শিক্ষাজীবনের শেষের দিকে যেভাবে চাকরির জন্য প্রস্তুত করবেন নিজেকে

ছবি: সংগৃীত

সাধারণত মনে করা হয় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর পর সকলেই ‘গ্রাউন্ড জিরো’ থেকে ক্যারিয়ারের জন্য পড়াশোনা শুরু করেন। তাই বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হলে এগিয়ে থাকবে, প্রাইভেট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে পিছিয়ে থাকবে—এমন কোনো ব্যাপার নেই। তবে দেখা যায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দেন বললেই চলে, বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার আগের রাতে পড়াটাই তাঁদের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে কাঙ্ক্ষিত একাডেমিক ফল না পাওয়ার পাশাপাশি গ্র্যাজুয়েশনের পর চাকরির বাজারেও তাঁরা পিছিয়ে পড়েন।

দেশের স্নাতক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেকই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা করছেন। বর্তমানে ৩৪ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করলেও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেই পর্যাপ্ত ক্লাসরুম, অধিকাংশ কলেজে নেই পর্যাপ্ত শিক্ষকও। তাই শিক্ষার্থীরা ও অনার্সে ভর্তি হয়ে বুঝতে পারেন কখন কী করা উচিত। চলুন জেনে নেওয়া যাক, অনার্সে ভর্তি হয়ে কী কী করা যেতে পারে—

১. একাডেমিক পড়াশোনায় গুরুত্ব দিন

একাডেমিক পড়াশোনায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিন। ভালো সিজিপিএ আপনার জন্য গুড লেটার অব রিকমেন্ডেশন হবে। আপনি স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো ঠিকমতো পড়াশোনা করেননি আর ভাবছেন যে সিজিপিএর কোনো ভ্যালু নেই, তাহলে ঠিক ভাবছেন না। তবে যাঁদের জীবনে ভালো কিছু করার ইচ্ছা কিন্তু যেকোনো কারণেই সিজিপিএ কম, তাঁদের টেনশন করার কিছু নেই। আপনি আপনার চেষ্টা দ্বারাই সফল হবেন, কোনো সন্দেহ নেই।

২. সফটওয়্যারে পারদর্শী হওয়া

সাবজেক্ট ম্যাটারের পাশাপাশি অবশ্যই নিজের দক্ষতার উন্নয়ন করুন। সফটওয়্যার নিয়ে ভালো জ্ঞান অর্জন করতে চেষ্টা করতে হবে। দক্ষ হতে হবে PowerPoint, Excel ও Word–এ। শিক্ষাজীবন থেকে বের হয়ে চাকরির প্রায় সব খাতে এই দক্ষতাটি দারুণ কাজে দেবে। হাজারো চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে আপনার পার্থক্য গড়ে দেবে এই একটি কাজে দক্ষতাই!

ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন

৩. ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি

আপনাকে বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষাতেই দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে। ভাষা দক্ষতা বলতে শুদ্ধরূপে লিখতে, পড়তে, বলতে ও বুঝতে পারাকে বোঝানো হয়। যে কোনো লিখিত পরীক্ষায় আপনার লেখার মান ভালো হওয়া খুবই জরুরি। লিখিততে যেহেতু বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই লিখতে হবে, সে ক্ষেত্রে ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং আয়ত্তে আনাটা দরকার। তাই প্রতিদিন যেকোনো বিষয়ে অন্তত যে ১–২ পেজ বানিয়ে লেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। পরবর্তীতে এ অভ্যাস অনেক বেশি কাজে দিবে। ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং যদি অনার্স লেভেলেই না শেখা যায়, তাহলে পরে আয়ত্ত করা খুব কঠিন হয়ে যায়। পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই শুদ্ধ বাচনভঙ্গির সঙ্গে কথা বলতে পারাটা জরুরি। নিয়মিত ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন পড়ার অভ্যাস করা যেতে পারে। ইংরেজি থেকে বাংলা, বাংলা থেকে ইংরেজি অনুবাদ অনুশীলন করা যেতে পারে। সমমনা বন্ধু, সিনিয়রদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে ভালো। ইংরেজি ভাষা পরিমাপের আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষা আইইএলটিএস, টোফেল প্রভৃতি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে ইচ্ছা হলে এসব পরীক্ষার সার্টিফিকেট কাজে দেবে।

