১৪টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশে কার্যক্রম চালু করতে চায়

  • বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১০৭টি। আরও ৮৭টির জন্য আবেদন।

  • পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৪৯টি। প্রতি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা।

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার পর বাংলাদেশেও বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বিদেশি একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘স্টাডি সেন্টার’ চালুর অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আরও দুটির বিষয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আর মোট আবেদন জমা পড়েছে ১৪টি।

শিক্ষাবিদেরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে পর্যাপ্ত যাচাই–বাছাই করে খ্যাতি আছে এমন কয়েকটি নামকরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অনুমোদন দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু মানের ক্ষেত্রে কোনোরকম আপস করা যাবে না। এ জন্য সেগুলোও নিয়মিত তদারকির মধ্যে যেমন রাখতে হবে, তেমনি যেনতেন কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম যেন চালু হতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। না হলে উচ্চশিক্ষার নামে সনদ-বাণিজ্যের আশঙ্কা আছে। তাঁরা আরও স্মরণ করে দেন, বর্তমানে দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হলেও কিছুসংখ্যক বাদে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি আছে নানা ধরনের অভিযোগ। আবার কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুব ভালোও করছে। তাই এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশে অবৈধভাবে বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছিল। তখন প্রায় ৫৬টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছিল ইউজিসি। কারণ, এগুলো ছিল মূলত সনদনির্ভর প্রতিষ্ঠান। একপর্যায়ে অনুমোদন নিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এ রকম একটি সুযোগ রাখা হয়। এরপর ২০১৪ সালের ৩১ মে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ওই বিধিমালায় বলা হয়, বিভিন্ন শর্তে বাংলাদেশে স্থাপন করা যাবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার। দেশি ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যৌথ ক্যাম্পাসও চালুর সুযোগ রয়েছে এই বিধিমালায়।

আবেদনকারী যারা

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, বিধিমালার পর ১৪টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এ দেশে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর আবেদন করে। এ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামেই মূলত এই আবেদনগুলো করা হয়। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টারের জন্য আবেদন করে এডুকো বাংলাদেশ লিমিটেড। এডুকো প্রস্তাবিত এলাকা দিয়েছে বসুন্ধরায়। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ডার্বের স্টাডি সেন্টার করার জন্য আবেদন করে বিএসি ইন্টারন্যাশনাল। তারা প্রস্তাবিত ঠিকানা দিয়েছে ধানমন্ডি। গুলশান-২ এলাকার জন্য লন্ডন স্কুল অব কমার্সের স্টাডি সেন্টারের আবেদন করেছে এশিয়ান সেন্টার ফর ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়া বিভিন্ন বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য আবেদনকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—ভূঁইয়া একাডেমি, হিকমা লিমিটেড, এনইউবি ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি, ক্যামব্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি সেন্টার, বিএসবি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ, ইনসাইট ইনস্টিটিউট অব লার্নিং লিমিটেড, এশিয়া ইউনিভার্সিটি স্টাডি সেন্টার ইন বাংলাদেশ, লিংকন ইউনিভার্সিটি কলেজ, মাশা ইউনিভার্সিটি (মালয়েশিয়া) স্টাডি সেন্টার। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিতর্কিত।

বিশ্বায়নের যুগে খ্যাতিমান দু-চারটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দেশে চালু করা যেতেই পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু বড় বিষয় হলো, মানসম্মত শিক্ষা হয় কি না, সেটি দেখা। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, প্রক্রিয়া বেশ আগে শুরু হলেও নানা কারণে ২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার খোলার বিষয়টি ‘আপাতত’ স্থগিত করে। তখন বিধিমালাটি সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইউজিসি পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস করে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালুর পক্ষে থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়, একেবারে পূর্ণাঙ্গ ক্যাম্পাস করে ভালো মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আসবে না। এ জন্য স্টাডি সেন্টার চালুর অনুমতি দেওয়ার পক্ষে বলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৬টি শর্তে অস্ট্রেলিয়ার মনাশ কলেজের স্টাডি সেন্টারের জন্য অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে—নিজস্ব অথবা ভাড়া করা ভবনে কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান হয়, এমন পর্যাপ্ত পরিমাণ শ্রেণিকক্ষ থাকতে হবে। থাকতে হবে কমপক্ষে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের গ্রন্থাগার। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রে ভর্তির যোগ্যতা, ভর্তি ফি, টিউশন ফিসহ প্রোগ্রাম বা কোর্সের সর্বমোট খরচের তালিকাসংবলিত পুস্তিকা প্রকাশ করতে হবে; যা ওয়েবসাইটেও দিতে হবে। মনাশের কার্যক্রম অস্ট্রেলিয়ার বাইরে মালয়েশিয়াসহ একাধিক দেশেও রয়েছে।

ইউজিসির একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব ডার্বে এবং লন্ডন স্কুল অব কমার্সের স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেওয়ার বিষয়েও ইতিবাচক মত দিয়েছে ইউজিসি। হয়তো তারাও অনুমোদন পেতে পারে। তবে বাকিদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, অনুমোদন পেলেও মনাশ কলেজ এখনো পরবর্তী কার্যক্রম চালুর বিষয়ে তাদের কিছু জানায়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে যদিও আরও কেউ আবেদন করে তাহলে সেগুলোর বিষয়ে পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও ৮৭ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন

ইউজিসির সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে গত বছর পর্যন্ত আরও ৮৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আবেদন জমা পড়ার তথ্য দিয়েছে ইউজিসি। আবেদনকারীদের মধ্যে সাংসদ, রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৯টি। এর মধ্যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা হলো দেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করা।

এ রকম পরিস্থিতিতে বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে খ্যাতিমান দু-চারটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দেশে চালু করা যেতেই পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু বড় বিষয় হলো, মানসম্মত শিক্ষা হয় কি না, সেটি দেখা। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে আরও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনোভাবেই যেনতেন বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ দেওয়া যাবে না।