প্রাথমিকে ৭৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৮৫.৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাণিজ্যিক গাইড বই পড়ে

প্রাইভেট পড়ার জন্য মাসে ১ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয়।

গণসাক্ষরতা অভিযান-এর 'মহামারি উত্তর শিক্ষা: স্কুল শিক্ষার পুনরুদ্ধার ও আগামীর অভিযাত্রা' শীর্ষক প্রতিবেদন শনিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ঢাকা
ছবি: মোশতাক আহমেদ

মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট-কোচিংয়ের ওপর নির্ভরতা যে কতটা, তা বেরিয়ে এসেছে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। শহর ও গ্রামাঞ্চল—সব পর্যায়েই এ চিত্র দেখা গেছে।

আর অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।

‘মহামারি উত্তর শিক্ষা: স্কুল শিক্ষার পুনরুদ্ধার ও আগামীর অভিযাত্রা’ শীর্ষক এডুকেশন ওয়াচ ২০২২ নামে এ প্রতিবেদন গতকাল শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, শিক্ষকনেতা কাজী ফারুক আহমেদ, গবেষক সৈয়দ শাহাদাত হোসাইন প্রমুখ।

আমরা খারাপের দিকে যেতে চাই না। আলোর দিকে যেতে চাই।
রাশেদা কে চৌধূরী, নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রাথমিকে ৭৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের পাঠ ও পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাণিজ্যিক গাইড বই অনুসরণ করছে। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে এ খাতে গড়ে ৬৬৯ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২ হাজার ৬৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে বলে অভিভাবকেরা জানিয়েছেন।

গণসাক্ষরতা অভিযান ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে। গবেষণায় প্রাথমিক উপাত্তের উৎস ছিল দেশের আটটি বিভাগের প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্থানীয় এনজিও কর্মী। মোট উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬৯২। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮২১ জন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যার মধ্যে প্রায় সমানসংখ্যক ছেলে ও মেয়ে। আট বিভাগের ৮টি জেলা ও ২১টি উপজেলা এবং ২টি সিটি করপোরেশন এ গবেষণার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তিন বিষয়ে দুর্বলতার চিত্র

গবেষণার অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবরে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে ৯০ মিনিটের পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখনদক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়। অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে নির্ধারিত দক্ষতা পর্যালোচনা করে পরীক্ষাটি ‘মধ্যম মানের কঠিন’ করা হয়েছিল। তাতে সামগ্রিক ফলাফলে দেখা গেছে, অষ্টম শ্রেণির ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ন্যূনতম পাস নম্বর (৩৩ শতাংশ) অর্জন করতে পারেনি। নবম শ্রেণির ক্ষেত্রে এ হার ছিল ২৬ দশমিক ২। ‘ডি’ গ্রেড (৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর) অর্জন করেছে অষ্টম শ্রেণিতে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং নবম শ্রেণিতে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

ফাইল ছবি

শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার (পারফরম্যান্স) চিত্রও উঠে এসেছে এ গবেষণায়। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়, ৬৫ শতাংশ ইংরেজিতে এবং ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করেছে। আর নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলায় ৮৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ৭২ শতাংশ এবং গণিতে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আবার ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করেছে। এলাকাভেদে সামগ্রিক ফলাফলে যশোর জেলায় ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে। আর সবচেয়ে পিছিয়ে আছে হবিগঞ্জ জেলা, যেখানে পাসের হার ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ।

করোনা মহামারিতে বিদ্যালয় বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের শিখনের ওপর সামগ্রিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭১ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতে, বিদ্যালয় খোলার পর তারা পাঠ বোঝার জন্য বিশেষ কোনো সহায়তা পায়নি।

গবেষণার তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক—উভয় স্তরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অভিভাবক শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনের অত্যধিক ব্যবহারকে একটি সমস্যা হিসেবে দেখেছেন। যদিও তিন-চতুর্থাংশ মা–বাবা এটিকে কোনো উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখেননি। প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে এডুকেশন ওয়াচের সভাপতি কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশে নীতির কোনো সংকট নেই। শিক্ষা হোক, স্বাস্থ্যসেবা হোক—ভালো নীতি আছে। সংকট হচ্ছে বাস্তবায়নে, এটি একেবারে সর্বক্ষেত্রে। বাস্তবায়নের কাজে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সঠিকভাবে কাজ করেন না, সময়মতো করেন না। আর সুযোগ থাকলে নিজেদের পকেট একটু ভারী করার চেষ্টা করেন।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আমরা খারাপের দিকে যেতে চাই না। আলোর দিকে যেতে চাই।’