আরও পড়ুন

৪. মেন্টর বানান কাউকে

নিজের একজন পরামর্শকক বা মেন্টর বা গুরু খুঁজে নিতে হবে যিনি আপনাকে সাফল্যের পথ দেখাবেন। উনার কাজে আপনি অনুপ্রাণিত হবেন। পরামর্শক এমন একজনকে বানান, যিনি আপনার পছন্দের ফিল্ডগুলোতে সফল একজন মানুষ। এবং অবশ্যই অন্যান্য ফিল্ডগুলো সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। পরামর্শক হতে পারেন এলাকার বড়ভাই, যিনি পরিশ্রম করে সাফল্যের মুখ দেখেছেন। হতে পারেন কোনো ইন্টারনেট সেলিব্রিটি, যাঁর ভিডিও দেখে তাঁর মতো করে জীবন ধারণের চেষ্টা করছেন আপনি! যে-ই হোক, নিজের গুরুকে নিজেই খুঁজে নিতে হবে! মেন্টরের সঙ্গে কথা বলেই আপনার ক্যারিয়ার প্ল্যান তৈরি করুন।

৫. যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধি

বর্তমান সময়ে ক্যারিয়ারে ভালো করতে হলে যোগাযোগ দক্ষতা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। যোগাযোগ দক্ষতা না থাকলে অনেক সুযোগই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কীভাবে নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়, কীভাবে ফরমাল ই-মেইল লিখতে হয়, কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিচিত কারও সঙ্গে কথা বলতে হয়, কীভাবে অনেক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে সুন্দর করে নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় প্রভৃতি বিষয়ে অনুশীলনের মাধ্যমে শিখতে হবে।

ছবি: প্রথম আলো

৬. নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস

বলা হয়ে থাকে সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের আয়না। এটি মানুষকে সচেতন ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে। ছাত্রজীবন থেকে নিয়মিত পত্রিকা পড়লে সুন্দর ক্যারিয়ার ও জীবন গঠনে সহায়ক হয়। একজন সচেতন নাগরিক হওয়ার জন্য দেশের খোঁজখবর রাখতে হয়। শিক্ষা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, রাজনীতি, কূটনীতি, সাহিত্য, ধর্ম, খেলাধুলা, ফ্যাশন, লাইফস্টাইল—এমন সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস ব্যক্তিকে শুধু চাকরির প্রস্তুতিতে এগিয়ে রাখে না, বরং একজন মানুষকে স্মার্ট ও তথ্যসমৃদ্ধ করে। প্রত্যেক শিক্ষিত, সচেতন মানুষেরই নিয়মিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করা উচিত। এ ছাড়া বিশ্বের ভালো ভালো পত্রিকা–ম্যাগাজিন পড়ুন, টিভি চ্যানেল দেখুন। আর এ অভ্যাসটা আগে থেকে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকে করতে পারলে ভালো।

৭. টিউশনিতে প্রস্তুতি ও আয়

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অনেকেই আর্থিক লাভের জন্য টিউশনি করে থাকেন। টিউশনি শুধু আর্থিকভাবে লাভবান করে না বরং একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর চাকরির প্রস্তুতির জন্যও সহায়ক নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে সপ্তম থেকে নবম-দশম শ্রেণির ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, কম্পিউটার ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ের টিউটর হতে পারলে। আর এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান অর্জন ভবিষ্যতে চাকরির বাজারে ভালো কাজে দেবে। কাউকে পড়াতে হলে ওই বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান থাকলেই হয় না, তাঁকে সে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হয়। এভাবে পড়াতে থাকলে ওই বিষয়গুলোতে নিজের শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়। তবে কোনো অবস্থায়ই অতিরিক্ত টিউশনি করানো উচিত নয়। এতে জীবনের অন্যান্য বিষয়ে ঘাটতি হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

