চট্টগ্রামে ৩ প্রধান শিক্ষকের বিষয়ে সিদ্ধান্তে গড়িমসি

চট্টগ্রামে পদোন্নতির শর্ত লঙ্ঘন করে তিন সহকারী শিক্ষকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে। বছর দুয়েক আগে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তাঁদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখে বেতন-ভাতা তুলে যাচ্ছেন তাঁরা।

একই প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামে আরও ৩৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তবে তাঁদের বিষয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। শর্ত না মেনে এভাবে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়ায় যোগ্য প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের এক পরিপত্রের অধীন তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই পরিপত্র অনুযায়ী, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পেতে সহকারী শিক্ষক পদে নিরবচ্ছিন্নভাবে কমপক্ষে সাত বছরের সন্তোষজনক এমপিওভুক্ত চাকরি থাকতে হবে। এরপর প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তি প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাবেন।

কিন্তু কমিউনিটি বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি নিয়েছেন চট্টগ্রামের অন্তত ৩০ শিক্ষক। তবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দাবি, এ–সংক্রান্ত ‘কাগজপত্র’ জমা ও ‘অনুমতি’ নিয়েছেন তাঁরা।

একজন শিক্ষকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে পদোন্নতি নেওয়া পাঁচলাইশ থানার তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা হলেন দক্ষিণ পাহাড়তলী অলি আহম্মদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওমর ফারুক, পশ্চিম শহীদনগর মীর আহমদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক ও তৈয়বিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিনু আক্তার।

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই তদন্তে প্রধান শিক্ষক পদে যথাযথভাবে পদোন্নতি না হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু তাঁদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়।

তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, একজন শিক্ষকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করা হয়েছিল। কমিউনিটি শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা প্রধান শিক্ষক হয়েছেন, তাঁদের সাত বছরের এমপিওভুক্তির অভিজ্ঞতা ছিল না।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘পরে তাঁরা (তিন শিক্ষক) একটি আদেশের কপি দিয়েছেন আমাকে। কিন্তু এই কপি মন্ত্রণালয় থেকে সরাসরি আমাদের কাছে আসার কথা ছিল। একই কপি বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওখানেও সেটা ছিল না।’

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম ধাপে জাতীয়করণকৃত সহকারী শিক্ষকদের সার্ভিস বই মোতাবেক দেখা যায়, তাঁরা প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১১তম গ্রেডে বেতন–ভাতা উত্তোলন করছেন। মহানগর প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারির সভায় এই সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়।

জানা গেছে, কমিউনিটি বিদ্যালয়গুলোকে ২০১১ সালে এক আদেশের মাধ্যমে বেসরকারি রেজিস্টার্ড করা হয়। এরপর ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি রেজিস্টার্ড বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ বা সরকারি করা হয়। কমিউনিটি বিদ্যালয়ের এই শিক্ষকদের কোনো এমপিওভুক্তি ছিল না। তাঁদের জাতীয়করণের সময় নিয়োগপত্রে সহকারী শিক্ষক লেখা ছিল।

কিন্তু কমিউনিটি থেকে জাতীয়করণ হওয়া পর্যন্ত মাত্র দুই বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁরা প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পান। ২০১৩ সালের ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর প্রাথমিক শিক্ষা কমিটির এক সভার সুপারিশক্রমে তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই সভার সভাপতিত্ব করেন তখনকার উপপরিচালক শাহ সুফী মোহাম্মদ আলী রেজা।

অথচ ২০১২ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়, ‘বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। ফলে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর উপর্যুক্ত নীতিমালার আলোকে শিক্ষকদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই।’ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে বিশেষ বিবেচনায় পদোন্নতি না দেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই তিনজনের নামে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধান শিক্ষক পদে জাতীয়করণের নিয়োগ আদেশ প্রদান করা হয়নি। শিক্ষা কমিটির সভার সুপারিশের ভিত্তিতে তাঁরা বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক চট্টগ্রাম কার্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেতন নির্ধারণের ভিত্তিতে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন।

এতে বলা হয়, ‘প্রধান শিক্ষক পদে জাতীয়করণের আদেশ ব্যতীত শুধু শিক্ষা কমিটির সুপারিশক্রমে বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক কার্যালয় কর্তৃক বেতন নির্ধারণ করা যায় কি না এবং ওই অফিস থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বেতন প্রদান সঠিক কি না, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হলো।’
পদোন্নতির ক্ষেত্রে সাত বছরের অভিজ্ঞতা ছিল কি না, জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মিনু আক্তার বলেন, ‘এগুলো নিয়ে অনেক কাগজপত্র দিয়েছি আমরা। বিষয়টি অনেক পুরোনো। সচিবের অনুমোদন নিয়েছি আমরা।’

একই প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে ৩টি, লোহাগাড়ায় ৫টি, পাহাড়তলী থানায় ৪টি, বাঁশখালীতে ৬টি, রাঙ্গুনিয়ায় ৩টি, সীতাকুণ্ডে ৭টি, চান্দগাঁওতে ৩টি, ডবলমুরিংয়ে ২টিসহ ৩৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে বলে জেলা শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।

পাঁচলাইশ থানা সহকারী শিক্ষক সমিতির উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘১৯৮৭ সালে চাকরিতে যোগদানকারী সহকারী শিক্ষকেরা এখনো পদোন্নতি পাননি। কিন্তু ২০১১ সালে রেজিস্টার্ড হয়ে দুই বছরের অভিজ্ঞতায় ২০১৩ সালে প্রধান শিক্ষক হয়ে গেছেন অনেকে। এই পদোন্নতি অবৈধ।’

তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়গুলো আমি আসার আগের। আমি সঠিকভাবে জানি না পদোন্নতিতে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছিল কি না। ফাইল দেখতে হবে।’