সমাজবিজ্ঞান বিভাগকে বড্ড ভালোবাসি

সহকর্মীর সঙ্গে লেখকছবি: সংগৃহীত

পরিবর্তন শব্দটি বাদে পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। জীবনও তাই। তবে তার চেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল হচ্ছে মানবিক সম্পর্ক, যার মধ্য দিয়ে জীবন দৃশ্যমান হয়। চলমানতাই জীবনের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। পৃথিবীতে কোনো কিছু একবার গেলে আর ফিরে আসে না। গ্রিক প্রবাদে বলা হয়, যা একবার ঘটে যায়, ঈশ্বরও সেটির পরিবর্তন করতে পারেন না। আমরা যা হারাই, তা চিরদিনের জন্যই হারাই। যেমন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনকে হারিয়েছি। যে জীবন ছিল অনুভূতিতে ভরপুর, বড় স্বপ্নে ভরা সময়। এ জীবন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। এ জীবনে আমি বার বার ফিরে যেতে চাই। আমি ফিরে যেতে চাই আমার প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে।

 কর্মজীবনের বিভিন্ন কাজের সুবাদে সুযোগ পেলেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে গিয়ে থাকি। এ বিভাগের সঙ্গে রয়েছে আমার আত্মিক বন্ধন। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এ বিভাগে অর্জিত জ্ঞানের প্রভাব অনুধাবন করি। সঙ্গত কারণেই এ বিভাগকে ঘিরে রয়েছে আমার দীর্ঘ আট বছরের স্মৃতি, যার সবটুকু হয়তো কখনো লিখে শেষ করা যাবে না।

মনে পড়ে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই। প্রথম দেখাতেই অসাধারণ মতিহারের সবুজ চত্ত্বরের প্রেমে পড়ে যাই। মনে স্বপ্ন জাগে। আহা! যদি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারতাম, তাহলে কতই না ভালো হতো। এসএসসি ও এইচএসসিতে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলাকার বড় ভাইদের পরামর্শে কলা, বাণিজ্য ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। কলা ও বাণিজ্য অনুষদে নিয়মমতো পরীক্ষা দিতে পারলেও ভর্তি পরীক্ষার তৃতীয় দিনে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পরীক্ষাতে অংশগ্রহণের জন্য শাহ মখদুম হলের গেটে লাগানো সিট প্ল্যানে আমার রোল খুঁজে পেলাম না। তৎক্ষণাৎ বিষয়টি এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে খুলে বলি। আমার কথা শুনে উনি বিরক্ত হন এবং আমাকে বোকা বলে বকাবকি করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেও সিট প্ল্যান চেক করে আমার রোল নম্বর খুঁজে পান না। এরপর আমার আকুতি ও কান্না দেখে দয়া পরবশ হয়ে তিনি সে সময়ের হলের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ওয়াজেদ ভাইয়ের রুমে নিয়ে যান। ওয়াজেদ ভাই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পুরো পরিস্থিতি অবহিত করা হয়। সব শুনে তিনিও আমাকে বকাবকি করতে থাকেন। পরে তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টায় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অফিসে যান। তখন দায়িত্বে থাকা ডিন মহোদয় আমাদের কথা শুনে বলেন, ‘গতকাল সারা রাত অনুষদ অফিস খোলা ছিল। এখন প্রায় ১০টা বাজে, পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে, এখন আর আমাদের পক্ষে কিছুই করার নেই।’ পরে ওয়াজেদ ভাইয়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি প্রায় ৭০০০ ফরমের মধ্য থেকে আমার ফরমটি খোঁজার নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুসারে তিনজন অনুষদ অফিসের একজন পিওন সহযোগে শেলফে রাখা ফরমগুলো ধারাবাহিকভাবে খুঁজতে থাকি। প্রায় আধা ঘণ্টা খোঁজার পর আমি নিজেই পঞ্চম বান্ডিলে আমার ফরমটি পাই। ফরমটি পাওয়ার পর দেখা যায়, আমার রোল নম্বরের মাঝের একটি ডিজিট বাদ পড়েছে। সেটি সংশোধন করে ডিন মহোদয় আমাকে মমতাজউদ্দীন কলাভবনের নিচতলায় সমাজকর্ম বিভাগের পাশের একটি কক্ষে পরীক্ষা দেবার অনুমতি প্রদান করেন। তখন বাজে সকাল ১০.৩০ মিনিট। আমি পরীক্ষার হলে ঢুকতে গেলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক আমাকে ঢুকতে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে আমার এডমিট কার্ড দেখে তিনি একটি খালি সিটে বসার সুযোগ করে দেন। ভর্তি হবার অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম, তিনি ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় অধ্যাপক আবদুল কাদির ভূঁইয়া স্যার। আমি কাঁদতে কাঁদতে পরীক্ষা দেওয়া শুরু করি। পাশের সিটে বসা একজন শিক্ষার্থী (যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বারের মতো ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন) আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আমাদের এলাকার একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যার ছেলে আমার সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, আমাদের ফলাফল জানার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তিনি ফিরে এসে জানান তাঁর ছেলে এবং আমি—কেউই ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাইনি। এর কিছুদিন পর আমার বাবা তাঁর দাপ্তরিক কাজে রাজশাহীতে গেলে আমি তাঁকে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলি। তিনি অনুষদ অফিসে গিয়ে জানতে পারেন যে আমি মেধাতালিকায় চান্স পেয়েছি। কিন্তু ততদিনে ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। এ খবর শুনে বাবা ডিন মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করে  নিজের পরিচয়  দিয়ে বিষয়টি তাঁকে খুলে বলেন। ডিন মহোদয় বিষয়টি শুনে অভিভাবক হিসেবে একটি আবেদন করতে বলেন। আমার বাবা মাধ্যমিক স্কুলে ইংরেজি পড়াতেন। সঙ্গত কারণেই তিনি ইংরেজিতে আবেদন করেন। আবেদন পত্রটি পড়ে ডিন মহোদয় মুগ্ধ হন এবং আমাকে তিন দিন পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ দেখা করতে বলেন। আমি নির্ধারিত দিনে কাগজপত্রসহ তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সেদিন ছিল তৃতীয় অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারের দিন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার কোন বিষয় পছন্দ আছে কি না? আমি উত্তরে তাঁকে বলি, ‘স্যার আপনি যেটা ভালো মনে করেন।’ সত্যি বলতে কি, সে সময়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীন কোন কোন বিষয় পড়ানো হয়, আমি তার কিছুই জানতাম না। পরে তিনি আসন শূন্য থাকা সাপেক্ষে আমাকে সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হবার অনুমতি প্রদান করেন এবং আমি ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই।

লেখক

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী সব শিক্ষার্থীকে একটি হলের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হয়। আমি সংযুক্ত ছিলাম শাহ মখদুম হলে। এ হলের প্রভোস্ট ছিলেন অধ্যাপক এ এইচ এম জেহাদুল করিম। আমার ভর্তির সময় তিনি বিভাগের সভাপতিও ছিলেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম ক্লাসটি নিয়েছিলেন সে সময়ের তরুণ শিক্ষক এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান। দ্বিতীয় কোসর্টি অধ্যাপক এ এইচ এম জেহাদুল করিম। প্রাণবন্ত উপস্থাপনার মাধ্যমে স্যার নৃবিজ্ঞানকে আমাদের কাছে অনেক মজার বিষয় হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তখন আমার ধারণা হয়েছিল যিনি বিভাগের সভাপতি, তিনিই হন হলের প্রভোস্ট। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে তার পদবী হয় এ এইচ এম। মোস্তাফিজুর রহমান স্যারের প্রথম ক্লাস করে মনে হয়েছিল আসলেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ক্লাস দারুণ এক ব্যাপার। স্যার আমাদের সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করায় নিজেকে বেশ সম্মানিত মনে করতাম। প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে আসেন আরেকজন তরুণ দক্ষ শিক্ষক অধ্যাপক কামাল আহমদ চৌধুরী। তিনি আমাদের ‘সমাজবিজ্ঞানের মূলনীতি’ কোর্সটি পড়াতেন। তিনি বলতেন সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হলে ‘সমাজবিজ্ঞান সমীক্ষণ’ বইটি পড়তেই হবে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসি কামাল স্যারের। আমি স্যারের কিছু গবেষণা কাজে সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ড. বদরুল আলম খান স্যার ছিলেন আমার প্রথম টিউটোরিয়াল শিক্ষক। তিনি আমাদের প্রথম বর্ষেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। তিনি আমাকে তাঁর লেখা বেশ কিছু বই উপহার দেন।

তৃতীয় বর্ষে গবেষণা মনোগ্রাফ করতে গিয়ে প্রয়াত অধ্যাপক এস এম জিল্লুর রহমান স্যারের সান্নিধ্যে আসি। তিনি আমাকে হাতে-কলমে গবেষণার অনেক কিছু, সেই সঙ্গে বাংলা লেখার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় শিখিয়েছিলেন। মরহুম এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন স্যারের সঙ্গে প্রথম দেখা শাহ মখদুম হলের ৩০৩ নম্বর কক্ষে। তখন তিনি মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। পরবর্তীতে স্যার বিভাগে যোগদানের পর আমার সঙ্গে সম্পর্ক আরও আন্তরিক হয়। তিনিই আমাকে সর্বপ্রথম গবেষণার প্রতি আগ্রহ করে তোলেন। আমার ছাত্রজীবনের দীর্ঘ আট বছরে বিভিন্ন বর্ষে অনেক গুণী শিক্ষকের ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে মাস্টার্স ক্লাসে কাদির ভূঁইয়া স্যারের ‘আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব’¡কোর্সটি আমাকে আকৃষ্ট করে। স্যারের পড়ানোর কৌশল ছিল অসাধারণ। তাঁর কারণেই তত্ত্বের মতো রসকষহীন বিষয়টি উদাহরণের মাধ্যমে আমাদের কাছে মজার বিষয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পারতপক্ষে আমরা কেউ তাঁর ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতাম না। পরবর্তীতে স্যারের তত্ত্বাবধানে আইবিএস-এ পিএইচডি করি। এ ছাড়া হাসান ইমাম স্যারের ‘উন্নয়ন সমাজবিজ্ঞান’ বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল।

সত্যি বলতে কী সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির আগ পর্যন্ত বিভাগটির নাম শুনিনি। বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস বিষয়ের নাম জানা থাকলেও সমাজবিজ্ঞানের নাম আমার জানাই ছিল না। অনেকেই জানতে চাইত, এ বিষয়ে পড়াশুনা করে কী হওয়া যায়। এছাড়া আমাদের এলাকার অনেকেই তখন ইংরেজি, বাংলা, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে পড়ত। তারা বুক ফুলিয়ে তাদের বিষয়ের নাম বললেও আমি হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। অবশ্য ধীরে ধীরে অস্বস্তি কাটতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে বুঝতে সক্ষম হই বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পড়ার গুরুত্বটা ঠিক কতখানি! সত্যি বলতে কী, সমাজ তথা ব্যক্তিজীবনকে জানতে সমাজবিজ্ঞান পাঠের বিকল্প নেই। এক কথায়, জীবনবোধ সম্পর্কে জানা যায়। আজকে জীবনে যে পর্যন্ত আসতে পেরেছি, তার পুরোটাই সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কৃতিত্ব। বিভাগের কাছে আমি তাই আজীবন ঋণী। এ বিভাগটিকে বড্ড ভালোবাসি। মনে প্রাণে নিজেকে বিভাগের একজন অংশীদার মনে করি এবং আজীবন করে যাব।

*লেখক: খ. ম. রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর-৭৪০০