কানাডায় পড়ার প্রস্তুতি, যে অপ্রথাগত দক্ষতা দরকার: পর্ব-৬

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এখনো এ ধরনের ভলান্টিয়ারি কাজ করেন
ছবি: সংগৃহীত

কানাডায় ফল সেশনে পড়তে আসার প্রস্তুতির ধারাবাহিকতায় আজ ছাপা হচ্ছে, যে অপ্রথাগত দক্ষতাগুলো শিক্ষার্থীদের থাকতে হবে।

ইদানীং যাঁরা কানাডায় পড়তে আসেন, তাঁদের একটি বিরাট অংশ আন্ডারগ্রেডের, অর্থাৎ এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করে কানাডায় আসেন। আর একটি অংশ মাস্টার্স বা উচ্চশিক্ষার জন্য আসে। তাঁদের বয়স কম থাকার কারণে কানাডায় আসার আগে তাঁদের একধরনের ফ্যান্টাসি থাকে, কিন্তু আসার পর বাস্তবতার সম্মুখীন যখন হন, তখন বড় ধরনের একটা ধাক্কা খান। এ ধাক্কা না খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে।

১.

এখানে রান্না থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সব কাজ নিজেকে করতে হবে। তাই রান্না করাসহ বাসার সব কাজ শিখে না এলে আপনাকে বিপদে পড়তে হবে। আর কেউ যদি বাইরে খেতে চান, তাঁদের খরচ কয়েক গুণ বেশি পড়বে।

২.

চরম ঠান্ডার দেশ কানাডা। ঠান্ডা হিমাঙ্কের নিচে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও থাকে বেশ কিছুদিন। এর মধ্যে কোনো কাজ থেমে থাকে না। শীতের জামাকাপড় পড়লে শীত লাগার কোনো আশঙ্কা নেই। শীতের মধ্যে বাইরে বের হতে হয়, তাই এই শীত সহ্য করার শারীরিক ও মানসিক শক্তি থাকতে হবে।

৩.

অনেকেই কানাডায় আসার আগে কোনো দিনই মা–বাবাকে ছেড়ে বাইরে থাকেননি। কানাডায় এলে চাইলেই মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেশে চলে যাওয়া যাবে না। বিমানভাড়া অনেক। তাই হোম সিকনেস দূর করে আসতে হবে।

আরও পড়ুন
কানাডার ভলান্টিয়ারি কাজে অনেক সুবিধা মেলে
ছবি: সংগৃহীত

৪.

বাংলাদেশে যেমন অনেক পণ্যের দাম ওই পণ্যের গায়ে লেখা থাকে। উদহারণস্বরূপ ধরেন কোকাকোলা বা পেপসি। বাংলাদেশে সব মুদিরদোকানে একই দামে বিক্রি হয় কোকাকোলা বা পেপসি, কানাডায় তা নয়। কোনো দোকানে একটি ২ লিটারের কোকাকোলা বা পেপসির দাম ১ ডলার ২৫ সেন্ট। আবার কোনো দোকানে ৪ ডলার ৫০ সেন্ট। অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাই এখানে আসার আগে কেনাকাটা সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে আসতে হবে।

৫.

যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের জন্য কানাডা মোটেই ভালো দেশ নয়। এক প্যাকেট সিগারেটের দাম প্রদেশভেদে ১৮ থেকে ২২ ডলার। তা ছাড়া সরকারি আইন অনুযায়ী, কেউ নিজের বাসার ভেতরও ধূমপান করতে পারেন না। সে ধূমপান করতে হয় বাইরে গিয়ে। অর্থাৎ, খোলা আকাশের নিচে, যা হিমাঙ্কের নিচে ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা কষ্টসাধ্য। আপনার যদি ধূমপানের নেশা থাকে, তা ছেড়ে আসা উচিত।

৬.

কানাডায় প্রায় সব সেবা অ্যাপসভিত্তিক। বাসের সময়, ব্যাংকিং, ক্লাসের টাইম, আজান, আবহাওয়ার সময়—সবকিছু জানতে ব্যবহার করা লাগে আপনার মুঠোফোনের অ্যাপস। এই অ্যাপস ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে আসবেন।

৭.

আপনার মধ্যে থাকতে হবে সেলফ কন্ট্রোল। এখানে মদ-গাঁজা বৈধ, চাইলেই দোকানে বসে মদ পান করতে পারবেন বা বাসায় নিয়ে আসতে পারবেন। পড়াশোনা না করে আপনার মতো বন্ধু জোগাড় করে দিন কাটিয়ে দিতে পারবেন। বাংলাদেশে যেসব ফান সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ, তা চাইলেই এখানে করতে পারবেন। তবে বেশি দিন করতে পারবেন না। পড়াশোনা না করে মা–বাবার টাকায় এ কাজ করলেও সেমিস্টার ড্রপ করলে কিন্তু আপনার ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। ফিরে যেতে হবে দেশে। তাই এসব বিষয় থেকে নিজেকে দূরে থাকার কৌশল শিখে আসবেন।

আরও পড়ুন
অনেকেই কানাডায় আসার আগে কোনো দিনই মা–বাবা ছেড়ে বাইরে থাকেননি। কানাডায় এলে চাইলেই মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেশে চলে যাওয়া যাবে না। বিমানভাড়া অনেক। তাই হোম সিকনেস দূর করে আসতে হবে
ছবি: সংগৃহীত

৮.

