আমার অভিজ্ঞতায় পিএইচডির টুকিটাকি

দেশই হোক না কেন, সেখানকার ল্যাবের পরিবেশ দেখে একজন শিক্ষার্থী নিজেই মাইন্ড সেটআপ করে ফেলতে পারবেন—সপ্তাহে তার কতটুকু কাজ করা প্রয়োজন
প্রতীকী ছবি

পিএইচডি বা ডক্টরেট ডিগ্রি একজন গবেষকের জীবনে অনেক বেশি সম্মান বা গৌরবের বিষয়। নিজেকে দক্ষ গবেষক হিসেবে গড়ে তোলা বা নিজের হাতে গবেষণা পরিচালনা করার সক্ষমতা অর্জন পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের মূল লক্ষ্য। পিএইচডি পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার আনকোরা কোনো সমাধান বের করে বা সম্পূর্ণ নতুন কোনো বিশ্লেষণ দেয়। নিয়মিত গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাটির ধাপে ধাপে সমাধান করে এবং বিভিন্ন কনফারেন্স কিংবা খ্যাতিমান জার্নালে নিয়মিতভাবে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে তবেই তিনি একজন দক্ষ গবেষক হিসেবে গড়ে ওঠেন। এই ডিগ্রি অর্জন করতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে যে কঠিন ত্যাগ ও অধ্যবসায় করা লাগে, সেটা আজীবন ডিগ্রিধারীর মনে গেঁথে থাকে। আজকের লেখায় আমার অভিজ্ঞতায় পিএইচডির টুকিটাকি বিষয় নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব।

পিএইচডি করতে গিয়ে কাজের চাপ কেমন হবে, এ বিষয় নিয়ে অনেকের বিস্ময় জাগে। তবে এ ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়ের ওপর কাজের চাপ নির্ভর করে। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রসায়ন—দুটিতেই গবেষণা ও কাজের চাপ সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। স্থান, কাল, পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর কাজের চাপ অনেকাংশে নির্ভর করে। যেমন চীন, জাপানে কাজ বেশি করতেই হবে। কারণ, সেখানকার সংস্কৃতিটাই সেভাবে গড়ে উঠেছে। আবার পিএইচডি সুপারভাইজার ও ইনস্টিটিউটের ওপর নির্ভর করলেও কাজের চাপ কখনো কখনো ভিন্ন হয়। আমেরিকায়ও কাজের চাপ অনেক। আবার ইউরোপে কাজের চাপ তুলনামূলক কম।

তবে যে দেশই হোক না কেন, সেখানকার ল্যাবের পরিবেশ দেখে একজন শিক্ষার্থী নিজেই মাইন্ড সেটআপ করে ফেলতে পারবে—সপ্তাহে তার কতটুকু কাজ করা প্রয়োজন। যখন কেউ দেখবে আশপাশের সবাই ১২ ঘণ্টা কাজ করছেন, সেখানে কেউ ৮ ঘণ্টা কাজ করে নিজেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। সে জন্য অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াটাই সর্বোত্তম। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, পিএইচডি প্রপোজালের সঙ্গে প্রথমে প্রতিটি অভিজ্ঞতা তথা পুরো পিএইচডিকালীন একটি টাইম লাইনের ছক উল্লেখ করা লাগে। যদিও এই ছক অনুযায়ী যাওয়াটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তারপরও সবার চেষ্টা করা উচিত সময়ের ভেতরে সুপারভাইজারকে খুশি করে ডিগ্রির মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট যত দ্রুত সম্ভব অর্জন করা।

