সরকারীকরণ কলেজের শিক্ষক–কর্মচারীরাও এ দেশের নাগরিক
২০১৮ সালের ৩১ জুলাই ‘সরকারিকৃত কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা, ২০১৮’ নামক গেজেট প্রকাশিত হয়। শিক্ষা ক্যাডার ও আমলাতান্ত্রিক আগ্রাসনে বিনা বাধায় মনগড়া বিধি প্রণয়ন হওয়ায় সরকারীকরণ কলেজের শিক্ষক–কর্মচারীরা নানামুখী সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। নতুন এ বিধিমালায় প্রথমবারের মতো সরকারি কলেজ শিক্ষকদের ক্যাডার ও নন–ক্যাডার দ্বারা বিভাজন করা হয়েছে।
এদিকে সরকারীকরণ কলেজের শিক্ষকেরা প্রতিযোগিতা করে একের পর এক সংগঠন তৈরির মাধ্যমে শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি এনেছেন। দাবি আদায়ে শিক্ষকেরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিভক্ত হওয়ায় যৌক্তিক দাবিগুলো হালে পানি পাচ্ছে না। তা ছাড়া শিক্ষকদের বড় একটি অংশ হয়রানির শিকার হলেও নিশ্চুপ রয়েছেন। তাঁদের চিন্তা—সবার যা হবে, আমারও তা–ই হবে। বিধির বিষয়ে শিক্ষকদের চাওয়া নিয়ে রয়েছে মতানৈক্য। কেউ চাইছেন, শিক্ষকদের ক্যাডার মর্যাদা দিতে হবে। কেউ বলছেন, ক্যাডারের কি দরকার, বেতন বাড়লেই তো হলো। কারও ইচ্ছা—পদোন্নতি, বদলি ও পদসোপান। কারও অভিমত, বেসরকারি আমলের নিজ নিজ গ্রেড বহাল থাকুক। কেউবা আইনগত প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি ও পে-প্রটেকশন পেতে আগ্রহী। সরকারীকরণ কলেজে ক্যাডার শিক্ষক প্রবেশ ঠেকাতে কেউ চাইছেন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হবেন। আর অনেকেই দাবি আদায়ে ফেসবুকে সরব আছেন। সবাই শুধু চাইছেন আর চাইছেন! কিন্তু চাওয়া পর্যন্তই দৌড়। নেই কোনো যৌক্তিক সাংগঠনিক পদক্ষেপ। অথচ অত্যন্ত যৌক্তিক এসব দাবি আদায়ে একটা প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করলে দাবিগুলো সরকার ও প্রশাসন আমলে নেবে বলে মনে করি। সরকারি দপ্তরগুলো বিক্ষিপ্ত নেতৃত্বকে একটা প্ল্যাটফর্মে এসে দাবিগুলো পেশ করার পরামর্শ দিয়েছে। তারপরও নেতৃত্বের মোহে আচ্ছন্ন স্বঘোষিত নেতাদের কোনো কর্ণপাত নেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সমগ্র দেশের সরকারীকরণ কলেজ শিক্ষক–কর্মচারীরা।
অনেক সরকারীকরণ কলেজে এখনো আধুনিক সুযোগ–সুবিধা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এতে নতুন বিষয়ে অনার্সসহ বিভিন্ন বিষয় চালু করার পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারীকরণ কলেজগুলোর শিক্ষকসংকট এখন চরমে। বিগত সাত বছরে বেশির ভাগ কলেজের প্রায় অর্ধেক শিক্ষকের পদ শূন্য হয়েছে। কিন্তু পদগুলোয় সরকারিভাবে কোনো শিক্ষক দেওয়া হচ্ছে না, ফলে পাঠদান কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সরকারীকরণ বেশির ভাগ কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ অবসরে গেছেন। আর যাঁরা এলপিআরে যাবেন, তাঁরা কোনো ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছেন না। তাঁদের চিন্তা ওপরওয়ালার নাম করে বাকি দিনগুলো চলে গেলেই হলো। পদগুলো শূন্য হওয়ার পর ক্যাডার অধ্যক্ষ দিয়ে চলছে প্রশাসনিক কার্যক্রম।
এসব কলেজে বেশি উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকায় ক্যাডার অধ্যক্ষেরা অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। অধিকাংশ ক্যাডাররা শুধু অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এখানে পদায়িত হয়ে আসছেন। উত্তম জায়গা পেলে তাঁরা এসব কলেজ ত্যাগ করবেন। তাঁদের এ চিন্তা একেবারে অমূলক নয় বলে মনে করি। ফলে সরকারীকরণ কলেজ থেকে যোগ্যতা অনুযায়ী নন–ক্যাডার অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অফিস স্টাফদের উল্লেখযোগ্য অংশ অবসরে যাওয়ায় কলেজ পরিচালনায় প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অফিস সহায়কের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
কেউ বলছেন, ক্যাডারের কি দরকার, বেতন বাড়লেই তো হলো। কারও ইচ্ছা—পদোন্নতি, বদলি ও পদসোপান। কারও অভিমত, বেসরকারি আমলের নিজ নিজ গ্রেড বহাল থাকুক। কেউবা আইনগত প্রক্রিয়ায় পদোন্নতি ও পে-প্রটেকশন পেতে আগ্রহী।
এ মুহূর্তে পাঠদান কার্যক্রম ও যাবতীয় স্থবিরতা দূরীকরণে প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপ। বিধিমালা সংশোধন করে শিক্ষক–কর্মচারীদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। কী আজব ব্যাপার! চাকরি আছে অথচ পদোন্নতির কোনো নির্দেশনা নেই।সে জন্য সমস্যা দূর করতে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতির সোপান তৈরি ও বাস্তবায়ন একান্ত কাম্য। তা না হলে শিক্ষকেরা চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পাঠদানে অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারেন। দ্রুত স্থায়ীকরণের কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে শিক্ষক, প্রদর্শক, লাইব্রেরিয়ান ও অফিস সহায়কদের পদোন্নতির বিধান তৈরি ও বাস্তবায়ন করা। অনেকেরই চাকরির বয়স ১৮ বা ২০ বছর অথচ টাইম স্কেল ও পদোন্নতি পাননি। তাই তাঁদের হতাশা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি। চাকরি করে পদোন্নতি না থাকা বড়ই লজ্জা, কষ্ট ও পরিতাপের বিষয়! শিক্ষার মানোন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক স্থবিরতা, সংকট নিরসনে সরকার ও প্রশাসনের তৎপরতা বর্তমান সময়ের একান্ত কামনা। মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁরাও ন্যায্যতার দাবি রাখেন।
*লেখক: গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক, জেলা অ্যাম্বাসেডর শিক্ষক ও প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা।