জার্মানিতে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয়ে কীভাবে পড়বেন: পর্ব ২

বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ জার্মানি। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রসরমাণ এ দেশ শিক্ষাসহ নানা দিক দিয়ে ইউরোপের শীর্ষে। দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত আধুনিক ও যুগোপযোগী। আছে বিশ্বের অনেক নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানিতে পড়াশোনা নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের চার পর্বের দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আজ—

ফাইল ছবি

কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়, পছন্দের বিষয় ও অন্যান্য যোগ্যতার খুঁটিনাটি খুঁজবেন? এ জন্য আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে নিচের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারা। ওয়েবসাইটটি খুব সহজভাবে (ইউজার ফ্রেন্ডলি) তৈরি করা হয়েছে, যাতে সহজেই ভর্তিসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে সব ধারণা নিতে পারেন। ওয়েবসাইটের বাঁ পাশের শূন্য ঘরগুলোতে নিজের চাহিদা অনুযায়ী পছন্দের সাবজেক্টের প্রয়োজনীয় শব্দ ইংরেজিতে বসিয়ে দিলে পছন্দের সাবজেক্টগুলো ডান পাশের ঘরে চলে আসবে। যে বিষয়টি পছন্দ হবে, সেখানে ক্লিক করলে বিস্তারিত সবকিছু চলে আসবে। সেখানে নিজের যোগ্যতা যাচাই করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় কী চাচ্ছে, আপনার কতটুকু যোগ্যতা আছে, সেই বিষয়গুলো বিস্তারিত জানা যাবে। এ ক্ষেত্রে কোর্স কো-অর্ডিনেটরকে ই–মেইল করেও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

জার্মানিতে ভর্তির জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি চালু আছে। একটি হচ্ছে ওপেন অ্যাডমিশন, অন্যটি অ্যাপটিচুড টেস্ট। প্রথমটির ক্ষেত্রে শুধু ব্যচেলরের ফলাফল ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে ভর্তি নেওয়া হয়। অন্যটিতে কাগজপত্র যাচাইয়ের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষাও দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবিষয়ে বেসিক জ্ঞানসহ আইকিউ–টাইপ প্রশ্নের প্রিপারেশন নিতে হয়। তাই সহজে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ওপেন অ্যাডমিশন পদ্ধতিটিই ঝামেলামুক্ত।

ফাইল ছবি

জার্মানিতে সাধারণত দুই ভাষায় পাঠ্যদান করা হয়ে থাকে। জার্মান ও ইংরেজি ভাষা। যদি কেউ জার্মান ভাষায় মাস্টার্স করতে চান, সে ক্ষেত্রে বি-১ পর্যন্ত ভাষা কোর্স সম্পন্ন রাখা বাধ্যতামূলক। তবে কিছু ক্ষেত্রে সি-১ লেভেলের সনদও লেগে থাকে। এ কোর্স ঢাকা (জার্মান ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র) থেকে করা যায়। তবে কেউ ইংরেজিতে মাস্টার্স করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ইংরেজি ভাষার সনদপত্র বিভিন্ন রকম চেয়ে থাকে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় যদি দেখে শিক্ষার্থীর স্নাতকের পাঠদানের মাধ্যম ইংরেজি, তখন অনেক সময় আইইএলটিএস চায় না। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আইইএলটিএস বা টেল্ক বা টোয়েফলের উচ্চ স্কোরের সঙ্গে সঙ্গে জিআরই চায়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকেই এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে (Requirements for admission সেকশনে) যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি দক্ষতার সনদ চেয়ে থাকুক বা না থাকুক আপনাকে কমপক্ষে আইইএলটিএস ৬ তুলতেই হবে, নতুবা জার্মান দূতাবাসের ইন্টারভিউ থেকে বাদ পড়ে যাবেন। কারণ, সেখানে আপনাকে সর্বনিম্ন ৬ স্কোর দেখাতেই হবে।

আরও পড়ুন

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে বিষয়ে মাস্টার্স করার জন্য আবেদন করছেন, তা যেন আপনার স্নাতকের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এর জন্য আপনি আবেদন করার আগে কোর্স কো-অর্ডিনেটরকে একটি ই–মেইল করে আপনার স্নাতকের বিষয় নিয়ে একটু ধারণা দিতে পারেন। যেমন আপনি স্নাতকে কী কী বিষয় পড়েছেন, সঙ্গে আপনার অর্জিত সিজিপিএ উল্লেখ করে দেবেন। তার কাছে আরও জানতে চাইবেন, তার ওই বিভাগে আপনি মাস্টার্স করার জন্য উপযুক্ত কি না। দেখবেন, তিনি দু-তিন কর্মদিবসের মধ্যেই আপনার ই–মেইলের রিপ্লাইয়ে বলে দেবেন, আপনার কী কী করতে হবে বা আপনি আবেদন করার যোগ্য কি না।

