সুইডেনের বাধ্যতামূলক শিক্ষানীতি নিয়ে অভিভাবকেরা কেন তর্ক-বিতর্কে

ছবি: সংগৃহীত

‘স্কুলপ্লিক্ট’ একটা সুইডিশ শব্দ, যার মানে হচ্ছে ‘শিক্ষাবধি’ বা এর বাংলা অনুবাদ হতে পারে ‘বাধ্যতামূলক শিক্ষা’। কিন্তু সুইডেনে স্কুলপ্লিক্ট শব্দটি শুধু প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়। বাধ্যতামূলক শিক্ষা একটি নির্দিষ্ট শিক্ষার বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভর করে অর্থাৎ শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যই ওই বিষয়বস্তুর ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়। আদর্শগতভাবে এটি একটি নির্দিষ্ট বয়স বা শ্রেণিতে অবশ্যই প্রযোজ্য।

অন্যদিকে শিক্ষাবধি বেশির ভাগ সময়ে শিক্ষার আওতাভুক্ত ক্ষেত্র বা সময়কালের জন্য প্রযোজ্য, এমনকি বিভিন্ন অবস্থানে অনুমতি দেওয়া হয়, যেমন হোম স্কুলিং, প্রাইভেট বা অনলাইন শিক্ষা। তাই এটি বিশেষ অবস্থান বা সময়ের জন্য প্রযোজ্য হয়।

সংক্ষেপে বাধ্যতামূলক শিক্ষা একটি সুপ্রযুক্ত শিক্ষা মডেলের অংশ, অন্যদিকে শিক্ষাবধি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বা অনুমতিসহ শিক্ষার আওতাভুক্ত ক্ষেত্র বা সময়কালের জন্য প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন

সে ক্ষেত্রে সংবিধানের আদেশ মোতাবেক নর্ডিক দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নবম শ্রেণি অবধি বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা, যা নর্ডিক দেশগুলোর শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সবার জন্যই এটা বাধ্যতামূলক এবং এটা হওয়া সত্ত্বেও ইদানীং বাবা-মা ক্ষেত্রবিশেষে এটাকে অমান্য করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে লং ডিস্টান্সে ছুটি কাটাচ্ছেন, যা সুইডেনের ইতিহাসে আইন ভঙ্গ করার এক নতুন অধ্যায়।

চলছে জল্পনাকল্পনা, তর্ক–বিতর্ক এ নিয়ে।

সম্ভবত সংসদে সংবিধানের এই আইনের পরিবর্তন করতে হবে সত্বর। দেশের ভ্রমণপ্রিয় বাবা-মা এ আইন পরিবর্তনের জন্য নানা যুক্তি হাজির করেছে এবং এ বিষয় নিয়ে রীতিমতো তর্কবিতর্ক শুরু হয়েছে সারা দেশে।

বেশির ভাগ বাবা-মা বলছেন, অতীতে কর্মজীবনে শারীরিকভাবে হাজির হওয়া এবং কাজ করা ছিল বাধ্যতামূলক, যা এখন সব ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে না, ব্যতিক্রম আছে যেমন যানবাহন, হাসপাতাল, এসব কর্মে কর্মীকে ফিজিক্যালি কাজে যেতে হয় কিন্তু শত শত কাজ রয়েছে, যা অফিসে না গিয়েও করা সম্ভব। যেমন করোনা মহামারির আবির্ভাব হলে অনেক কাজই অফিসে না গিয়ে ঘরে বসে করা সম্ভব হয়েছে, যার ফলে এ যুগে ঘরে বসে যদি কেউ তার কাজ সারতে পারে তাতে কোনো সমস্যা নেই।

আরও পড়ুন

এই যুক্তি ইদানীং দাঁড় করিয়ে বলা হচ্ছে শিশুর অ্যাকটিভ প্রশিক্ষণের জন্য শ্রেণিকক্ষে হাজির থাকার কোনো যুক্তি বা সংবিধান থাকতে পারে না। বরং ভ্রমণে যে শিক্ষা তারা পাচ্ছে, তা শতগুণ বেশি ইফেকটিভ, যার সঙ্গে আমার দ্বিমত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ইদানীং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়েছে জেলহাজতের মতো একটি বদ্ধঘর, যেখানে প্রকৃত জ্ঞানের আলো নেই। আছে শুধু রিপিটেশন, যা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় তার বেশির ভাগই পাঠ্যপুস্তক এবং সিলেবাসের নির্দেশনা অনুযায়ী হয়ে থাকে।

