প্রকৃতপক্ষে রোকেয়ার কাছে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল শুধু একটি বিদ্যালয় ছিল না, এটা ছিল বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের সূতিকাগার। নারী জাগরণের মূল বিষয় যে শিক্ষা, তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি দুই দশকের বেশি সময় ধরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলকে একটি আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে উন্নীত করতে অক্লান্তভাবে কাজ করেছেন। রোকেয়া আজীবন নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, তার সফলতার নিদর্শনও রোকেয়ার জীবনকালে লক্ষণীয়। তিনি ১৯২৮ সালে একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘এখন মুসলমান সমাজ বুঝিয়াছেন, স্ত্রী শিক্ষা ব্যতীত এ অধঃপতিত সমাজের উন্নতির আশা নাই। তাই তাঁহারা আর শুধু ভ্রাতৃসমাজ লইয়াই ব্যস্ত নহেন। চতুর্দিকে স্ত্রী শিক্ষার আলোচনা হইতেছে ও জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হইতেছে।’

বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের ইতিহাসে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এক অনন্য ও অবিস্মরণীয় নাম। বাঙালি মুসলিম নারীসমাজকে তিনি হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন নতুন আলোর পথে। রোকেয়া দিবসে নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং আলোর দিশারি এই মহীয়সী নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়