ফান্ড ছাড়া কিন্তু পিএইচডি স্টাডি একটু হলেও অসম্ভব। তাই সব সময় স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ নিয়েই পিএইচডির জন্য পা বাড়ানো উচিত। এ উদ্দেশ্যে দেশে বা দেশের বাইরে বহু ফান্ড আছে। খুব সহজেই এসব ফান্ড থেকে নিজের গবেষণাকাজের ফান্ড পাওয়া যায়। বাইরের দেশে পিএইচডি করতে হলে সবার আগে নিজের যাবতীয় তথ্য (নিজের একাডেমিক ও রিসার্চ প্রোফাইলকে হাইলাইট করে) দিয়ে একটি জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করতে হবে। জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে একটা রিসার্চ প্ল্যান দিলে খুব ভালো হয়। রিসার্চ প্ল্যান সুপারভাইজারের গবেষণার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। কীভাবে ভালো মানের জীবনবৃত্তান্ত ও রিসার্চ প্ল্যান লিখতে হবে, সে বিষয়ে অনলাইনে বহু নমুনা আছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রফেসরদের প্রোফাইল ঘেঁটে নিজের পছন্দসই গবেষণার ক্ষেত্র দেখে প্রফেসরদের যথাযথ সম্ভাষণ দিয়ে লিখতে হবে। তবে অবশ্যই সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি আবেদনকারীর যোগ্যতা আগে ভালোভাবে দেখে নিতে হবে এবং নিজের যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রফেসরদের ই-মেইল/আবেদন করতে হবে।

প্রতীকী ছবি

সুপারভাইজার কনফার্ম, ফান্ড কনফার্ম, গবেষণার ক্ষেত্র কনফার্ম, এরপর ভিসা কনফার্ম—এবার সবকিছু গুছিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া। এ ক্ষেত্রে যে দেশে পাড়ি দিতে হবে, আগে থেকেই সেই দেশের নিয়মনীতি, খাদ্যাভ্যাস, আবহাওয়া ইত্যাদি জেনে যতটুকু পারা যায় পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে দেশ থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। তবে দেশত্যাগের আগে মানসিকভাবে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে হবে সব প্রতিকূলতা পাড়ি দেওয়ার জন্য। বিদেশে পৌঁছে ভালো–মন্দ দুটো অনুভূতিই মনকে পুলকিত ও শিউরে তুলবে। বিদেশ সবার কাছে একটু হলেও ভিন্ন অনুভূতি। একদিকে যেমন দেশের প্রিয় মানুষদের ছেড়ে অনেকটা অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানো বেশ দুরূহ; ঠিক তেমনই নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, নতুন স্থান, নতুন খাবার, নতুন মানুষ—সবকিছু একটু ওলট–পালট মনে হবে। সেটাই স্বাভাবিক! এসব বিষয় একজনের পক্ষে একসঙ্গে সামাল দেওয়া একরকম চ্যালেঞ্জের বিষয়। কেননা, পরিবার–পরিজন ছেড়ে যখন দেশের সীমানা পার হতে হয়, ঠিক তখনই অনুভূত হয় দেশের টান, মাটি ও মানুষের টান। মনে পড়ে দেশীয় খাবারের স্বাদ, দেশীয় ভাষার টান, সর্বোপরি দেশীয় মানুষের সঙ্গ। নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সবাইকে এ সময় মনের বিরুদ্ধে বেশ যুদ্ধ করা লাগতে পারে। তবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। এ পরিস্থিতিকে খুব সহজে মোকাবিলা করতে সেখানকার দেশি ও বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটানো দরকার। শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং। নিজের গণ্ডির ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে সমস্যাগুলো বন্ধুদের ভেতর নির্দ্বিধায় খুলে বলতে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই ভালো ফল দেবে।

ছবি: সংগৃহীত

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিএইচডি শুরুর আগে ‘কোর্স ওয়ার্ক’ থাকে। অনেক দেশে পিএইচডি শুরু করার আগে মাস্টার্স করা লাগে। এ সময় তাত্ত্বিক পড়ালেখা, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন বা অন্য শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার মতো বেশ কিছু কাজ করতে হয়। এই কোর্স ওয়ার্কের ভেতর দিয়েই পিএইচডির হাতেখড়ি শুরু হয়। ৬ মাস বা ১ বছর বা ২ বছর (দেশে দেশে ভিন্নতা আছে) কোর্স ওয়ার্কের ভেতর ক্রেডিট আওয়ার, ক্রেডিট পয়েন্ট, পাস-ফেল ইত্যাদি ইন্ডিকেটর থাকে। এগুলো নির্ধারিত সময়ের ভেতর শেষ করতে হয়। আবার ওই সময়ের ভেতর নিজের গবেষণার পরিকল্পনা বা গবেষণা প্রস্তাব (রিসার্চ প্রপোজাল) বা ওপেনিং রিপোর্ট তৈরি করতে হয়।