৮. এগিয়ে থাকতে সহশিক্ষা কার্যক্রম

সহশিক্ষা কার্যক্রমকে অবহেলা নয়। বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রম আপনাকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রাখবে অনেকাংশে। বিশ্ববিদ্যালয় মানেই মুক্ত জ্ঞানের ভান্ডার। এখান থেকে বইয়ের জ্ঞানের বাইরেও অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠন, ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। যেমন ডিবেটিং সোসাইটি, আবৃত্তি সংগঠন, সায়েন্স ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনগুলো অভিজ্ঞতা অর্জনে অত্যন্ত উপযোগী। সাংগঠনিক ও নেতৃত্বদানের দক্ষতা বিকাশ করে এ ক্লাবগুলো। প্রবলেম সলভিং স্কিল বা সুন্দর প্রেজেন্টেশন স্কিলও এখান থেকে গড়ে তোলা সম্ভব। বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে সহজ হয়। এ ছাড়া এসব সংগঠনের সঙ্গে থাকলে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা হাতছানি দেয়। তাই পড়াশোনা ঠিক রেখে বিভিন্ন ধরনের ক্লাব-সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যেতে পারে। নিজের ভালো লাগা, শখের কাজ করা যেতে পারে। তাই পরিমিত পরিমাণে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে অংশ নিতে কখনোই পিছপা হওয়া যাবে না।

৯. তৃতীয় বর্ষে এসে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবুন

একটা দেশে ৪৭% স্নাতক বেকার, ৮৯% নিজের চাকরিতে অসন্তুষ্ট, এটা বেশ ভয়ংকর তথ্য। নিজেকে এর থেকে বাইরে রাখার জন্য পরিকল্পনা শুরু করুন, আর পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজেকে তৈরি করুন। তৃতীয় বর্ষে এসে ক্যারিয়ার নিয়ে একটু ভাবুন। খোঁজখবর নিন। কোন চাকরিতে কী লাগে? সুবিধা কী কী? দায়িত্বকর্তব্য কী কী? ইত্যাদি। নিজের মতো করে প্রস্তুতির স্টাডি প্ল্যান করে নিন। মনে রাখবেন প্রত্যেক দিন কোন কোন সেক্টরে কতটুকু সময় বরাদ্দ রাখবেন তা আগে থেকে প্ল্যান করে এগোলে সফলতার হার অনেক বেড়ে যাবে।

আরও পড়ুন

১০. সময় ব্যবস্থপনায় গুরুত্ব দিন

সময় ব্যবস্থাপনা (টাইম ম্যানেজমেন্ট)। একটি অধরা, মূল্যবান সম্পদ যা আমরা সব চেয়ে বেশি চাই। তবুও এটি বালির দানার মতো আমাদের আঙুলের মধ্য দিয়ে পিছলে যায়।একজন ছাত্র থেকে শুরু করে একজন নিম্নবিত্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর কাছে যে পরিমাণ সময় আছে, একজন কোটিপতি ব্যবসায়ীর কাছেও সমান পরিমাণে সময় আছে। তাঁদের মধ্যে পার্থক্য শুধু সময়ের ব্যবস্থাপনায়। সময় ধরে রাখা যায় না এ কথা সত্যি, তবে ভয়ের কিছু নেই। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে জানলে দিনগুলো উপভোগ্য হবে, সময়ের অভাবে আর আফসোস করতে হবে না। যিনি যতবেশি কার্যকরীভাবে সময়ের ব্যবস্থাপনা করতে পারেন, তিনি তত বেশি সফল। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ। এক মিনিট সময়ও হেলায় পার করা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা সময় ব্যবস্থাপনার মুখ্য উপাদান। সকল দিক বিবেচনা করে সঠিকভাবে সময় ব্যবস্থাপনা খুব কম মানুষই করতে পারে। কিন্তু যারা করতে পারে তারাই সফলতার মুখ দেখতে পায়। সঠিকভাবে সময় ব্যবস্থাপনা করা হলে দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক চাপ দূর হয়ে যায়। তাই শুধু থেকেই সময় ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দিবেন।

তা ছাড়া অবসর সময়ে বিখ্যাত লেখকদের গ্রন্থ, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি পড়তে ভুলবেন না।  দেখা গেল আপনার অনার্স শেষ হয়ে গেলে এসব বই পড়ার সময় আর পাবেন না। আপনার সব বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র, শিক্ষক সবার সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করুন। হিংসা–বিদ্বেষ পরিহার করুন। মানুষের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হোন, ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিন।

লেখক: সাজেদুল হোসেন, শিক্ষার্থী,

আরও পড়ুন