জাতীয় শিক্ষাক্রম : স্মার্ট বাংলাদেশের পথরেখা বনাম অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা ও বাস্তবতা

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ ও স্মার্ট বাংলাদেশ  

সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চায়। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা নাগরিক হয়রানিবিহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ–প্রক্রিয়া, যেখানে ভোগান্তি ছাড়া স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা পাবে এবং কর্তব্য পালনের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখাকে চার ভাগে ভাগ করে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।

 স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি—এ প্রত্যয়গুলোর সারমর্ম হলো—

 স্মার্ট সিটিজেন: দেশের প্রত্যেক নাগরিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হবে;

 স্মার্ট ইকোনমি: অর্থনীতির সব কার্যক্রম তারা প্রযুক্তি ব্যবহার দ্বারা পরিচালনা করবে;

 স্মার্ট গভর্নমেন্ট: স্মার্ট গভর্ন্যান্স বলতে বোঝায় সহজ, জবাবদিহিমূলক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বচ্ছ শাসন। এ ক্ষেত্রে আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারের নীতিনির্ধারণ, পরিধান ইত্যাদি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণসহ একটি ব্যবহারবান্ধব সরকারের রূপরেখাকে বোঝায়। স্মার্ট সোসাইটি: সমাজে মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনাচার প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই পার করতে সক্ষম হবে এবং তারা তাতেই অভ্যস্ত হবে।

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার চারটি মৌলিক উপাদান স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি গড়ার জন্য প্রয়োজন একটি স্মার্ট প্রজন্ম। একটি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, সুখী, অভিযোজনে সক্ষম বিশ্ব নাগরিক গড়ার জন্য এ প্রজন্মকে তৈরি করতে প্রয়োজন শিক্ষার আধুনিকায়ন। এ জন্যই সরকার জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ প্রণয়ন করেছে, যেটি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে।

শিক্ষাক্রমের ধারণা

আক্ষরিক অর্থে যা–ই হোক না কেন, শিক্ষাক্রম শব্দটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং যুগের পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শিক্ষাক্রমের ধারণা ক্রমাগত বিবর্তিত হচ্ছে। তাই শিক্ষাক্রমের সর্বজন স্বীকৃত কোনো একক সংজ্ঞা বা ধারণার উদ্ভব হয়নি। প্রাচীনকালে মানুষের বেঁচে থাকার দক্ষতা অর্জনই ছিল শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয়। ফলে তখনকার অনানুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাক্রমের ধারণা বাস্তবরূপ পেতে থাকে এবং স্কটল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে তা প্রচলিত ছিল। পরে ১৮২০ সাল থেকে আমেরিকায় শিক্ষাক্রমের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাক্রম বলতে মূলত Course of Study বা কতকগুলো পাঠ্যবিষয়কে বুঝাত, যা অনুসরণ করে শিক্ষক শ্রেণিতে পাঠদান করতেন। সে সময় শিক্ষাক্রমের মূল ফোকাস ছিল শিশুর মানসিক এবং জ্ঞানের বিকাশ। এ জন্য শিক্ষাক্রমে বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান ও মানসিক শৃঙ্খলা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো। প্রাচীনপন্থী শিক্ষাবিদদেরও ধারণা ছিল, শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে স্কুলে শিক্ষাক্রমে কতকগুলো অপরিহার্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এগুলো হলো মাতৃভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, পশ্চিমা ও দেশীয় ভাবধারার বিষয়। ফলে সে সময় শিক্ষাক্রমে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হতো।