পিএইচডির গবেষণার শুরুতে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। কেননা, আমেরিকায় বা ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাকে বলে ক্যান্ডেডেন্সি পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটা বেশ দুরূহ। এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত এক্সপার্ট কমিটির (যেখানে এক্সটারনাল এক্সপার্টও থাকবে) সামনে শিক্ষার্থীকে নিজের ভবিষ্যৎ গবেষণার ডিটেলস আউটলাইন উপস্থাপন করতে হয়। সেখানে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা নিরূপণ করে কেন এ গবেষণার ক্ষেত্র বেছে নিয়েছেন, তার ওপর হাইপোথিসিস এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমস্যা সমাধানের টাইমলাইন দিতে হয়। এ জন্য প্রার্থীর সাজানো ওয়ার্ক প্ল্যানের পক্ষে–বিপক্ষে সুগভীর জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। এক্সপার্ট কমিটি এসব হাইপোথিসিসের সত্যতা যাচাই করার জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়ার পরেই এক্সপার্ট কমিটি সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থী পরবর্তী স্টেপে যাওয়ার উপযোগী কি না! এ বিষয়গুলো অতটা কঠিন নয়। নিজের গবেষণা–সম্পর্কিত সাম্প্রতিক কিছু পাবলিকেশন বের করে সেখান থেকে নিজের ব্রেন খাটিয়ে নিজের মতো করে ওয়ার্ক প্ল্যান বা রিসার্চ প্রপোজাল সাজানো যায়। পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য নিজের ল্যাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা/ইনস্ট্রুমেন্ট আছে, সেই সক্ষমতার কথা চিন্তা করেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ সমাধান, একটি আনকোরা সমাধান নিয়েই এ প্রপোজাল লিখলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রচুর পড়ালেখা করতে হয়। সাম্প্রতিক বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখে একমাত্র ক্রিয়েটিভ থিঙ্কিং এ ক্ষেত্রে ভালো ফল দেবে।

সাফল্যের সঙ্গে রিসার্চ প্রপোজাল শেষ করার পর ল্যাবের কাজ শুরু করতে হয়। রিসার্চ প্রপোজাল অনুযায়ী এখানে কাজ করতে গিয়ে কিন্তু অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা, প্রপোজাল অনেকটা কাল্পনিক যেটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার সক্ষমতা একমাত্র পিএইচডি ক্যান্ডিডেটের। এ ছাড়া কোনোরকম ল্যাব ওয়ার্কের জাস্টিফিকেশন ছাড়া প্রপোজাল লিখতে হয় (আমার ক্ষেত্রে হয়েছিল)। তাই এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে সেটা না মেলার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কারও ক্ষেত্রেও মিলে গেলে সে ক্ষেত্রে তিনি লাকি। না মিললে তো আর বসে থাকা যাবে না। কেন হচ্ছে না, বিকল্প পথে গিয়ে সেটার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ রকম অনেক ‘ব্যর্থতা’ও কিন্তু পিএইচডি ডিগ্রির অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। নিত্যনতুন জ্ঞান সন্ধানের জন্য এসব ব্যর্থতায় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রার্থীর ভেতরে আরও বেশি জানার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। তাই প্রার্থীকে নিজেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।

