শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিগগিরই খুলে দেওয়া জরুরি

ফাইল ছবি

স্কুল-কলেজ এখনই খুলছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান সাধারণ ছুটি ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। তবে করোনার সংক্রমণ যেহেতু এখন কমতির দিকে, মনে হচ্ছে করোনার এই ঢেউ শেষ পর্যায়ে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার কারণে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের আশঙ্কা। কারণ, ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে থাকতে থাকতে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে, শিক্ষার্থীরা নানাভাবে তাদের জীবন নিয়ে চিন্তিত। সরকার বলছে, সংক্রমণের হার যদি ৫% হয় এবং সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা যায়, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে দুটির কোনোটিই ওই পর্যায়ে নেই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

কিন্তু এভাবে বন্ধ থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ থেকে যায়। যদিও ক্ষতি কাটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। তবে তা বাস্তবে কতটুকু কাজে আসে, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকতে হবে। আমার প্রশ্ন হলো, সবকিছুই যখন স্বাভাবিকভাবে চলছে, কোথাও কোনো সমস্যা নেই বলে মনে হচ্ছে, তাহলে করোনা কি শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে? সরকারপ্রধান বলার পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হচ্ছে। কেন খুলছে না? ধারণা করা হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। এ বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কপালে কী রয়েছে কে জানে! কারণ, তাদের পরীক্ষা নিয়ে সঠিক কোনো রুটিন এখনো প্রকাশ পায়নি। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা আছে, এ বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি এসএসসি ও ডিসেম্বরের শুরুতে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে।

গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।

ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড ১৯-এর কারণে বাংলাদেশে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একাধিক শিফট করে, দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস, পরীক্ষা সবই নেওয়া সম্ভব ছিল। দরকার ছিল সঠিক পরিকল্পনার। কিন্তু তা হয়নি। অনলাইন বা মডিউলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। অনেক শিক্ষার্থীর উপযুক্ত যন্ত্র নেই। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের সংযোগ নেই, থাকলেও বিদ্যুৎ ঠিকমতো থাকে না। তাই অনলাইন শিক্ষা সব পর্যায়ে তেমন কার্যকর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা কার্যকর। অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতির সংখ্যা শতভাগ পাওয়া যায় না। তাই সরাসরি ক্লাস নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।

গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থীরা এবং কম আয়ের পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে। কারণ, তাদের কোনো যন্ত্র নেই, তারা কোনো রকম অনলাইন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এ ছাড়া করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার প্রভাব পড়বে আমাদের নানা খাতে। মা, কবে স্কুল খুলবে?—এ জাতীয় প্রশ্ন প্রত্যেক অভিভাবককে শুনতে হচ্ছে। কিন্তু এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর তাঁরা দিতে পারেন না। সরকার অনেকবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও দেশে মহামারি পরিস্থিতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। বরং দফায় দফায় বন্ধ থাকার মেয়াদ বেড়েছে। দফায় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর কারণে সবার মনে হচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি কোনোভাবেই কাঠিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। তাই আর দেরি না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াই ভালো। যদি পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়, তখন প্রয়োজন হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। এটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা।

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘরবন্দী থাকতে থাকতে শিশুরা মুঠোফোন ও অন্তর্জালের মাধ্যমে খারাপ কাজে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মুঠোফোন বা টিভি নিয়ে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এতে তারা একগুঁয়ে হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে। শিশুদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। তাদের মুঠোফোন বা টেলিভিশনে কার্টুন দেখতে না দিলে তারা ঘরের মধ্যে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যার ফলে মা-বাবারা বাধ্য হয়ে তাদের শান্ত করতে হাতে বিভিন্ন যন্ত্র তুলে দিচ্ছেন। অবশ্য বর্তমানে বিভিন্ন পার্ক এবং বিনোদনকেন্দ্র খুলে দেওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের সেখানে নিয়ে যেতে পারছেন। একটু স্বস্তি মিলছে এখন। স্কুল শিশুকে শুধু লেখাপড়াই শেখায় না, বরং সমাজের নানান দিক সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, যা তাদের পরিপূর্ণ মানুষ হতে সহযোগিতা করে থাকে। করোনার কারণে অন্য শিশুদের সঙ্গে মেশার সুযোগ পাচ্ছে না বিধায় দিন দিন শিশুরা অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে।

লকডাউনের সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় গেম খেলায় ব্যস্ত তরুণেরা। ছবিটি সম্প্রতি তোলা।
ছবি: সাকিল আহামেদ

মুঠোফোন বা টেলিভিশন দেখে সময় কাটছে শিক্ষার্থীদের, যা এখন রীতিমতো তাদের আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এতে তারা ভবিষ্যতে পড়াশোনা করতে বা মনোনিবেশ করতে চাইবে না। তাদের জোর করে পড়াশোনা করাতে হবে। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অল্প বয়সে অনেক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে, আবার কারও কারও বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে, যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে গড়ে ওঠার অভ্যাস না–ও তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ সমাজের শিশুদের বিশাল ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই যত দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায়, ততই দেশ, দেশের শিশুসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য মঙ্গল।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণায় প্রাথমিক স্তরের এক-পঞ্চমাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের এক-চতুর্থাংশ স্কুলগামী শিশু শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। যার মধ্যে নারী ২৬ শতাংশ এবং পুরুষ ৩০ শতাংশ ঝুঁকিতে রয়েছে। অতিদরিদ্র পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থীর কোভিড–সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রাজশাহীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতীকী ক্লাসে অংশ নেন শিক্ষার্থীরা
ছবি: প্রথম আলো

মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেক গরিব পরিবারের মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। আবার অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে সংসারের প্রয়োজনে অনেক শিক্ষার্থী শিশুশ্রমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এ অবস্থা নিরসনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার কোনো বিকল্প নেই। করোনাকালে ১৭ মাসের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় একদিকে ছাত্রীরা দেদার বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে, অপর দিকে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না থাকায় তাঁদেরও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় অফলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করাই একমাত্র সমাধান। অধিক সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রতি সপ্তাহে অন্তত রোস্টার করে হলেও শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনার ব্যবস্থা করতে পারলেই অনেকটা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এতে শিক্ষার্থীসহ তাদের পরিবারও স্বাস্থ্যবিধি মানতে অভ্যস্ত হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে অনেক অপশক্তিও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে করেন সরকারি দলের অনেক সিনিয়র নেতা। কিন্তু কোনো অপশক্তি বা ষড়যন্ত্র সফল হবে না, যদি সরকার সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে যায়। কারণ, সরকারের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বিশ্বাসী অনেক নেতা–কর্মীসহ বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। তাই আমি মনে করি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণকারী শিক্ষকসমাজ দেশকে এবং বর্তমান সরকারকে সহযোগিতা করে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাই করোনার সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং দ্রুত বাকি শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করে শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

লেখক: সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।