১৯৩০ সালের পর থেকে শিক্ষাক্রমের প্রাচীন ও সংকীর্ণ ধারণা পরিবর্তন হয়ে আধুনিক ধারণার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। এ সময় শিক্ষাক্রম বলতে স্কুল কর্তৃক পরিচালিত সব শিখন অভিজ্ঞতার সমষ্টিকে বোঝানো হতো। এ প্রসঙ্গে ১৯৩৫ সালের ক্যাসওয়েল ও ক্যাম্পবেল (Caswell and Campbell) শিক্ষাক্রমের পুরোনো ধারণার অবসান ঘটিয়ে একটি নতুন ধারণা ‘শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষকের পরিচালনায় শিক্ষার্থীর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতা’ প্রস্তাব করেন। সে সময়ের অন্যান্য শিক্ষাক্রম–বিশেষজ্ঞরা শিক্ষাক্রমের এ ধারণাকে সমর্থন করেন। এভাবে শিক্ষাক্রম তার সংকীর্ণ ধারণার গণ্ডি পার হয়ে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং শিক্ষাক্রম কেবল পাঠ্যবিষয়ের পরিবর্তে স্কুলের নিয়ন্ত্রিত সব শিখন-অভিজ্ঞতার সমষ্টিরূপে পরিগণিত হতে থাকে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় স্কুল কর্তৃক কোন কোন অভিজ্ঞতা প্রদান করা হবে? শিক্ষার্থী ও বৃহত্তর সমাজ স্কুলের কাছে কোন অভিজ্ঞতাগুলো প্রত্যাশা করে? তাছাড়া স্কুল কর্তৃক প্রদত্ত অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে কোনগুলো কাক্ষিত বা অনাকাক্ষিত তা শিক্ষাক্রমের এ ব্যাপক ধারণা থেকে বোঝা সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাক্রম–বিশেষজ্ঞরা শিক্ষাক্রমের আরও সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ধারণা অনুসন্ধান করতে থাকেন।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

১৯৪৯ সালের শিক্ষাক্রম–বিশেষজ্ঞ রাফ টাইলার প্রদত্ত ধারণায় শিক্ষাক্রম–সম্পর্কিত এ সমস্যার কিছুটা সমাধান পাওয়া যায়। তিনি প্রথম বলেন, শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্কুল কর্তৃক পরিকল্পিত ও পরিচালিত শিক্ষার্থীর সব শিখন অভিজ্ঞতা। এতে দেখা যায়, তিনি শিক্ষাক্রমকে স্কুল পরিচালিত সব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যভিত্তিক ও পরিকল্পিত শিখন অভিজ্ঞতা করার ওপর জোর দিয়েছেন। এ ছাড়া ১৯৫০ সালে মাঝামাঝি শিক্ষার্থীর জীবনে স্কুলের প্রভাব প্রকটরূপে দেখা যায়। ফলে এ সময় শিক্ষাক্রমের ধারণা পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ব্যাপারে আমেরিকায় বেশ কিছু শিক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক শিক্ষাবিদ শিক্ষাক্রমকে ‘নির্দেশনামূলক পরিকল্পনা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন।

 নিচে কয়েকজন মনীষীর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো, এতে শিক্ষাক্রমের ধারণা বোঝাতে সহায়ক হবে—

  • হিলডা তাবা (১৯৬২):  যুগের চিন্তাভাবনার অবয়বহীন ফসলই হলো শিক্ষাক্রম।

  • হুইলার (১৯৬৭): শিক্ষাক্রম হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য, শিখন অভিজ্ঞতা নির্বাচন, বিষয়বস্তু শনাক্তকরণ, বিষয়বস্তু সংগঠন, মূল্যায়ন ইত্যাদির একটি বৃত্তাকার গতিশীল কার্যক্রম।

  •  মার্শ এবং স্ট্যাফোর্ড (১৯৮৮): শিক্ষাক্রম হলো ‘পরিকল্পনা’ ও ‘অভিজ্ঞতার’ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একটি সেট যা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমের মাধ্যমে সম্পন্ন করে।

 শিক্ষাক্রমের বিবর্তন এবং উপরিল্লিখিত ধারণাগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষাক্রমের ধারণা যুগ যুগ ধরে নিম্নোক্তভাবে বিবর্তিত হয়েছে। যেমন: শিক্ষাক্রম হচ্ছে: ১. বংশানুক্রমিক সুসংবদ্ধ জ্ঞান, ২. মানসিক শৃঙ্খলা, ৩. স্কুল নিয়ন্ত্রিত অভিজ্ঞতা, ৪. পরিকল্পিত শিখন অভিজ্ঞতা, ৫. শিক্ষাদান পরিকল্পনা, ৬. শিখনফল, ৭. জ্ঞানমূলক/অনুভূতিমূলক বিষয়বস্তু এবং প্রক্রিয়া, ৮. প্রযুক্তিগত উৎপাদন ব্যবস্থা ইত্যাদি।

 এ সব দিক ব্যাখ্যা করে Daniel Tanner and Laurel N.Tanner ১৯৮০ সালে শিক্ষাক্রমের একটি কার্যকর সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেন: ‘Curriculum is that reconstruction of knowledge and experience, systematically developed under the auspices of the school (or university) to enable the learner to increase his or her control of knowledge and experience.’