পিএইচডি সুপারভাইজার শুধু একজন শিক্ষার্থীকে কিছু দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নিজেই তাঁর ড্রাইভিং সিটে বসেন। গাড়ি কোন দিকে চালনা করলে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহজ হবে, সেটা শিক্ষার্থীকেই নির্ধারণ করতে হবে। সুপারভাইজার বা কো-সুপারভাইজার শুধু হেলপারের কাজটি করতে পারেন, এর বেশি না। কেউ যদি মনে করেন, সুপারভাইজার তাঁকে সব সমস্যার সমাধান বের করে দেবেন, তাহলে সেটা ভ্রান্ত ধারণা। তবে এ কথা সত্য, সময়ে সময়ে শিক্ষার্থীকে তাঁর সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে সুপারভাইজার বা কো-সুপারভাইজারের সঙ্গে আলোচনা করলে অনেক সমস্যার সমাধান বের করতে সহজ হয়। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এ আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুপারভাইজার এটা নিয়ে ল্যাব মিটিং বা গ্রুপ মিটিংয়ের ব্যবস্থা করেন। বাইরের দেশের ব্যাপারে এই গ্রুপ মিটিং বা ল্যাব মিটিং সম্পর্কে আমার ডিটেলস ধারণা নেই। তবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা খুব কমন একটা চিত্র। আমাদের কলেজের ৩ জন অধ্যাপকের সমন্বয়ে একটি গ্রুপ আছে। এই তিন অধ্যাপক, যতজন শিক্ষার্থী (মাস্টার্স ও পিএইচডি) সুপারভাইজড করেন, তাঁদের নিয়ে প্রতি ১৫ দিন পরপর একবার গ্রুপ মিটিং করেন। এখানে আমরা আমাদের বিগত ১৫ দিনে কী করেছি বা ভবিষ্যতে কী করতে যাচ্ছি, সেগুলো উপস্থাপন করি।

এতে বেশ কিছু সুবিধা যেমন আছে, ঠিক তেমনি অসুবিধাও আছে। সুবিধা হচ্ছে নিজের কাজ সময়মতো শেষ করার জন্য একটা তাড়া থাকে। সমস্যাগুলো আলোচনা করা যায় এবং অন্যদের সাজেশন নেওয়া যায়। অসুবিধা হচ্ছে মাঝেমধ্যে এই মিটিং নিয়ে বেশ মানসিক চাপের মধ্যে থাকা লাগে। তবে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে রুটিনমাফিক ল্যাব মিটিং বা গ্রুপ মিটিংয়ের সুবিধা অনেক বেশি।
পাবলিকেশনে সুনির্দিষ্ট স্টোরি লাইন থাকতে হবে

পিএইচডি থিসিসে কমপক্ষে ৩টি থেকে ৪, ৫ বা ৬টি এক্সপেরিমেন্ট সংযোজন করতে হয় (সুপারভাইজার, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নির্ভর করে)। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যাতে প্রতিটি এক্সপেরিমেন্ট থেকে কমপক্ষে একটি করে পাবলিকেশন করতে পারেন, সে দিকে লক্ষ্য নিয়ে এগোনো ভালো। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিটি এক্সপেরিমেন্ট একটির সঙ্গে অন্যটি যেন রিলেটেড হয়। অর্থাৎ কোনোরকম খাপছাড়া হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে গোটা থিসিসের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট স্টোরিলাইন থাকতে হবে।

প্রতিটি এক্সপেরিমেন্ট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীকে পাবলিকেশনসে জন্য ডিটেলস আউটলাইন করা উচিত। এই আউটলাইন হবে একটি স্টোরি লাইনের ওপর নির্ভর করে। কেননা, প্রতিটি পাবলিকেশনসে একটি সুনির্দিষ্ট স্টোরিলাইন থাকতে হবে। সেই স্টোরিলাইন অনুযায়ী পাবলিকেশনের জন্য নিজের ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখে ফেলতে হবে। এক্সপেরিমেন্ট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে পাবলিকেশনের দিকে নজর দিলে বেশ কিছু সুবিধা আছে। যেমন ম্যানুস্ক্রিপ্ট লেখার সময়ে ওই একই এক্সপেরিমেন্টের অনেক উইক পয়েন্ট ধরা পড়তে পারে বা এক্সপেরিমেন্টের সঙ্গে আরও নতুন কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের প্রয়োজন পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সেটা করা যায়। সব স্ট্যান্ডার্ড সম্পন্ন হলে ফাইনাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখে যে জার্নালের ক্রাইটেরিয়া ফুলফিল করে সেখানে সাবমিট করার জন্য ম্যানুস্ক্রিপ্টের ফর্মেট করতে হয়। পাবলিকেশনের জন্য সঠিক জার্নাল বাছাই ও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ক্ষেত্রে সুপারভাইজার বা কো-সুপারভাইজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেকোনো এক্সপেরিমেন্ট পাবলিশড হওয়া মানে সেটা স্থায়ীভাবে ভেলিডেশন হওয়া। তাই যত দ্রুত পারা যায় পাবলিকেশনের দিকে নজর দেওয়া উচিত। এ ছাড়া যেকোনো প্রি–রিভিউ বা ভালো মানের জার্নালে পাবলিকেশন বেশ দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া। তাই এক্সপেরিমেন্ট শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কোনোরকম আলসেমি না করে পাবলিকেশনের দিকে নজর দিতে হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার পিএইচডি ডিগ্রির জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক পাবলিকেশন লাগে, সেটিও সময়ের ভেতর চুকে যায়। এ ছাড়া দ্রুত পাবলিকেশনে আরও কিছু সুবিধা আছে। যেমন সুপারভাইজার শিক্ষার্থীর প্রতি বেশ প্লিজড থাকে, পিএইচডি ডিগ্রির সঙ্গে সঙ্গে পাবলিকেশনের ঝামেলার পাঠ চুকে যায়, সর্বোপরি শিক্ষার্থীর মানসিক প্রেশার অনেক কমে যায়।