প্রযুক্তির এ যুগে নতুন প্রজন্মকে বদ্ধঘরে বন্ধ করে শতচেষ্টা করলেও এখন আর অতীতের নিয়ম অনুযায়ী পাঠ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, শিক্ষার্থীর দেহ ক্লাসে থাকলেও মন রয়েছে বাইরের জগতে। যে জগতে শুধু নতুনত্বের বাহার, যার গন্ধ সুমধুর এবং যা নতুন প্রজন্ম নিজ থেকে শিখতে চায়, নিজ থেকে জানতে চায়, নিজ মনে ভাবতে চায়। তারা এখন অতীতের জানা তথ্য শুধু তোতা পাখির মতো অনুকরণ করতে চায় না।

তারা নিজের মতো করে প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায় এবং এটা অবশ্যই সম্ভব যদি তারা উন্মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পায়। ভ্রমণে সেটা সম্ভব, কারণ ভ্রমণে রয়েছে আনন্দ, ভ্রমণে রয়েছে বিষাদ, ভ্রমণে রয়েছে অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার চমৎকার সুযোগ, যা পাঠ্যবইয়ে সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী বসে ফ্যাল ফ্যাল করে হয়তো তাকিয়ে আছে শিক্ষকের দিকে, শিক্ষক মনে করছেন শিক্ষার্থী তার কথা মনোযোগসহকারে শুনছে। কিন্তু না, শিক্ষার্থীর দেহ আছে ক্লাসে, মনপ্রাণ পড়ে আছে অন্য জায়গায়, যেখানে সে খুঁজে পেয়েছে তার ভালোবাসার চেনা, জানা, অচেনা, অজানা বা কৌতূহলের রাজ্যে, যে রাজ্যে বেত্রাঘাত নেই, বকাঝকা নেই, আছে শুধু শান্তি।

আরও পড়ুন

আমি অতীতে অনেকবার লিখেছি ‘হেয়ার অ্যান্ড নাও’ কনসেপ্টটি। জীবনে হেয়ার অ্যান্ড নাও–এর মধ্যে থাকা একটি কঠিন কাজ। এর জন্য সারাটা জীবন ব্যয় হতে পারে, তবুও মুহূর্তটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা কঠিন! কারণ, বদ্ধঘরে বন্দী করে আমাদের শেখানো হয় যখন আমাদের থাকার কথা উন্মুক্ত পাঠশালায়, যার ফলে না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মনকে দেহ থেকে সারাক্ষণ বিচ্ছিন্ন করে স্বপ্নের রাজ্যে ভ্রমণে ব্যস্ত রাখে। যার ফলাফল আজকের পৃথিবী, যে পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে শুধু মারছে না, ধরে ধরে রান্না করে খাওয়া শুরু করেছে। বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ এমনটি ঘটে, যা গণমাধ্যমে দেখি, অন্যান্য দেশের কথা নাই–বা বলি। যাহোক আমি অনেক কথাই লিখে ফেললাম মূলত একটি কথা বলতে, সেটা হলো আমাদের শিক্ষা কী? আমরা কেন শিখি এবং কীভাবে সেগুলো শেখা দরকার? অতীতে যেভাবে শেখানো হয়েছে, এখনো ঠিক সেভাবে শেখাতে হবে, সেটা বলার আগে ভাবতে হবে—এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নেই। অতএব পরিবর্তনের যুগে পরিবর্তিত হতে হবে। যদি বলি আগামীকাল পরিবর্তিত হব, তাহলে মনে করবেন আমি এক অলৌকিক জগতে বাস করছি। কারণ, আমার জন্য আগামীকাল বলে কোনো দিন নেই। আমি কোনো দিনই আগামীকাল কিছু করতে পারব না।