কেন শিক্ষাক্রম পরিবর্তন

 জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়নের পর তার ভিত্তিতে ২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রবর্তন করে ২০১৩ সাল থেকে নতুন পাঠ্যপুস্তক রচনার মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করা হয়। ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থা ও জীবনযাপন প্রণালিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে ব্যাপকভাবে। কর্মক্ষেত্র ও কর্মধারার পরিবর্তনের ফলে এসেছে মনোজগতে পরিবর্তন, যার প্রভাব পড়েছে খাদ্যাভ্যাসসহ দৈনন্দিন আচরণে। এসব পরিবর্তন দ্রুত বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সহজ উপায় হলো, শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এনে পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা। এ ছাড়া অনাগত পেশা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন ও তৈরি করা। শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো—

  • শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও আনন্দময় পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি;

  • বিষয় এবং পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতায় গুরুত্ব আরোপ;

  • গভীর শিখন ও তার প্রয়োগে গুরুত্ব প্রদান;

  •  মুখস্থ–নির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনে অগ্রাধিকার প্রদান;

  •  খেলাধুলা ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিখনের ওপর গুরুত্ব প্রদান;

  • নির্দিষ্ট দিনের শিখনকাজ যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শেষ হয়, সে ধরনের শিখন কার্যক্রম পরিচালনা এবং আনন্দময় কাজে   সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বাড়ির কাজের চাপ কমানো;

  • নির্দিষ্ট সময়ে অর্জিত পারদর্শিতার মূল্যায়ন ও সনদপ্রাপ্তির প্রতি গুরুত্বারোপ;

  • জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত শিক্ষা।

 পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট—

 শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট হিসেবে যেসব বিষয়কে আমলে নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো—

  • চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে জীবন-জীবিকার দ্রুত পরিবর্তন। যেখানে প্রচলিত পেশার তিন ভাগের দুই ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা এখন প্রাথমিক শিক্ষায় আছে, তারা কর্মজগতে প্রবেশ করে যে কাজ করবে, তা এখনো অজানা।

  • কোভিডের মতো মহামারি, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অভিবাসন, দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত, প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, জীবিকার পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে ভৌগোলিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের জীবনধারা ও মনোসামাজিক জগতে দ্রুত পরিবর্তন।

  •  এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।

  •  স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পদার্পণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।

  • প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাক্রমের নিরবচ্ছিন্ন সামঞ্জস্য বিধান।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এর রূপকল্প

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমী, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এর লক্ষ্য

 রূপকল্প অর্জনে প্রয়োজন সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। একটি কার্যকর পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নই এ রূপকল্প অর্জন নিশ্চিত করতে পারে। রূপকল্প বাস্তাবয়নের অভিলক্ষ্যগুলো নিম্নরূপ—

  •  সব শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা বিকাশে কার্যকর ও নমনীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন;

  •  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীর বিকাশ ও উৎকর্ষের সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা;

  •  প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশের বাইরেও বহুমাত্রিক শিখনের সুযোগ সৃষ্টি ও স্বীকৃতি প্রদান;

  • সংবেদনশীল, জবাবদিহিমূলক, একীভূত ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ;

  • শিক্ষাব্যবস্থার সব পর্যায়ে দায়িত্বশীল, স্বপ্রণোদিত, দক্ষ ও পেশাদার জনশক্তি নিয়োগ।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মূল যোগ্যতা—

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এ যোগ্যতা বলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সব স্তরের শিক্ষার্থীদের অর্জনের জন্য ১০টি মূল যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। এগুলো হলো—

 ১.

অন্যের মতামত ও অবস্থানকে সম্মান ও অনুধাবন করে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নিজের ভাব, মতামত যথাযথ মাধ্যমে সৃজনশীলভাবে প্রকাশ করতে পারা।

 ২.

যেকোনো ইস্যুতে সূক্ষ্ম চিন্তার মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনা করে সবার জন্য যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে পারা।

৩.

ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে সম্মান করে নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হয়ে নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা প্রদর্শনপূর্বক বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জন করা।

 ৪.

সমস্যার প্রক্ষেপণ, দ্রুত অনুধাবন, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎ তাৎপর্য বিবেচনা করে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে যৌক্তিক ও সর্বোচ্চ কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নিতে ও সমাধান করতে পারা।

 ৫.

পারস্পারিক সহযোগিতা, সম্মান ও সম্প্রীতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারা।

৬.

নতুন দৃষ্টিকোণ, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের মাধ্যমে নতুনপথ, কৌশল ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করে শৈল্পিকভাবে তা উপস্থাপন এবং জাতীয় ও বিশ্বকল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারা।

৭.

নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়ে নিজ অবস্থান ও ভূমিকা জেনে ঝুঁকিহীন নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বৈশ্বিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ তৈরি করতে ও বজায় রাখতে পারা।

৮.

প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে ঝুঁকি মোকাবিলা এবং মানবিক মর্যাদা অক্ষুণœরেখে নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন ও জীবিকার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারা।

৯.

পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দৈনন্দিন উদ্ভূত সমস্যা গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা ব্যবহার করে সমাধান করতে পারা।

১০.

ধর্মীয় অনুশাসন, সততা ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন এবং শুদ্ধাচার অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃতি ও মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারা।

পূর্বতন ও বর্তমান শিক্ষাক্রমের মৌলিক পার্থক্য

প্রচলিত ও পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের মধ্যে পার্থক্য বিবেচনায় নিলে দেখা যায় এখানে মতবাদ, দর্শন, শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ছাড়াও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে মূল্যায়নে। শিক্ষার্থীদের শিখন অর্জন আগের মতো কাগজ-কলমে আনুষ্ঠানিকভাবে মূল্যায়ন না করে তার অভিজ্ঞতা, আচরণ, কর্মদক্ষতা ইত্যাদির মাধ্যমে করা হবে। এ ক্ষেত্রে গাণিতিক নম্বর না দিয়ে জ্যামিতিক প্রতীক (চতুর্ভুজ, বৃত্ত, ত্রিভুজ) দেওয়া হবে। বার্ষিক ফলাফলের ভিত্তিতে রোল নম্বর না দিয়ে একটি ইউনিক আইডি নম্বর দেওয়া, যেটা একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

 নিচের টেবিলে ছক আকারে পূর্বতন ও বর্তমান শিক্ষাক্রমের প্রধান পার্থক্য দেখানো হলো (ইংলিশ ইমেজ যাবে)

শিখন-শেখানো কৌশল

শিক্ষাদান–প্রক্রিয়ায় শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থী নয়, আরও অনেকে জড়িত থাকেন। শিক্ষাদান–প্রক্রিয়ায় জড়িত পক্ষগুলো হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, পাঠের পরিবেশ ইত্যাদি। শিক্ষা কার্যক্রম এখন আর শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিষয়বস্তুর চাহিদানুযায়ী প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিদ্যালয়ের বাইরেও যেতে হবে। শিক্ষাদান–পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক নাম হলো ‘পেডাগোজি’ যা সম্পর্কে প্রত্যেক শিক্ষকের পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকতে হবে। একজন পেডাগোজিস্টের আধুনিক শিখন-শেখানো দক্ষতা ও কৌশলসমূহ আয়ত্ত করতে হবে এবং সেগুলো সফলভাবে শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগের সামর্থ্য থাকতে হবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এ শিখন-শেখানো কৌশলের যে দিকগুলোর প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, তা হলো—

  • প্রেক্ষাপটভিত্তিক এবং অভিজ্ঞতাভিত্তিক।

  • হাতে–কলমে শিখন, প্রকল্প এবং সমস্যাভিত্তিক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, অনুসন্ধানভিত্তিক শিখন, স্বপ্রণোদিত শিখনের সংমিশ্রণ।

  • অনলাইন ও মিশ্র শিখন।

  • শিক্ষক–সহায়তাকারী এবং শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

  •  শিখনপ্রক্রিয়ায় বিষয়সংশ্লিষ্ট কোনো বাস্তব জীবনধর্মী সমস্যা নির্ধারণ করে তা সমাধানের উপায় নির্ধারণ এবং তা প্রয়োগের অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিতকরণ।

