বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ চায় ইউজিসি

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আছে। দিন দিন এই অভিযোগ বাড়ছেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গ করে অযোগ্য স্বজনদেরও নানা কৌশলে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠছে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগে শুধু অভিযোগই উঠছে, তা নয়, দেশে উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তেও অনেক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসব অনিয়মের প্রতিকার মিলছে না। দু-একটি উদাহরণ ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না।

এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান নিয়োগব্যবস্থা পরিবর্তন করে ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ গঠনের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নিয়োগ কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে থাকে। ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে স্বতন্ত্র ওই কমিশন গঠনসহ মোট ১৭ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে তুলে দিয়েছে ইউজিসি।

ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণ ঘটেছে। তাই নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান’ করা জরুরি।

বর্তমানে দেশে ৫৩টি সরকারি (ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে ছিল ৫০টি) ও ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৪৪ লাখ ৪১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ) অধীন শিক্ষার্থী ৪১ লাখ ৩১ হাজারের মতো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক–কর্মকর্তা–কর্মচারী ৫২ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে শিক্ষক প্রায় ১৫ হাজার।

ইউজিসি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায়ই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ জাতীয় গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে। এ ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–কর্মকর্তা–কর্মচারী নিয়োগের জন্য ইউজিসি প্রণীত ন্যূনতম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা (এমপিকিউ) নির্ধারণী নির্দেশিকার আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন দ্রুত নীতিমালা করে, তারও সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে প্রায়ই স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ জাতীয় গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত হয়। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ও যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল নিয়োগের উদ্দেশ্যে একটি ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে।

বার্ষিক প্রতিবেদন সম্পাদনা পরিষদের প্রধান সম্পাদক ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ‘স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশনের’ যে সুপারিশ করেছেন, সেটি বিদ্যমান সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আদলে হতে পারে।

ইউজিসি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ইউজিসি তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশসহ প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তবে ইউজিসির সুপারিশ অনেকাংশে বাস্তবায়িত হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি, সনদ–বাণিজ্য, আর্থিক অনিয়ম ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নিতে ইউজিসির ক্ষমতা থাকা অতি জরুরি।

স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশনের যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেটি বিদ্যমান সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আদলে হতে পারে
—মো. সাজ্জাদ হোসেন, বার্ষিক প্রতিবেদন সম্পাদনা পরিষদের প্রধান সম্পাদক ও ইউজিসির সদস্য

সরকার প্রতিটি জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস স্থাপনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এবং ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় জমি অধিগ্রহণেও সংকট তৈরি হচ্ছে। এ জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমির পরিমাণ যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ করতে একটি নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ও সম্প্রসারণ ঘটেছে। তাই নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘একাডেমিক মাস্টার প্ল্যান’ করা জরুরি।

বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেশীয় বা জাতীয় র‍্যাঙ্কিং করারও সুপারিশ করেছে ইউজিসি। সংস্থাটি বলেছে, আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আদলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এই ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সনদ জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ‘ব্লক চেইন প্রযুক্তি’ ব্যবহার চালু করার পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি।

এ ছাড়া উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাঋণ কর্মসূচি চালু করা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান সান্ধ্য, উইকেন্ড, এক্সিকিউটিভ ইত্যাদি নামে চলা কোর্সগুলো বন্ধ করাসহ আরও কিছু সুপারিশ করেছে ইউজিসি।

প্রতিবছরই ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করে না বলে অভিযোগ আছে। এমন অবস্থায় এবার নতুন কিছু সুপারিশ করল ইউজিসি।