কারণ জানতে চান?
তাহলে বলি।
গত বছর শেষের দিন ভেবেছিলাম, আর মাত্র একটা দিন বাকি, নতুন আরেকটি বছর শুরু হবে। অনেক আশা অনেক প্রত্যাশা নতুনত্বের ওপর। সামনে নতুন বছর, ভাবলাম এক তোড়া ফুল কিনব আমার প্রিয় মানুষটির জন্য। স্টকহোমে শহরের মধ্যে হোটোরিয়েট নামে একটি জায়গায় বাজার বসে প্রতিদিনই। ফুল, ফলসহ টুকটাক স্যুভেনির কিনতে পাওয়া যায় এখানে। যারা ফুল বা ফল বিক্রি করে, তাদের সঙ্গে বেশ পরিচিতি আমার। কারণ, বহু বছর একখানে বসবাস করলে যা হয়। তা ছাড়া এসব হকার কেউই সুইডিশ নয়, ভিনদেশ থেকে এসেছে। কথা কম বলে বললে ঠিক হবে না; কারণ যে কথা বলা দরকার, সেটা কম বলে।

তবে রসিকতা করতে চেষ্টা করে বেশি। ভাষার সমস্যা না থাকলে হয়তোবা অন্য কিছু করত। যাহোক সুইডিশে লিখেছে আজ ফুলের দাম অর্ধেক কাল ফ্রি! ভাবলাম এখনো নতুন বছর আসতে পুরো আজ এবং আগামীকাল সারা দিন বাকি। আগামীকাল শহরে আসব যখন, তখন ফুলগুলো ফ্রি পাওয়া যাবে, ঠিক আছে তাহলে আগামীকাল এসে ফুলগুলো নিয়ে যাব। পরের দিন সকাল সকালে শহরে এসেছি। বাজার শেষে ফুল নিতে এসে দেখি সাইনবোর্ডে একই কথা ‘আজ ফুলের দাম অর্ধেক কাল ফ্রি’ লেখা রয়েছে। একটু ভাবনায় পড়লাম! পরে ফুল হোটোরিয়েট থেকে অর্ধেক দামেও কিনলাম না। অন্য একটি দোকান থেকে পুরো দামে কিনে এনেছিলাম।

প্রতিদিনই আমরা একটা দিন বা সময় পার করছি। তবে আগামীকালটার দেখা কোনো দিনই হবে না। আমরা শুধু তার অপেক্ষায় আর প্রতীক্ষায়। তবে একটি বছর কিন্তু অনেক দিন মিলে। সে ক্ষেত্রে একদিন এদিক-ওদিক হলে ক্ষতি কী, পরের দিনটি ভালো গেলে বা পুষিয়ে নিলে গড়ে বছরটি হয়তো ম্যানেজ হয়ে যাবে। এমনটি আশা এবং ভরসা নিয়েই কিন্তু বেঁচে আছি। যাহোক আমি বুঝেছি সেদিন আজ, যা করার সেটা আজই করতে হবে। আমার জন্ম হয়েছে শুধু এখনকার জন্য। এই মুহূর্তে আমি যেটা করছি, এটাই আমার দক্ষতা, বাকি সব কল্পনা। আগামীকাল সব সময় আমাদের জন্য আগামীকাল। তবে আজকের এই দিনিটি আগামীকাল হবে আমাদের জন্য গতকাল। আমি কি কিছু বোঝাতে পারলাম!

ব্যক্তিগতভাবে আমি পরিবর্তনে বিশ্বাসী। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সুইডেন নতুন করে ভাববে। কারণ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কেন্দ্রস্থলে সুইডেন অবস্থিত। এই জাতি প্রগ্রেসিভ মূল্যবোধ, সামাজিক কল্যাণ এবং সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

২১ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিশ্ব যখন লড়াই করছে, ঠিক তেমন একটি সময় সুইডেনের জনগণ প্রকাশ্যে শিক্ষাপদ্ধতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। জলবায়ু এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি শক্তি এবং কার্বন নিঃসরণের স্বল্পমাত্রিক লক্ষ্যে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সাইবার নিরাপত্তা এবং ন্যায্যবিচারে বিনিয়োগ করে স্বার্থকেন্দ্রিক ঝুঁকি ও অপরাধ ঠেকাতে সুইডেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জাতিগত সংলাপের মাধ্যমে সবার জন্য একটি নিরাপদ বিশ্ব তৈরি করতেও সুইডেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন শুধু সুইডেন নয়, আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই উই ক্যান মেক ইট হ্যাপেন। চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।

  • লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]