পাবলিকেশন থাকলে শিক্ষার্থীদের মূল থিসিস লেখা নিয়েও তেমন কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা নয়।

থিসিসের সুনির্দিষ্ট স্টোরিলাইনের ওপর ভিত্তি করে পাবলিকেশন হলে শুধু সেগুলোকে সাজিয়ে লিখলেই মূল থিসিস রেডি হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি এক্সপেরিমেন্টের একটির সঙ্গে অন্যটির গভীর মিল খুঁজে বের করে থিসিস লিখতে হবে। যেমন আগের এক্সপেরিমেন্টে এ অসুবিধা ছিল, পরবর্তী এক্সপেরিমেন্ট করে ওই সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। একইক্রমে ধারাবাহিকভাবে বাকি এক্সপেরিমেন্টগুলোরও একটির সঙ্গে অন্যটির যোগসূত্র থাকতে হবে।

থিসিসের এক্সপেরিমেন্ট সাজিয়ে তার সঙ্গে ‘জেনারেল ইন্ট্রোডাকশন’ ও ‘লেটারেচার রিভিউ’ পার্ট যুক্ত করে থিসিসের ড্রাফট লিখে প্রি-ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। বলে রাখা ভালো, প্রি-ডিফেন্সের সময় থিসিসের হার্ড কপি সাবমিট করা লাগে (বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরে নির্ভর করে)। যদিও এই কপি পরবর্তীকালে পরিমার্জন ও সংশোধন করা যায়। প্রি-ডিফেন্সের পার্ট ও বেশ কঠিন। এখানেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত এক্সপার্ট কমিটির সামনে প্রার্থীর বিগত দিনের যাবতীয় অর্জন উপস্থাপনা করতে হয়। এ সময়ে এক্সপার্ট কমিটি প্রার্থীর শেষ করা প্রতিটি এক্সপেরিমেন্টের সায়েন্টিফিক ভেলিডেশন করবেন। সে ক্ষেত্রে যদি আগে থেকে পাবলিকেশন থাকে, তাহলে প্রার্থীর জন্য অনেক বেশি সুবিধা হয়। কেননা, সেগুলো ইতিমধ্যে ভেলিডেশন শেষ। তবে প্রি-ডিফেন্সের সময়ে প্রত্যেকে এক্সপার্ট পাবলিকেশনের সঙ্গে সঙ্গে থিসিসের স্টোরিলাইনের ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও এক্সপার্টদের পক্ষ থেকে প্রার্থীর জন্য অনেক বেশি সাজেশন থাকে। এক্সপার্টদের সাজেশন অনুযায়ী থিসিস সংশোধন করে জমা দেওয়া লাগে। এ ক্ষেত্রে খুব বেশি সময় প্রার্থী পান না। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এর পরবর্তী স্টেপে থিসিসের plagiarism/similarity (অন্যের লেখা বা এক্সপেরিমেন্ট কপি করা হয়েছে কি না, যাচাই করা) চেকের জন্য পাঠানো হয়। সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই চেক করা হয়। প্ল্যাগারিজম রেজাল্ট ২০ শতাংশের বেশি হলে প্রার্থী কোনোভাবেই পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন না।