আরও পড়ুন
জার্মানিতে সাধারণত দুই ভাষায় পাঠ্যদান করা হয়ে থাকে। জার্মান ভাষা ও ইংরেজি ভাষা। যদি কেউ জার্মান ভাষায় মাস্টার্স করতে চান, সে ক্ষেত্রে বি-১ পর্যন্ত ভাষা কোর্স সম্পন্ন রাখা বাধ্যতামূলক। তবে কিছু ক্ষেত্রে সি-১ লেভেলের সার্টিফিকেটও লেগে থাকে। এ কোর্স ঢাকা (জার্মান ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র) থেকে করা যায়। তবে কেউ ইংরেজিতে মাস্টার্স করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে ইংরেজি ভাষার সনদপত্র বিভিন্ন রকম চেয়ে থাকে।

জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত দুই পদ্ধতিতে আবেদন গ্রহণ করে থাকে—
১.
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বয়ং কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে বিনা মূল্যে আবেদন করা যায়।
২.
ইউনি অ্যাসিস্ট নামের সংস্থা শিক্ষার্থীর কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য খরচ করতে হয় ৭৫ ইউরো (আনুমানিক ৯ হাজার টাকা)। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের ক্ষেত্রে পরের প্রতিটির জন্য ৩০ ইউরো (আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার টাকা) করে দিতে হয়। বর্তমানে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় এ সংস্থার মাধ্যমে ভর্তি প্রসেস করে থাকে। জার্মানির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার জন্য প্রসেসিং ব্যবস্থা মূলত দুটি ধাপে সম্পন্ন হয়।

অ্যাডমিশন লেটারপ্রাপ্তি

আপনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন লেটার পেয়েছেন মানে এই নয়, আপনি ভর্তির জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন বা বিনা বাধায় জার্মানিতে আসতে পারবেন। আপনাকে এরপর পরবর্তী ধাপের জন্য, অর্থাৎ জার্মান ভিসার ধাপটিও পাড়ি দিতে হবে।

আরও পড়ুন

জার্মান ভিসাপ্রাপ্তি

এটা হচ্ছে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসার শেষ ধাপ। ভিসা পেয়ে গেলেই জার্মানিতে আসার সব পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল।
প্রথমেই আসা যাক অ্যাডমিশন লেটারপ্রাপ্তির জন্য কী কী করণীয়—
১.
প্রথমেই ইউনি অ্যাসিস্ট ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজের নামে একটি আইডি খুলতে হবে। তারপর যেখানে আবেদন করবেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবজেক্ট সেকশনে ঢুকে নির্ভুল তথ্যগুলোই ফরমে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এখানকার আপলোড সেকশনে নিজের যাবতীয় সনদপত্র, ভাষার সনদপত্র, মোটিভেশন লেটার সংযুক্ত করতে হবে। ফরমটি অনলাইনে সাবমিট করলে অটো পিডিএফ কপি জেনারেট হবে। সেই ফরম প্রিন্ট করে নির্ধারিত জায়গায় স্বাক্ষর করতে হবে।
২.
বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে ক্লিক করে পছন্দের সাবজেক্টের পেজে ঢুকে আবেদনপত্র ডাউনলোড করে প্রিন্ট দিতে হবে। সেটা নিজ হাতে পূরণ করতে হবে অথবা অনলাইনে পূরণ করে অটোজেনারেটেড পিডিএফ কপি প্রিন্ট করে নির্ধারিত স্থানে স্বাক্ষর করতে হবে।
৩.
যেখানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন, সেই বিভাগের দুজন, ক্ষেত্রবিশেষে তিনজন অধ্যাপক (সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপক হলেও হবে) থেকে রিকোমেন্ডেশন লেটার নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অফিশিয়াল প্যাড ব্যবহার করতে হবে। রিকোমেন্ডেশন লেটারে অবশ্যই সিলেক্টেড সাবজেক্টের নাম ও কোথায় পড়তে যাবেন, সেটা উল্লেখ থাকতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষক তাঁকে সেখানে পড়তে যেতে উৎসাহ প্রদান করছেন, সে বিষয়েও লক্ষ রাখতে হবে।

