প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় হচ্ছে, ক্ষমতা কমবে ডিআইয়ের

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি

দেশের মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে পরিদর্শন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। তবে এ সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে যেমন নানা রকমের অভিযোগ আছে, তেমনি দেশের বিপুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার মতো সক্ষমতাও নেই। এমন অবস্থায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর (মূলত মাধ্যমিক স্তর) মান বাড়াতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিদর্শন করার জন্য নতুন একটি সংস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা বিভাগ।

প্রস্তাবিত এ সংস্থার নাম হবে ‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয়’। এটি হলে বিদ্যমান ডিআইএর ক্ষমতা কমবে। কারণ, ডিআইএ তখন শুধু নিরীক্ষার কাজটি করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সূত্রমতে, এ নিয়ে দুটি কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয়ের কর্মপরিধি কেমন হবে, তার একটি খসড়াও করা হয়েছে। আরেকটি কমিটি ডিআইএর পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করছে।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক অধ্যাপক একিউএম শফিউল আজম প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশের আলোকে ‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয়’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অবশ্য, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুধু নতুন প্রতিষ্ঠান করলেই হবে না; কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে ‘যে লাউ, সেই কদু’ হবে এবং তখন শুধু পদ-পদবি বাড়বে। ইতিমধ্যে শিক্ষায় এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার সুফল মিলছে না। যেমন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির (মান্থলি পে অর্ডার) কাজটি বিকেন্দ্রীকরণ করে আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হলেও এখন ‘ঘাটে ঘাটে অনিয়ম’ হয় বলে অভিযোগ আছে। অথচ, আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে এখন পরিচালক পর্যন্ত আছেন। পদ্ধতিগতভাবে বিকেন্দ্রীকরণ ভালো হলেও কাজটি এমন ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে, যেখানে এমপিওভুক্তির জন্য একজন শিক্ষককে বাস্তবে চারঘাটে তদবির করতে হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবৈধ আর্থিক লেনদেন করতে হয়। বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় প্রথমে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে তার মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে তথ্য পাঠাতে হয়। তারপর তথ্য যায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেখান থেকে যায় আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে। অথচ এখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) পরীক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষকদের পরামর্শ হলো, নিয়োগের সময় প্রয়োজনে সময় নিয়ে ভালো করে যাচাই করে নিয়োগ দেওয়ার পর এমপিওভুক্তির জন্য ঘাটে ঘাটে যাওয়া বন্ধ করে এক জায়গায় কাগজপত্র জমা দিয়েই এমপিওভুক্ত করা উচিত। উল্লেখ্য, বর্তমানে একজন সরকারি শিক্ষককে বেতনের জন্য এ রকম ঘাটে ঘাটে যেতে হয় না।

ডিআইএ কী করে এবং নতুন সংস্থা কী করবে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন–ভাতা ও মঞ্জুরিসহ প্রতিষ্ঠানের তহবিল নির্দিষ্ট খাতে যথাযথভাবে ব্যয় করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা তথ্য যাচাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা মাফিক পরিদর্শন, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাবিষয়ক কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্ত এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শিক্ষার বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও শিক্ষা বোর্ডসহ যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদি তদন্ত করে ডিআইএ।

১৯৮০ সালের পরে ডিআইএর যাত্রা শুরু হয়। তখন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কম ছিল। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী ১৯৯১ সালে দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল ১০ হাজার ৭১৫টি। তখন কলেজ ছিল ৯১৮টি। শিক্ষক ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি। আর ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২০ হাজার ৮৪৯টি এবং কলেজ ৪ হাজার ৬৯৯টি। মাধ্যমিকে শিক্ষক আড়াই লাখের বেশি। আর শিক্ষার্থী এক কোটির বেশি। কিন্তু এই বিপুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষার করার মতো সক্ষমতা ডিআইএর নেই।

এমন অবস্থায় নতুন সংস্থা হতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে আলোচনার পর এখন বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে। ডিআইএকে পুনর্গঠনসংক্রান্ত কমিটির সদস্যসচিবের দায়িত্বে আছেন মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক শাহেদুল খবীর চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষার কাজকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মাউশির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয় স্থাপন হলে বর্তমান ডিআইএ পুনর্গঠন করা হবে। আর পুনর্গঠন করা ডিআইএ শুধু নিরীক্ষা (অডিট) পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। তখন এমনও হতে পারে, এখানে প্রেষণে অথবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে এই কার্যালয় পরিচালনা করা হবে। বর্তমানে কিছু নিজস্ব জনবলের পাশাপাশি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ডিআইএতে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বর্তমানে ডিআইএ’র কার্যালয় মাউশির পার্শ্ববর্তী ভবনের দুতলায়। এখানে সব কর্মকর্তার বসারও পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তারপরও এখানে পদায়ন পেতে শিক্ষা ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তার খুব আগ্রহ দেখা যায়।

সম্প্রতি অন্যত্র বদলি হওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক গত বছর এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক এবং প্রশাসনিক অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উদ্‌ঘাটনের দায়িত্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ)। মূলত এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পঙ্কিলে নিমজ্জিত হওয়ার অভিযোগ করেছে দুদক।

অবশ্য বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কেউ কেউ এই উদ্যোগের বিরোধী। তাঁরা মনে করেন এর ফলে তাঁদের ক্ষমতা কমবে। প্রস্তাব অনুযায়ী প্রধান শিক্ষা পরিদর্শকের কার্যালয়ের প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি সারা দেশেই এর কার্যালয় থাকবে। দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সক্ষম করে তোলাই হবে মূল লক্ষ্য। এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে শিখন-শেখানো পরিবেশের মান উন্নয়ন করার জন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করা ও দূর করা হবে।

এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সার্বিক মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।