গবেষণা ও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মানোন্নয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে আমরা কি নিচেই থাকব

ফাইল ছবি

বর্তমানে দেশে পাবলিক ও বেসরকারি দেড় শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সার্ক দেশগুলোর তুলনায় আমাদের সার্বিক শিক্ষার মান কোনো অবস্থানে রয়েছে, তা পর্যালোচনার যথেষ্ট দাবি রাখে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই গুণগত মানসম্মত শিক্ষা অর্জন হয়ে যায় না। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গঠনই কাঙ্ক্ষিত মানসম্মত শিক্ষার মূল লক্ষ্য। সেই কাঙ্ক্ষিত মান বা স্ট্যান্ডার্ড এডুকেশন বলতে যা বোঝায়, তার কাঠামোগত অস্তিত্ব বাংলাদেশের গবেষণা ও শিক্ষায় তার প্রতিফলন কতটুকু আছে, তার অনুসন্ধান করাটা খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। গবেষণা থেকে অর্জিত জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজকে ইতিবাচক হয়ে চলতে সাহায্য করাটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম দায়িত্ব। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে। গ্লোবালাইজেশন বা গ্লোবাল ভিলেজ এবং অর্থনীতির পরিবর্তনশীলতার কারণে উচ্চতর শিক্ষা পলিসিতে ক্রমে বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের ঢেউ লাগছে।

এ জন্য উচ্চতর শিক্ষায় ন্যাশনাল কোয়ালিটি আশুয়ারেঞ্চ বা জাতীয় মান আশ্বাস অর্জনে বিভিন্ন দেশ যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। বিশ্বে এখন শিক্ষা ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা করে, এমন আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে, যার নাম সংক্ষেপে কিউএস, যা QS (Quacquarelli Symonds)। এ সংস্থা দুনিয়াব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা একাডেমিগুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রদান করে থাকে। কিউএস পরিচালিত গবেষণায় উচ্চশিক্ষার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে যুদ্ধবিধস্ত আফগানিস্তান, অর্থনীতিতে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কা, ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ, দরিদ্র নেপাল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পাকিস্তান, জান্তাপ্রধান মিয়ানমার, ভুটান ও ভারতের চেয়েও বাংলাদেশ শিক্ষা সূচকে বেশ পিছিয়ে পড়েছে। নিঃসন্দেহে তথ্যটি আমাদের ভালো না লাগলেও, এটাই এখন আসল বাস্তবতা।

২০০৩ সালে বসওয়ার্থ এবং কলিনস পরিচালিত সমীক্ষায় গুণগত শিক্ষার পরিমাপকাঠিতে দেখা যায়, শ্রীলঙ্কার এডুকেশন কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ছিল ২০ দশমিক ৮, পাকিস্তানের ১১ দশমিক ৩ এবং বাংলাদেশের স্কোর ছিল মাত্র ২ দশমিক ৮। এটা নির্দেশ করেছিল তখনই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্পন্ন মানবসম্পদ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় তৈরি করছিল না। এ মূল্যায়নের ১৯ বছর পর এখনকার বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল ও পিএইচডির মান পর্যালোচনা নিরিখে নতুন করে পরিকল্পনা প্রণয়ন অতি জরুরি।

ফাইল ছবি

এক বছর আগে ২০২১ সালে কিউএস সংস্থার পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, এশিয়ার ৬৫০টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট: ১৯৯তম), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৩৪তম), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় (২২৮তম), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় (২৭১-২৮০তম), ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আইইউবি (৩৫১-৪০০তম), ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি (৪০১-৪৫০তম), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (৪৫১-৫০০তম), এবং আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, (৫৫১-৬০০তম)। এর মানে, সেরা ১০০–তেও নেই, সেরা ১৫০–এ নেই। এই চিত্র ভয়াবহ আমাদের জন্য। অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের মতে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে উদ্ভূত নতুন জ্ঞান বিশ্বকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ফলপ্রসূ গবেষণা করছে না।’

