সারা জীবন পড়ান, অবসরে এসে নিজের টাকা পেতে ভোগান্তিতে শিক্ষকেরা

অবসরসুবিধার টাকা দিতে ৭ হাজার ১৭৬ কোটি এবং কল্যাণসুবিধার জন্য ২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। 

সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত (বেতনবাবদ মাসে সরকারি অনুদান) শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি।ছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণসুবিধার টাকা পেতে ভোগান্তি কোনোভাবেই কমছে না; বরং প্রাপ্য সুবিধা পেতে তাঁদের অপেক্ষার সময় বাড়ছেই। আগে অবসরসুবিধার টাকা পেতে দুই বছরের মতো সময় লাগত, এখন তা তিন-চার বছরে গড়াচ্ছে। অথচ হাইকোর্টের নির্দেশ আছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসরসুবিধার টাকা ছয় মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে।

সারা জীবন শিক্ষাসেবা দিয়ে নিজের প্রাপ্য অর্থ পেতে এমন দীর্ঘ অপেক্ষা শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, এ সংকট সমাধানে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) ১২ নভেম্বর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে একটি আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) পাঠিয়েছেন। পত্রে পুরো পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে অবসরসুবিধা দিতে ৭ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা এবং কল্যাণ ট্রাস্টের জন্য ২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

চিঠিতে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেছেন, তহবিলঘাটতির কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীকে অবসর ও কল্যাণসুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নিজ ও পারিবারিক চিকিৎসা, সন্তানের বিয়ে-পড়াশোনা, বৃদ্ধ বয়সে ধর্মীয় ব্রত সম্পাদন ইত্যাদি প্রয়োজনে প্রাপ্য সুবিধার জন্য বয়োবৃদ্ধ ও গুরুতর অসুস্থ শিক্ষকেরা প্রায়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হন। অনেক শিক্ষক প্রাপ্য সুবিধা পাওয়ার আগেই মারা যান। তহবিলসংকটের কারণে শিক্ষকদের প্রাপ্য সুবিধা দেওয়ার ব্যর্থতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

আবেদনের পাহাড়

সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত (বেতনবাবদ মাসে সরকারি অনুদান) শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণসুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণসুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর অবসরসুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসরসুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।

অবসরসুবিধা বোর্ডের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, স্কুল পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত করা আবেদনের সুবিধা পেয়েছেন। আর কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকিরা অপেক্ষমাণ। অবসরসুবিধার জন্য গত ৩০ জুন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৭৭৫টি আবেদন জমা ছিল।

কল্যাণ ট্রাস্টের পরিস্থিতিও অভিন্ন। সর্বশেষ ২৪ নভেম্বরের তথ্য বলছে, ৪৪ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণসুবিধার অর্থ না পেয়ে অপেক্ষায় আছেন। ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আবেদনকারীরা টাকা পেয়েছেন। ওই বছরের পরের দুই মাসের কাগজপত্র প্রস্তুত করা হলেও এখনো টাকা দেওয়া যায়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব বলছে, চলতি বছরের শেষে অবসরসুবিধা পেতে আবেদনের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮০ হাজার ৩২০। অন্যদিকে কল্যাণসুবিধার জন্য আগামী জুন পর্যন্ত আবেদনের সংখ্যা বেড়ে হবে ৫১ হাজার ৬৫৫।

শিক্ষকতা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

গতকাল বুধবার রাজধানীর নীলক্ষেত-পলাশী এলাকায় অবস্থিত অবসর ও কল্যাণসুবিধা বোর্ডের সামনে কথা হয় মানিকগঞ্জ থেকে আসা এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে। নাম এ কে এম ওয়াদুদুর রহমান। তিনি মানিকগঞ্জ সদরের বেতিলা হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। বললেন, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অবসরে গেছেন। অবসর ও কল্যাণসুবিধার জন্য আবেদন করেন ওই বছরের জুনে। কিন্তু এখনো টাকা পাননি। খোঁজ নেওয়ার জন্য এলে তাঁকে বলা হয়েছে, যেকোনো সময় পেয়ে যাবেন।

