শিক্ষকদের আজ এ অবস্থা কেন

শিক্ষক হেনস্তা ও হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধনে এক শিক্ষার্থী। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে
ছবি: সাজিদ হোসেন

শিক্ষকেরা আজ নিরাপদ নয় কেন? কারণ, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যখন যা খুশি করতে পারে এখন। বর্তমান সমাজ সেই গতিতে চলমান। এখান থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে হবে। যে জাতি শিক্ষকদের সঠিক সম্মান দিতে পারবে না, সে জাতি তার উন্নয়নকে টেকসই করতে পারবে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সংবাদপত্র পড়তে গেলে দেখতে পাই, দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকেরা নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।

শিক্ষকেরা ক্লাসে পড়াতে গেলে বা পরীক্ষা নিতে গেলে তাঁরা আজ নিরাপদ নন। কারণ, পরীক্ষার হলে নকল করতে দিতে হবে। নকল করতে না দিলে না সমস্যা। থ্রেড খেতে হবে বা শিক্ষকের অফিস রুম ভাঙবে। আবার কিছু ছাত্র মেডিকেলে গিয়ে পরীক্ষা দেবে। কারণ, ওখানে নকল করে পরীক্ষা দিতে পারবে। তারা আবার ছাত্ররাজনীতি করে। ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

সম্প্রতি তিনটি ঘটনা আমাদের ভীষণভাবে ভাবাচ্ছে, আমরা কোন দেশে বাস করি? শিক্ষকেরা আজ তাঁদের প্রাপ্ত সম্মানটুকু পাচ্ছেন না। সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা এবং নড়াইলে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ ছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের জমি দখল করে নিয়েছে অন্যরা। ওই শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি ১৮ বছর ধরে কোর্টের বারান্দায় ঘুরছেন। কিন্তু রায় হওয়ার পর এখনো জমি ফেরত পাননি। যিনি শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয় জমি উদ্ধারের জন্য। তাহলে এ দেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ কীভাবে গড়ে উঠবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ছাড়া দেশের টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করার জন্য এ ধরনের সামাজিক অবক্ষয় বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে। আজ রাষ্ট্রে শিক্ষকদের সম্মান তুচ্ছ। কারণ, তাঁদের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। এভাবে সমাজ চলতে পারে না।

প্রতিটি ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ করছি। দ্রুত এসব ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের আইনের আওতায় এনে কঠোর বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। যে বিচার হবে দৃষ্টান্তমূলক, যা দেখে আর কেউ যেন শিক্ষকের গায়ে হাত না দিতে পারে। এই শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষকেরা নিরাপত্তাহীন হয়ে যাবেন। এ রকম হত্যাকাণ্ড হতে পারে কি? শিক্ষার্থীর আঘাতে শিক্ষকের মৃত্যু, যা খুবই মর্মান্তিক।

এখনো আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছেন না কেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদিও তাঁর বাবা গ্রেপ্তার হয়েছেন। অপরাধীর বাবার নাকি অনেক টাকা, সে জন্য অনেকে শঙ্কায় রয়েছেন, বিচার হবে কি না। এ ধরনের অমানুষ ক্ষমতাধর মা-বাবারা সমাজে এখন অজস্র। সরকার কর্তৃক স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাঁরা ব্যবহার করতে চান। যদি দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হয়, সারা দেশের শিক্ষকসমাজ প্রতিবাদ করতে মাঠে নামবে। শিক্ষক উৎপলের হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা হয়েছে। এর প্রয়োজন কেন? প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এ দেশে কোনো কিছুর জন্য আন্দোলন না করলে সফল বা সঠিক বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছে, রাষ্ট্র ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে—এটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু আমাদের প্রতিবাদ করে বিচার দাবি করতে হবে। এর জন্য সমাজে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। নড়াইলের কলেজশিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সম্মুখে, তাঁরা কী করেছেন? তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ, তাঁরা থাকা সত্ত্বে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। সমাজে দিন দিন অবক্ষয় বেড়ে চলছে। এই সামাজিক অবক্ষয় যদি আমরা রোধ করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এ ঘটনায় আমাদের ভেতরে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা মিটবে কীভাবে। এ রক্তক্ষরণ বন্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা সভ্যতার চরম অন্ধকার সমাজে বসবাস করছি। এখানে একজন শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষক খুন হওয়ার চিত্র দেখতে হচ্ছে, যা শুধু একটি সাধারণ অপরাধ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এ ঘটনার বিচারের মাধ্যমে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে এসব অপকর্ম বা অপরাধ চিরতরে বন্ধ হয়। জাতির কারিগর শিক্ষককে যে বা যাঁরা শারীরিকভাবে আঘাত করতে পারেন, তাঁদের পক্ষে যেকোনো ধরনের নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব। তাই আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। এ কথা সত্য, শিক্ষকেরা ফেরেশতা নন। তাঁরাও অপরাধে জড়িত হয়ে পড়তে পারেন। যে শিক্ষকেরা অপরাধে জড়িত থাকবেন, তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