দেশ স্বাধীনের আগে শরীফ শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ অনুসারে, পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে দুটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করেছিল, ময়মনসিংহে অবস্থিত একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং অব কলেজকে উন্নীত করে ‘ইস্ট পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’, যা বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বুয়েট নামে পরিচিত। পরে, আরও দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৫) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)। দুর্ভাগ্যজনক সত্য যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিভিন্ন জটিলতা ও সঠিক প্ল্যানের অভাবে ১৯৭১ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বব্যাংক সূত্রে ১৯৮৬ সালে আমাদের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৯ কোটির মতো।

উচ্চশিক্ষার ক্রমচাহিদা ও জনসংখ্যার অনুপাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম এবং আসন সংখ্যা খুব কম থাকায় উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণ না হওয়ায়, তৎকালীন সরকার ১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি করে। পরবর্তী সময় ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন করে উচ্চশিক্ষার জন্য সবার দ্বার উন্মুক্ত করে (Ministry of Education, 2010)। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পাবলিক এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট সংখ্যা হচ্ছে ১৫১—৪৬টি পাবলিক ও ১০৫টি বেসরকারি, যার মধ্যে ঢাকায় অবস্থিত ৬৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিভাগে উত্তরবঙ্গের প্রথম বেসরকারি ‘বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়’সহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। ব্যানবেইস সূত্রে গত ২০১৮ সাল পর্যন্ত এক দশক ধরে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট উচ্চশিক্ষার ভর্তি-তালিকায় ১ মিলিয়ন (১০ লাখ) ছাত্র ছাড়িয়ে গেছে। অনেক শিক্ষাবিদের মতে, বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটি শুধুই সংখ্যাবাচক মাত্র, যা মোটেও মানসম্মত শিক্ষার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে না। উপযুক্ত নীতি পরিকল্পনার অভাবে এবং কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সৃষ্ট। উচ্চশিক্ষার বিশ্বপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের জুতসই কোনো কিএইউ (Quality Assurance Unit–QAU) ছিল না, যার মাধ্যমে সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স’ বা গুণগতমানের ধারা নিশ্চিত করতে পারে।

গত এক যুগে সরকারের বাজেটে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা খাতে গড়ে সরকারি বরাদ্দ ছিল মোট শিক্ষা বাজেটের ৭.২১% এবং জাতীয় বাজেটের ০.৮৩ %। সুনির্দিষ্টভাবে, ২০১৮-১৯ বছরে যা ছিল যথাক্রমে ৮.৭৪% এবং ০.৯২% (ইউজিসি প্রতিবেদন, ২০১৯)। তার মানে জাতীয় বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার মাত্র ১% বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বরাদ্দ থাকে, যা ২০১৯-২০ সালের বাজেটে জিডিপির’-এর শতাংশ হিসেবে ১.৫  শতাংশ। ২০২০-২১ সালের অর্থবছরের জন্য বাজেটে শিক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ ২০১৯ সালের বাজেটের তুলনায় জিডিপির আকার এবং শতাংশের দিক দিয়ে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে, যা উচ্চশিক্ষার মানকে চ্যালেঞ্জ জানায়। এটা কোনো বিবেচনাতেই কাম্য নয়। গত দুটি, তিনটি বাজেট খেয়াল করলে দেখা যায় যে শিক্ষা খাতে আমাদের ব্যয় (জিডিপির শতাংশ হিসাবে) দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর মধ্যে সব থেকে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষা বাজেটের ওপর ‘ইউনেসকো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিসটিকস’ একটি চিত্র (জিডিপির শতাংশ হিসাবে) তুলে ধরেছে। আফগানিস্তান ৩.৯ শতাংশ; বাংলাদেশ ১.৫; ভুটান ৭.১; ভারত ৩.৮; মালদ্বীপ ৪.৩; শ্রীলঙ্কা ২.৮ শতাংশ; এবং পাকিস্তান ২.৮ শতাংশ অর্থ শিক্ষায় ব্যয় করে।

এ ধারা একই থাকবে যদি উচ্চতর শিক্ষার মানোন্নয়নকে অস্বীকার করার প্রবণতা আমাদের সিস্টেম থেকে দূর না করা যায়। ভবিষ্যতের জন্য আমরা ভালোটা আশা করব এবং সেটা সব পক্ষকেই অনুধাবন করতে হবে শিক্ষা খাতের উন্নয়নে বাজেটে কোনো আপস না করার মাধ্যমে।

লেখক: গবেষক