শিক্ষায় যে বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি

বইসহ সব শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে, যা অভিভাবকদের জন্য চাপ হিসেবে কাজ করছে। এমনি করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক পরিবার বা কর্মজীবী মানুষের আয় কমেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে অনেক দিন ধরে। তাই সাধারণ মানুষ সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মহামারির আগে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা পড়াশোনার কাজে ব্যয় করত। কিন্তু মহামারির সময় তা ১৪ শতাংশে নেমে আসেছিল। এখন আবার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। যদিও কোভিড-১৯–এর কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার খুব একটা বেশি নয়; তবে অন্তত ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর ৩৫ শতাংশ কোভিড-১৯–এর কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। করোনা মহামারিতে দেশের সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী কমেছে। এক বছরের ব্যবধানে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় আড়াই লাখ, যা কোনোভাবেই ভালো খবর নয়।

আরও পড়ুন

অর্থাৎ সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে কীভাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনা যায়। অন্যথায় দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে দেখতে পেলাম, বাংলাদেশ প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সমিতি বই ছাপাসংক্রান্ত সবকিছুর দাম বেশি থাকায় বইয়ের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের অন্তরায়। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বইয়ের দাম ২৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা কতটুকু যৌক্তিক। যদি যৌক্তিক হয়, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, বই ছাপায় কিছু ভর্তুকি দেওয়া যায় কি না। এমনি জিনিসপত্রের দাম বেশি। বর্তমানে আবার শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে কাজ করছে অভিভাবকদের জন্য।

করোনার কারণে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মানসিক-সামাজিক নানা সমস্যা, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ—এমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কিশোর-কিশোরীদের। কোভিডের সময়ে অনেক অভিভাবক পড়াশোনা বন্ধ করে তাঁদের সন্তানকে কাজে পাঠিয়েছেন, যা বেশি ঘটছে ওই সব শ্রেণির লোকদের মধ্যে, যাঁদের আয় অনেক কম এবং বেশি শিক্ষিত নন। শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীদের নেওয়া সিদ্ধান্ত আমাদের নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে। তাই শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে, সে বিষয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে কর্তৃপক্ষের, যাতে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।

পাঠ্যবই
ফাইল ছবি

প্রকাশকেরা দাবি করেছেন, বই ছাপানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণের আকাশছোঁয়া দামের কারণে প্রকাশকদের পক্ষে বইয়ের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই তারা বইয়ের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের কথা হলো কীভাবে বইয়ের দাম শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জরুরি।

ন্যাশনাল কারিকুলাম অ্যান্ড টেক্সটবুক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুসারে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণির জন্য বাংলা, ইংরেজিসহ চারটি বইয়ের স্ক্রিপ্ট চূড়ান্ত হয়েছে, যা একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু করার আগে এসব বই ছাপার দরপত্র আহ্বান করবে। কিন্তু সেখানে প্রকাশকেরা চারটি এনসিটিবি বইয়ের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি করেছিলেন। কিন্তু এনসিটিবি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়ানোর কথা চিন্তা করছে। কিন্তু বাস্তবে ১ শতাংশও বাড়ানো ঠিক হবে না। বর্তমানে সরকার অনেক ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন করে যাচ্ছে, সেখানে নতুন করে ব্যয় বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকার নেবে—এ আশা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও বলব যাতে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো না হয়।

করোনার সময় এমনিতে শিক্ষা খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখনো অনেক ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে শিক্ষা খাত। মহামারি চলাকালে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এবং ক্ষতি মেরামত করা সম্ভব হয়নি। মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি যেভাবে সাধারণ বা শিক্ষিত মানুষের আলোচনায় ছিল বা আছে। কিন্তু সেভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ার বিষয়টি আমাদের কাছে আলোচনায় আসে না। এভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়তে থাকলে সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে নেওয়া নানা পদক্ষেপ এবং চলমান শিক্ষা কার্যক্রম বিঘ্নিত হতে পারে। সরকারের ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কর্মসূচিও হুমকিতে পড়তে পারে। শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের খরচের বোঝা বৃদ্ধি পাবে। ফলে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে পারে। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা চালাতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এমনকি অনেক অভিভাবককে তাঁদের সন্তানের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাই এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

নতুন দাম এখন অভিভাবকদের, বিশেষ করে করোনভাইরাসে আক্রান্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এবং বই পাঠকদের জন্য একটি নতুন ধাক্কা হিসেবে কাজ করবে। এতে পাঠকসংখ্যা কমে যাবে এবং সাহিত্যচর্চা কমে আসবে, যা সাহিত্যজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সর্বশেষ ইউনেসকো গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষার মোট ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবার বহন করে। কিন্তু পরিবার আরও কম ব্যয় করবে। সরকারে শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের ওপর চাপ কমে আসে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সত্ত্বেও দেশগুলোয় শিক্ষায় বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত রয়ে গেছে। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশ শিক্ষা খাতে মোট সরকারি ব্যয়ের ১৫ শতাংশ বা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশের কাছাকাছি কোথাও ব্যয় করেনি। তাই আগামী বাজেটে সরকারের শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পরিবারগুলো শিক্ষার খরচ মেটাতে ঋণ নেয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করে এবং ৬ শতাংশ স্কুলের ফি পরিশোধের জন্য ঋণ নেয়। বাংলাদেশে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পরিবার বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াশোনার খরচ মেটাতে ঋণ নেয়, যা টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী হিসেবে কাজ করছে। এ জন্য কর্তৃপক্ষকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সীমিত আয়ের সব অভিভাবক বইয়ের মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিক্ষা উপকরণ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। অভিভাবকেরা এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন এবং বাজারে সব দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় কমাতে বাধ্য হবেন। আমরা আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। সরকারের প্রতি বিশেষ অনুরোধ, কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে এবং অভিভাবকদের জন্য বইয়ের দাম সহনীয় রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।

নোটবুক, বই, কলম, পেনসিল, ক্যালকুলেটর ও জ্যামিতি বাক্স সরবরাহের জন্য যে অর্থ অতীতে প্রদান করতে হয়েছে, এখন তার চেয়ে ৩০ শতাংশ বা তার বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এসব উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি। তাই মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতি উভয়ই কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে বা অর্থনীতির জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।

সর্বোপরি, সবকিছু বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি ও শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা উচিত। অন্যথায়, যে উদ্দেশ্যে উপবৃত্তির প্রচলন হয়েছিল, তার কার্যকারিতা থাকবে না। উপবৃত্তি যেমন আমাদের শিক্ষা খাতের কার্যক্রমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যাতে আমরা আশান্বিত হয়েছি। তাই এ ধরনের আরও নতুন নতুন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে শিক্ষা খাতের ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়।

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।