শিক্ষায় ডিজিটাল বিভাজন: গ্রামীণ কলেজে প্রযুক্তি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ

রংপুরের লালকুঠি মহিলা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ডিজিটাল ল্যাব। দুই বছর ধরে ল্যাব ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ১৫ মের ছবিপ্রথম আলো ফাইল ছবি

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার অনেক দ্রুত ঘটেছে, যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরাও সহজেই অনলাইনে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। এসব দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুম, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়ন করছে এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বাড়াচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করছে, যেন প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা আরও সহজলভ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়। অনেক দেশে ডিজিটাল শিক্ষাকে আইনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে সব স্তরের শিক্ষার্থী প্রযুক্তির সুফল পায় এবং পিছিয়ে না পড়ে। ইউরোপ ও আমেরিকার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন শিক্ষাকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, ফলে সেখানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা দ্রুত বেড়ে চলেছে। যদিও আফ্রিকার অনেক দেশে ইন্টারনেট–সংযোগ ও অবকাঠামো এখনো দুর্বল, এরপরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেখানে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাকে বিস্তৃত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, যেখানে সরকার বিশেষ বাজেট ও নীতিমালা গ্রহণ করেছে এই খাতকে এগিয়ে নিতে। উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি উন্নয়নশীল অনেক দেশ এখন অনলাইন শিক্ষার জন্য নিজস্ব অ্যাপ, প্ল্যাটফর্ম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করছে। এসব প্রচেষ্টার ফলে বৈশ্বিকভাবে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা যেমন এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, তেমনি নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জও তৈরি হচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার একদিকে উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে কিছু অঞ্চলে ‘ডিজিটাল বিভাজন’ এখনো একটি বড় সংকট হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব শিক্ষকের জন্য আইসিটি প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ডিজিটাল কনটেন্ট, ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার ডিজিটালীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

তবে নীতিমালার এই অগ্রগতির বাস্তব চিত্র গ্রামীণ কলেজগুলোয় অনেকটাই ভিন্ন। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা, অব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাবে সরকারি উদ্যোগগুলো কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাচ্ছে না।

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামীণ কলেজগুলোরও অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রযুক্তিতে যথেষ্ট দক্ষ। প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ ব্যবহার করে। তারা ইউটিউব, গুগল, ফেসবুক গ্রুপ, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শিক্ষাবিষয়ক তথ্য আদান-প্রদান করে। কোচিং বা অনলাইন টিউটোরিয়ালেও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। তারা মনে করে, শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহারে পাঠ আরও আকর্ষণীয় হয় এবং বিষয়বস্তুকে সহজে বোঝা যায়। শিক্ষার্থীরা এই বিশ্বাসও রাখে যে প্রযুক্তি শিক্ষককে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না বা এটি শিক্ষকদের বিকল্প হবে না; বরং শিক্ষকের দক্ষতাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

তবে দুঃখজনকভাবে এসব কলেজে ডিজিটাল লাইব্রেরি, উচ্চগতির ইন্টারনেট, পর্যাপ্ত মাল্টিমিডিয়া কক্ষ ও সুনির্দিষ্ট পাঠপরিকল্পনার অভাব রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে তারা তাদের সেই আগ্রহ ও সক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।

গৌরনদীতে বসেই বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের কাছে অনলাইনে পড়তে পারছে এই ছাত্রীরা
ছবি: স্ক্রিনশট

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও অনেক শিক্ষক তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, তবু বাস্তবে প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল উপকরণ খুব কম ব্যবহার করেন। কেন?

আরও পড়ুন

প্রথমত, অনেক শ্রেণিকক্ষে ইন্টারনেট–সংযোগ নেই, যা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারে প্রধান প্রতিবন্ধক;

দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ সমস্যার পাশাপাশি অনেক স্থানে প্রজেক্টর ও ল্যাপটপের রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের ব্যবস্থা নেই;

তৃতীয়ত, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করতে বাড়তি সময় ও প্রচেষ্টা দরকার, যা শিক্ষকেরা অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততার কারণে দিতে পারছেন না;

চতুর্থত, শিক্ষকদের মধ্যে একটি বড় অংশ বিভিন্ন কোচিং, প্রাইভেট টিউশন কিংবা অন্যান্য আয়মূলক কাজে জড়িত, যার ফলে তাঁরা শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তির প্রয়োগে যথাযথ মনোযোগ দিতে পারছেন না;

একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘প্রশিক্ষণ তো দেওয়া হয়, কিন্তু মনিটরিং নেই। অনেক যন্ত্রপাতি অযত্নে পড়ে থাকে। নষ্ট হয়ে গেলেও কেউ দেখে না।’

অন্য এক শিক্ষক বলেন, ‘কলেজে চারটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে এই কক্ষগুলো পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সে রকম কনটেন্ট তৈরির জন্য ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেন্টার নেই।’

সারা দেশের শিক্ষকদের কাছ থেকে আমরা প্রায়ই এসব কারণ শুনতে পাই, যার মধ্যে কিছু কারণ বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন হলেও কিছু আবার শুধু অজুহাত।

ছবি: প্রথম আলো

বর্তমানে কিছু কলেজে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী এবং সচেতন অধ্যক্ষ রয়েছেন, যাঁরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানেই সরকারের পক্ষ থেকে ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সহায়ক হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষকসমাজের একটি বড় অংশ এখনো মূলত প্রচলিত লেকচারভিত্তিক শ্রেণি-পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। তাঁরা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি, উপস্থাপন কিংবা মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনায় আত্মবিশ্বাসী নন বা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাবে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি।

অন্যদিকে অনেক অধ্যক্ষ নিজ নিজ পর্যায়ে চেষ্টা করেন শিক্ষকদের উৎসাহিত করতে, মনিটরিং করতে এবং ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নীতিমালা, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, তদারকি ও মূল্যায়নের সুসংগঠিত কাঠামোর অভাবে এসব প্রচেষ্টা বিচ্ছিন্ন ও অপ্রতিসম থাকে। ফলে একটি সমন্বিত রূপান্তরের দিকে যাওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া প্রশাসনিক স্তরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মানবসম্পদ, বাজেট ও প্রযুক্তিগত সহায়তা—সব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই স্থানীয় পর্যায়ে ভালো উদ্যোগ থাকলেও কেন্দ্রীয় সহায়তা ছাড়া টেকসই অগ্রগতি অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার সফল বাস্তবায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু শুধু যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। এর জন্য প্রয়োজন—

১. নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট–সংযোগ;

২. সাধারণ প্রশিক্ষণের বাইরে বাস্তবমুখী ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা;

৩ . শিক্ষকদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির সুবিধা ও নির্দিষ্ট সফটওয়্যার সাপোর্ট;

৪. যন্ত্রপাতির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও পর্যাপ্ত কারিগরি কর্মী;

৫. মনিটরিং, মূল্যায়ন ও প্রণোদনার ব্যবস্থা;

৬. উদ্ভাবনী শিক্ষকতায় উৎসাহ ও সাংগঠনিক সংস্কৃতির উন্নয়ন।

তবে শিক্ষকদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে হলে তাদের শুধু প্রশিক্ষণ নয়, পাশাপাশি বাস্তবিক উৎসাহ, প্রয়োজনীয় সহায়তা, পর্যাপ্ত সময়, প্রশিক্ষণ এবং উপযুক্ত বেতন ও আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ এমন হতে হবে, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি সহজাত অংশ হয়ে ওঠে।

শিক্ষার আধুনিকীকরণ শুধু প্রযুক্তিনির্ভর কোনো বিষয় নয়, এটি একটি মনোভাব ও সংস্কৃতির অংশ। এই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হলে সরকারি নীতিমালার পাশাপাশি শিক্ষকদের মানসিক প্রস্তুতি, প্রশাসনিক সক্রিয়তা এবং শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ—এই তিনটির সমন্বয় অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু শহরের উন্নয়ন দিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়; প্রকৃত অর্থে গ্রাম-শহরের ব্যবধান দূর করে শিক্ষায় সমতা নিশ্চিত করলেই কেবল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। উন্নত দেশগুলো ইতিমধ্যে শহর ও গ্রামের মধ্যে প্রযুক্তিগত বৈষম্য দূর করতে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার ফলে সবার জন্য সমান শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের জন্যও এই আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে, কেননা নীতিনির্ধারণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে একযোগে কাজ করলেই কেবল একটি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন সম্ভব।

*লেখক: শুভাশীষ দাশ, প্রভাষক, সরকারি ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ, ফেনী

আরও পড়ুন