এরপরের ধাপ পার করাটা একজন প্রার্থীর পক্ষে একটু বেশি কঠিন। যেটাকে বলা হয় ব্লাইন্ড রিভিউ প্রক্রিয়া, যেখানে প্রার্থীর ও তাঁর সুপারভাইজারের কোনোরকম তথ্য ছাড়াই এই রিভিউ প্রসেস হয়ে থাকে। ব্লাইন্ড রিভিউয়ের পূর্বে প্রতিটি কলেজে জমাকৃত পিএইচডি শিক্ষার্থীর থিসিসের ফরম্যাট চেক করে গ্র্যাজুয়েট স্কুলের কাছে পাঠানো। গ্র্যাজুয়েট স্কুল সম্পূর্ণ ব্লাইন্ড রিভিউ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে।

গ্র্যাজুয়েট স্কুল চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়। প্রদেশভিত্তিক এ স্কুলের কাজ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি প্রার্থীর থিসিসের ব্লাইন্ড রিভিউসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করা। গ্র্যাজুয়েট স্কুল থিসিস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থিসিসের কনটেন্ট দেখে রিলেটেড রিভিউয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, যেখানে প্রতিটি থিসিসের রিভিউ করার জন্য তিনজন রিভিউয়ারের কাছে পাঠানো হয়। মোটামুটি মাসখানেকের মধ্যে (সামান্য কমবেশি হতে পারে) রিভিউ সম্পন্ন হয়ে ফলাফল চলে আসে। এখানে রিভিউয়ার, প্রার্থীর থিসিস মূল্যায়ন করতে বিভিন্ন ক্যাটাগরির ওপর নম্বর দিয়ে থাকেন, যেগুলো যোগ করে গ্রেড নির্ধারিত হয়। এই গ্রেডের ওপরই নির্ভর করে একজন প্রার্থীর বিগত চার বছরের ফলাফল।

রেজাল্টের ক্যাটাগরি থাকে A, B, C, D এবং প্রতিটি ক্যাটাগরিকে প্রাপ্ত নম্বরের ওপর এভাবে সাজানো হয়: A=৮৫-১০০, B=৭৫-৮৪, C=৬০-৭৪, D<৬০। তিনজন রিভিউয়ারের প্রাপ্ত গ্রেড যদি এমন হয়: AAA, AAB, ABB, BBB; তাহলে তিনি পাস। কমপক্ষে দুইটি C বা একটা D পেলেই তিনি ফেল।

একটা C পেলে পুনরায় আরেকবার (১ জনের কাছে) তাঁর থিসিস পাঠানো হয় নতুনভাবে ব্লাইন্ড রিভিউতে। তবে প্রার্থী যে গ্রেডই পেয়ে থাকুক, রিভিউয়ারের কমেন্টের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জবাব দিতে না পারলে সুপারভাইজার ফরমাল ডিফেন্সের অ্যারেঞ্জ করবেন না। ফরমাল ডিফেন্সের পর আরও কিছু প্রক্রিয়া শেষ করে পিএইচডির পাট চুকাতে হয়।

এই ব্লাইন্ড রিভিউ প্রসেসে কতটা গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়, সেটা ইতিমধ্যে যাঁরা চীনে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন, তাঁরাই অনুধাবন করতে পারবেন। বাইরের দেশগুলোতে এই নিয়ম আছে কি না, আমার জানা নেই। শুনেছি, যদি থিসিস মূল্যায়ন কমিটি/এক্সপার্ট কমিটি এবং সুপারভাইজার রাজি থাকেন, তাহলে সেখানে ডিগ্রি পেতে সমস্যা হয় না। কিন্তু চীনের এই ব্লাইন্ড রিভিউ প্রসেসে সুপারভাইজাররা একেবারে নিরুপায়। চীনাদের নিয়মের এতটা কড়াকড়ির কারণ সম্পর্কে আমার কো-সুপারভাইজার বলেছিলেন, ‘কোয়ালিফায়েড ক্যান্ডিডেট ছাড়া অন্য কারও জন্য পিএইচডি ডিগ্রি নয়। গবেষণার ক্ষেত্রে যাতে কোনো স্বজনপ্রীতি বা তেলবাজি না হয়, এ জন্য চীনের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় এত কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।’