৪.
স্নাতকের সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট, আইইএলটিএস সার্টিফিকেট ও এসএসসির সার্টিফিকেট কোনো সরকারি উকিল থেকে নোটারি করতে হবে অথবা জার্মান দূতাবাস থেকে সত্যায়িত করিয়ে নিতে হবে।
৫.
একটি মোটিভেশনাল লেটার লিখতে হবে। স্যাম্পল কপি গুগলে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। এখানে যে বিষয়ে পড়তে যাবেন, সেই বিষয়ে ভালো লাগা, ভালোবাসা ও পূর্বের অভিজ্ঞতার কথাগুলো সাজিয়ে–গুছিয়ে লিখতে হবে। চাইলে চ্যাটজিপিটি থেকে সাহায্য নিতে পারেন। তবে চেষ্টা করবেন ধার করা স্ক্রিপ্ট না নিয়ে নিজের মনের ভেতরের কথাগুলো উল্লেখ করতে। লেখাগুলো যেন তৈলাক্ত না হয় এবং অনুপ্রেরণামূলক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।

ফাইল ছবি

৬.
ইউনি অ্যাসিস্ট ওয়েবসাইটে টাকা পাঠানোর জন্য ওয়েবসাইটে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেইল উল্লেখ করা আছে। আবেদনপত্রসহ পাসপোর্ট নিয়ে যেকোনো ব্যাংকের বৈদেশিক বিনিময় শাখায় যেতে হবে। সেখান থেকে ৭৫ ইউরোর সমপরিমাণ টাকা ইউনি অ্যাসিস্টের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করতে হবে। একটা প্রুফ কপি সেখান থেকে নিয়ে নিতে হবে। এখানে টাকা পাঠানোর দিকনির্দেশনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষই দিয়ে দেবে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড (মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড, পেপল) থাকলে সহজেই এ টাকা ট্রান্সফারের জটিলতা অবশ্য এড়ানো যায়।

৭.
কাগজগুলো নিচের সিরিয়াল অনুযায়ী সাজাতে হবে।
ক.
টাকা পাঠানোর প্রুফ কপি।
খ.
ইউনি অ্যাসিস্টের আবেদনপত্র।
গ.
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনপত্র।
ঘ.
স্নাতকের সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট ও এসএসসির সনদপত্রের নোটারাইজড বা সত্যায়িত কপি।
ঙ.
মোটিভেশন লেটার।
চ.
রিকোমেন্ডেশন লেটার দুটি বা তিনটি।
ছ.
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইংরেজি মাধ্যমের কপি (যদি থাকে)।
জ.
আইইএলটিএসের নোটারাইজড বা সত্যায়িত কপি।

আরও পড়ুন
জার্মানিতে ভর্তির জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি চালু আছে। একটি হচ্ছে ওপেন অ্যাডমিশন, অন্যটি অ্যাপটিচুড টেস্ট। প্রথমটির ক্ষেত্রে শুধু ব্যচেলরের ফলাফল ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে ভর্তি নেওয়া হয়। অন্যটিতে কাগজপত্র যাচাইয়ের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষাও দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে পাঠ্যবিষয়ে বেসিক জ্ঞানসহ আইকিউ–টাইপ প্রশ্নের প্রিপারেশন নিতে হয়। তাই সহজে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ওপেন অ্যাডমিশন পদ্ধতিটিই ঝামেলামুক্ত।
ফাইল ছবি

কাগজগুলো স্ট্যাপল বা পেপারক্লিপে আটকে একটি এ-৪ সাইজের মোটা এনভেলপে ইউনি অ্যাসিস্টের নির্ধারিত ঠিকানায় (ইউনি অ্যাসিস্টের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে) পাঠাতে হবে। তবে সরকারি পোস্ট ব্যবহার না করে ডিএইচএল বা ফেডএক্সে কুরিয়ার করলে আবেদনপত্র কখন কবে পৌঁছাল, সেটা ট্র্যাক করে জেনে আশ্বস্ত হওয়া যায়। আপনার লেটার ও টাকা ইউনি অ্যাসিস্টে পৌঁছানোমাত্র আপনাকে ই–মেইল করে ইউনি অ্যাসিস্ট নিশ্চিত করবে।

তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ইউনি অ্যাসিস্ট আপনাকে দুটি ই–মেইল করে আবেদনের ব্যাপারে আপডেট দিয়ে আশ্বস্ত করবে। প্রথম ই–মেইলটি স্নাতকের ইভালুয়েশন রিপোর্ট, অর্থাৎ জার্মান গ্রেডে আপনার রেজাল্ট কেমন, তা বলবে। দ্বিতীয় মেইলটি বলবে যে আপনার কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর সব ঠিক থাকলে এক–দুই মাসের মধ্যেই আপনি অ্যাডমিশন লেটারটি পেয়ে যাবেন। চলবে...

**আগামীকাল পড়ুন: জার্মানিতে পড়াশোনার খরচ ও ভিসা প্রক্রিয়া কেমন

*লেখক: মাহবুব মানিক, গবেষক, প্লাস্টিক ও রাবার প্রকৌশল, মের্জেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, মের্জেবুর্গ, জার্মানি।