শিক্ষায় উন্নতি সত্ত্বেও অব্যবস্থাপনা কেন

প্রতীকী ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে গত কয়েক অর্থবছরে। কিন্তু তারপরও বরাদ্দ করা অর্থ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। শিক্ষায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু শিক্ষার মান বাড়ছে কি না, এটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ব্যাপক। পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।

কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার চিত্র দেখলে খুব হতাশ লাগে। যদিও পরীক্ষাপদ্ধতির কারণে এ রকম হয়ে থাকে বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন।

ভর্তি পরীক্ষায় বিভিন্ন শর্ত থাকে, শর্ত থাকাটা স্বাভাবিক। বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ক ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী উত্তীর্ণের হার ৯ দশমিক ৮৭, যা ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী, যা গত বছর ছিল ২১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ঘ ইউনিটে (সমন্বিত বিভাগ) উত্তীর্ণ হয়েছেন ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে যা ছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় ক ইউনিট থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন ৩ জন—৯৫ করে। খ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৭৬ দশমিক ৫০। গ ইউনিটে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৯৬ দশমিক ১। জিপিএ–৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করছেন না শিক্ষার্থীরা।

এটা নিয়ে আলোচনা চলমান। কিন্তু আমার মতে, এটা শতভাগ সত্যি নয়। কারণ, তা–ই যদি হতো, তাহলে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর ৮৪ বা ৭৬ হতো না। কারণ, যাঁরা মেধাবী এবং গুণগত মানে উত্তীর্ণ হয়ে যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছেন, তাঁরা ঠিকই ভর্তি পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থাৎ, শিক্ষার গুণগত মান বাড়েনি, সাক্ষরতার হার বেড়েছে। বাস্তবিক অর্থে শিক্ষার মান বেড়েছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

এ ছাড়া শিক্ষায় নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা চোখে পড়ার মতো। যেমন পরীক্ষায় হলে নকলের মহড়া চলে। কেউ কেউ বলছেন নকলের হাটবাজার। শিক্ষকেরাও নকলের কাজে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছেন। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। ইদানীং পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রচারিত নানা সংবাদ বা ঘটনা গোটা জাতিকে লজ্জাজনক অবস্থানে ফেলে দিয়েছে, যার জন্য চারজন শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন। শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। প্রশ্ন ফাঁস খুবই দুঃখজনক ঘটনা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ছবি: লেখক

গণমাধ্যমে জামালপুর জেলার এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নকল করার ঘটনা দেখলাম। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরীক্ষার হল হিসেবে কোনো কার্যকর অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হচ্ছে। কেন এসব ঘটছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি হয়ে পড়ছে। এসব রোধে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি এমনভাবে দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে অন্য কেউ এ রকম অপরাধ ঘটাতে না পারেন। সম্পূর্ণভাবে এসব অপরাধ বন্ধ করতে হবে।

আবার লক্ষ করা যায়, শিক্ষাবর্ষ প্রায় শেষ হতে চললেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই। এর ফলে শিক্ষা অফিসের বইগুলোতে উইপোকা ধরছে। আর শেষ পর্যন্ত এসব বইয়ের ঠাঁই হয় ঝোপঝাড়ে। আর এ ঘটনা ঘটেছে ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে। কার্যালয় ভবনের পেছনের জঙ্গলে মিলেছে এমনই কিছু বইয়ের বান্ডিল, যা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ার পর শুরু হয়েছে তোলপাড়।

খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তড়িঘড়ি করে বইগুলো ঝোপঝাড় থেকে তুলে বস্তায় ভরে আবার শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের গোডাউনে নিয়ে রাখা হয়। এটা ঘটছে কারণ, শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি বইয়ের তালিকা দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন গুদামে ফেলে রাখায় বইগুলো উইপোকায় ধরে নষ্ট করে ফেলছে। শিক্ষাকে মেরুদণ্ড বলা হয়, কিন্তু এখন দেখা যায়, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার জাতির মেরুদণ্ড নষ্ট করে ফেলছে। কারণ, দুর্নীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারপ্রধান জিরো টলারেন্স ঘোষণার পরও দুর্নীতি কমছে না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে নানা ধরনের অসংগতি হচ্ছে, যা সংবাদপত্রের মাধ্যম জানতে পারছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নোংরামিতে পরিণত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। বঙ্গবন্ধুর ছাত্ররাজনীতি দেশ ও জাতির সংকটের মুহূর্তে সর্বদা কাজ করে গিয়েছে। ওই সময় ছাত্ররাজনীতি ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে নানা ধরনের অসংগতির খবর—যেমন হলে সিট বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও কমিটিতে পদ পেতে অর্থের লেনদেন ইত্যাদি অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশ পাচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। সব দলের উচিত ছাত্ররাজনীতিকে দেশের ও জনগণের কল্যাণে উৎসাহিত করা। যেমন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কৃষকের ধান কাটায় অবদান রেখেছিল, যা প্রশংসনীয়।

মানসম্মত শিক্ষার পূর্বশর্ত টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও নিশ্চিত করার জন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রম অ্যাক্রেডিট করতে বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা সরকারের খুবই যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং–নির্ভরতা, শিক্ষায় দুর্নীতি এবং শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। তাহলে জাতি প্রকৃত মানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পাবে বলে বিশ্বাস করি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত মেনে চলতে হবে।

শিক্ষকদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা নিশ্চিতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, যা সরকারে টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বা পর্যায়ে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ওই পদে চাকরি করতে আগ্রহী হন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।