কানাডায় চাকরি পেতে হলে রেফারেন্স দরকার অনেক ক্ষেত্রে। তাই সব সময় রেফারেন্স তৈরির কৌশল ও মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর দক্ষতা শিখে আসবেন। নিজ দেশের কমিউনিটির লোকজন, প্রতিবেশী, মসজিদ-মন্দিরে যাঁদের সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত দেখা হবে, তাঁদের সঙ্গে, আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট লিডার, শিক্ষক, লোকাল কানাডিয়ান রাজনৈতিক লিডার, এমপি, এলএমএ, কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। তাঁরাই আপনার রেফারেন্স হবে একসময়।
৯.

কানাডায় চাকরি করতে গেলে আপনার ভলিন্টিয়ারি অভিজ্ঞতা দেখতে চায়। তাই সময় বের করে ভলিন্টিয়ারি করতে হয় কানাডাতে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বৃদ্ধাশ্রম, স্কুল, মসজিদ, গির্জা, ফুড ব্যাংক, যেকোনো এনজিও, যেকোনো জায়গায় করতে পারেন। আপনি মুসলিম হলেও চার্চে ভলিন্টিয়ারি করতে পারেন। যেখানেই করেন না কেন, তাদের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেবেন। ভলিন্টিয়ারিকে অনেকের কাছে মনে হতে পারে ‘শুধু শুধু কাজ করা’, কিন্তু তা নয়। এ সার্টিফিকেট পরে আপনার অনেক কাজে দেবে এবং তৈরি হবে রেফারেন্স লিংকেজ। তাই কানাডায় আসার আগে ‘বেগার খাটা’র মানসিকতা নিয়ে আসবেন।
১০.

নতুন পরিবেশে অনেকে বাইরে কথা বলতে চান না বা লজ্জা পান। তার ওপর অন্য একটি ভাষার দেশ। অনেকে ভাবতে পারেন, কথা বলার সময় আপনার ইংলিশ হয়তো ভালো হবে না। এ চিন্তা মাথায়ও আনবেন না। ইংলিশ ভুল হলেও ক্ষতি নেই। কয়েক দিন পর দেখবেন এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। কানাডায় চাকরিতে যেমন আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখা হয়, ঠিক তেমনি দেখা হয় আপনার নেতৃত্বের গুণাগুণ। তাই আপনাকে হতে হবে ভোকাল এবং থাকতে হবে নেতৃত্বের গুণাবলি।

আরও পড়ুন
লেখক
আরও পড়ুন

১১.

আপনাকে খণ্ডকালীন চাকরি করতে হবে কোনো রেস্তোরাঁ বা স্টোরে। এসব জায়গায় বসে কাজ করার সুযোগ নেই। এক দিনে আট ঘণ্টা কাজ করতে হয় দাঁড়িয়ে বা হেঁটে হেঁটে। কাজগুলো শারীরিক পরিশ্রমের। সব কাজ করতে হয় খুব দ্রুত। তাই বাংলাদেশ থেকে আসার আগে যেকোনো ধরনের কাজ দ্রুততার সঙ্গে করার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে।

১২.

যেকোনো কাজে সময় মেনে চলতে হবে আপনাকে। ক্লাস, আপনার কাজ, বাস ধরা, চিকিৎসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কোনো মিটিংসহ সবকিছু ঠিক সময়ে হয়। দেখা গেল, এক মিনিটের জন্য বাস মিস করলেন, তারপর হয়তো ১৫ মিনিট পরে বাস। ফলে আপনি আপনার কাজে বা ক্লাসে দেরি করে ফেলবেন। এ দেশে ‘বাস মিস করা, রাস্তায় জ্যাম থাকা, ঠান্ডায় বের হতে দেরি হওয়া’—এ ধরনের অজুহাতে কাজে এক মিনিটও দেরি করে আসতে পারবেন না। প্রথম দু–এক দিন দেরি হলে ওই সময়ের টাকা আপনার বেতন থেকে কেটে নেবে আর যদি এ ঘটনা পরপর হতে থাকে চাকরি চলে যাবে।
মনে রাখবেন, পরিবার ছেড়ে সম্পূর্ণ একটি নতুন পরিবেশে আপনি আসছেন। এ পরিবেশে যত দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবেন, ততই আপনার এবং পরিবারের জন্য মঙ্গল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনি যদি আপনার পরিবারের টাকায় কানাডায় বসে শুধু এক কাপ কফিও সাধারণ মানের দোকান থেকে কিনে খান, তাহলে তাদের পাঠাতে হবে বাংলাদেশি টাকায় ২৪০ টাকা। মাসে খরচ হবে ৭ হাজার ২০০ টাকা। এ টাকা এখনো বাংলাদেশে অনেক টাকা।

আগামী পর্ব : কানাডার বিমানবন্দরে ভিসা অফিসার আপনাকে যে প্রশ্ন করবে

আরও পড়ুন