মূল সমস্যা তহবিলঘাটতি

অবসরসুবিধার জন্য চাকরিকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৬ শতাংশ টাকা মাসে কেটে রাখা হয়। কল্যাণসুবিধার জন্য কাটা হয় মূল বেতনের ৪ শতাংশ। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে ১০০ টাকা (৭০ টাকা অবসরের জন্য ও ৩০ টাকা কল্যাণের জন্য) নেওয়া হচ্ছে। বাকি টাকা সরকার ও চাঁদা জমার সুদ থেকে সমন্বয় করে দেওয়া হয়।

অবসরসুবিধা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ৬ শতাংশ হারে টাকা কাটার মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকা আদায় হয়। এফডিআরের লভ্যাংশ হয় প্রতি মাসে ৩ কোটি টাকা। কিন্তু প্রতি মাসে গড়ে অবসরসুবিধার জন্য আবেদন জমা পড়ে ১ হাজার, যা নিষ্পত্তি করতে প্রতি মাসে দরকার ১১৫ কোটি টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, সব মিলিয়ে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আয় থেকে অবসরভাতা পরিশোধের পর ঘাটতি দাঁড়াবে ৭ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। আর কল্যাণ ট্রাস্টে এ ঘাটতির পরিমাণ হবে প্রায় ২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।

বোর্ড ও ট্রাস্ট জানায়, সরকার নিয়মিত বাজেট না দিলে সংকট কাটানো যাবে না। সরকার মাঝেমধ্যে থোক সহায়তা দিলেও তা যথেষ্ট নয়। অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বন্ড করেছে। এর মধ্যে ২ হাজার কোটি অবসরের জন্য এবং ২০০ কোটি টাকা কল্যাণের জন্য। তবে এই বন্ডের লাভ পাওয়া যাবে ছয় মাস পরপর, যার পরিমাণ হবে ১৫০-১৬০ কোটি টাকা। সংকট সমাধানে তা খুবই কম।

এর মধ্যে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরার ১২ নভেম্বর এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে টাকা চেয়ে আধা সরকারি পত্র দিলেন।

আইন ভঙ্গ করে নিয়োগ, বিতর্ক

অবসরসুবিধা পেতে শিক্ষকেরা যখন দীর্ঘ অপেক্ষায়, তখন এ বোর্ডে নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অবসরসুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা বোর্ড থাকার কথা। কিন্তু ১৫ মাস ধরে বোর্ড গঠিত হয়নি। এত দিন রুটিন দায়িত্বে কর্মকর্তা দিয়ে কাজ চালানো হলেও ১৬ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের দুজন অধ্যাপককে সদস্যসচিব ও সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।

আইন অনুযায়ী এসব পদে নিয়োগ পাওয়ার কথা বেসরকারি শিক্ষকদের। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেই বিধান উপেক্ষা করেছে।

এ ছাড়া কেবল কল্যাণ ট্রাস্টেই সাতজন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এত কর্মকর্তার প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণসুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কল্যাণসুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। অবসরসুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসরসুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।

সমস্যা সমাধানের উপায় কী

শিক্ষকদের অভিযোগ, চাকরিজীবনে তুলনামূলক কম বেতন-ভাতা নিয়ে কষ্টে সংসার চালানোর পর অবসরের পর অন্তত ন্যায্য প্রাপ্য পাওয়ার আশা থাকে। কিন্তু সেই প্রাপ্যটুকু পেতেও এখন অনিশ্চয়তা-অপেক্ষা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষকদের সময়মতো তাঁদের প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখার সবচেয়ে বড় শক্তি এই শিক্ষকেরাই। অথচ সারা জীবন সেবা দেওয়ার পর তাঁদেরই আর্থিক নিরাপত্তা অনিশ্চিত।

বোর্ড ও ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের মতে, অবসর ও কল্যাণসুবিধা নিয়মিত দিতে হলে প্রথমে অনিষ্পন্ন হওয়া আবেদনগুলোর বিপরীতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে। এরপর নিয়মিত সরকারি বাজেট বরাদ্দ ছাড়া এ সংকট কাটবে না। মাঝেমধ্যে থোক বরাদ্দ দিয়ে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।