সাফল্যের সঙ্গে ব্লাইন্ড রিভিউ পাস করার পর রিভিউয়ারের কমেন্ট মোতাবেক থিসিস পেপার পরিমার্জন ও সংশোধন করে চূড়ান্ত ফরমাল ডিফেন্সের জন্য প্রস্তুত করতে হয়। সাধারণত সুপারভাইজার ফরমাল ডিফেন্সের আয়োজন করেন। এ ক্ষেত্রেও বাইরের এক্সপার্টের সঙ্গে কলেজের এক্সপার্ট টিম নিয়ে গঠিত কমিটির সামনে প্রার্থী তাঁর চূড়ান্ত ডিফেন্স উপস্থাপনা করেন। বিগত দিনগুলোর ফলাফল যদি প্রার্থীর পক্ষে থাকে, তাহলে বলা যায়, চূড়ান্ত ডিফেন্স খুব বেশি কঠিন কিছু নয়, কেবল আনুষ্ঠানিকতা। তারপরও এখানে থিসিসের বেশ কিছু সংশোধন দিয়ে থাকেন এক্সপার্ট কমিটি। সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পরের কাজটুকু একজন পিএইচডি প্রার্থীর জন্য বেশ আনন্দের। এরপর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রার্থীর আনুষ্ঠানিক ডক্টরেট স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এই হলো অতিসংক্ষেপে পিএইচডি ডিগ্রির সারসংক্ষেপ। পিএইচডি চলাকালে একজন প্রার্থী তাঁর ব্যক্তিত্বকে পূর্ণরূপে ভেঙে আরও মজবুত করে তোলেন। এ প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করে পিএইচডি সুপারভাইজারের জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর। এখানে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়।

একটা সমাধান করতে করতেই অন্য দুইটি সমস্যা এসে দাঁড়ায়, যেগুলো একজন শিক্ষার্থীর নিজের চিন্তাশক্তিকে অনেকাংশে বাড়িয়ে কঠিন ও বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করে।

বিজ্ঞান সব সময় পরীক্ষিত ও প্রমাণিত। বিজ্ঞানের বিষয়াদি ল্যাবওয়ার্ক ছাড়া কখনো সম্ভব নয়। তাই অনলাইন পিএইচডি থেকে সব সময় দূরে থাকুন। এটি হলো প্রভাবশালী, পয়সাওয়ালা, ভণ্ড ও প্রতারকদের জন্য। যদিও কর্মক্ষেত্র ফায়দা লোটা এবং নিজেকে লোকদেখানো বিদ্বান বলে জাহির করতে আমাদের সমাজে এ ধরনের সুযোগসন্ধানীদের সর্বত্রই দেখা যায়।

পিএইচডি ডিগ্রি একজন প্রার্থীর জ্ঞানের পরিধি বিস্তরভাবে বাড়ায়। যাঁদের ভবিষ্যতে গবেষণা পেশায় থাকার ইচ্ছা আছে, কেবল তাঁদেরই পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ইচ্ছা পোষণ করা উচিত। পিএইচডি শুরু করার আগে অনেক বিষয়াদি জেনেশুনে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমি এখানে খুব সংক্ষেপে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম। আগ্রহীরা অনলাইন ঘাঁটলে আরও অনেক বেশি তথ্য জানতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশ, কাল, বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সব কথার মোদ্দাকথা হলো পিএইচডির পুরো সময়টা নিয়মে ঘেরা।

নিদারুণ মানসিক চাপ, কঠিন অধ্যবসায়, সফলতা-ব্যর্থতার বহু স্মৃতি নিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছালে শেষ হাসিটা কিন্তু আপনিই হাসবেন।

লেখক: অজয় কান্তি মন্ডল, গবেষক, ফুজিয়ান অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজো, ফুজিয়ান, চীন