  • শিখন পরিবেশ সহায়তামূলক, একীভূত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী।

  • শিখন পরিবেশ শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, গণতান্ত্রিক ও সহযোগিতামূলক।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন ও ইনক্লুশন

কোনো বিষয়ের শিখন উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীরা কতটুকু আয়ত্ত করতে পেরেছে তা নিরূপণের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার্থী–সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, বিচার-বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াই মূল্যায়ন। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নকে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, তা হলো—

  • মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন ও সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

  • সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা এবং পারদর্শিতা।

  • শিক্ষাক্রমে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের যেসব বিষয় অনুসরণ করা হবে, সেগুলো হলো—

  • যোগ্যতার মূল্যায়ন নিশ্চিতকরণ;

  • শিখনের জন্য শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপ;

  • স্বমূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, মূল্যায়নে অভিভাবক ও সমাজের সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্বারোপ;

  • মুখস্থনির্ভর সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস;

  • শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা।

শিক্ষাক্রমে ইনক্লুশন

  • শিখনে শিশুর মধ্যে সমস্যা না খুঁজে, শিক্ষাব্যবস্থার কোন ধরনের দুর্বলতার জন্য শিক্ষার্থী শিখতে পারছে না, তা চিহ্নিত করা;

  • শিক্ষার্থীর মধে৵ সমস্যা খোঁজার পরিবর্তে শিক্ষাব্যবস্থা ও কাঠামোর প্রতিবন্ধকতাকে শনাক্ত ও দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ;

  •  জেন্ডার, ধর্ম-বর্ণ, প্রতিবন্ধিতা, সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে শিশুর সামর্থ্য, চাহিদা ও বৈশিষ্ট্যের বৈচিত্র্যময়তা প্রস্ফুটিত করার উদ্যোগ নেওয়া;

  • শিক্ষাক্রমে নমনীয়তার মাধ্যমে ভিন্নভাবে সমর্থ শিশু ও তৃতীয় লিঙ্গ ও অতি মেধাবী শিশুদের শিখন-চাহিদা, সক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

 শিক্ষাক্রম রূপরেখায় প্রস্তাবিত মূল পরিবর্তন  

  • সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন প্রবর্তন;

  •  দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবার জন্য ১০টি বিষয় (প্রচলিত মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না);

  • অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম বিদ্যালয়, পরিবার ও সামাজিক পরিসরে অনুশীলন;

  •  শিখনকালীন মূল্যায়ন;

  •  শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়নের সমন্বয়ে দশম শ্রেণি শেষে মাধ্যমিক সমাপনী মূল্যায়ন;

  •  পরীক্ষার চাপ কমানোর জন্য একাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে একাদশ শ্রেণি শেষে এবং দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে দ্বাদশ শ্রেণি শেষে উচ্চমাধ্যমিক সমাপনী মূল্যায়ন;

  •  নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি অকুপেশনের ওপর পেশাদারি দক্ষতা অর্জন বাধ্যতামূলক;

অলংকরণ: আরাফাত করিম

 স্মার্ট বাংলাদেশের পথরেখা: জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বাস্তবায়নের উপায়—

 জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা এর রূপরেখায় স্পষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে এটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য যা করতে হবে তা হলো—

 ১. সংশ্লিষ্টদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এর রূপরেখা ভালোভাবে পড়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করা;

 ২. জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ এর রূপকল্প—‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমী, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলা’ এ বাক্যেও প্রতিটি শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা;

 ৩. জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এর দর্শন ভালোভাবে বুঝতে পারা;

 ৪. পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবাধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতা অর্জন করা। এ জন্য ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থাকা;

 ৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এ বর্ণিত ১০টি কোর কম্পিটেন্সি বারবার পড়ে নিজে বা দলগতভাবে বাস্তবায়নের সমস্যা চিহ্নিত করে তা ব্যক্তিগত বা দলগত অথবা প্রতিষ্ঠানগতভাবে সমাধানের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।

 ৬. জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১–এর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের যুক্ত করে তাদের সহযোগিতা নেওয়া।

 ৭. সরকার প্রদত্ত সর্বশেষ মূল্যায়ন দলিল সংগ্রহ করে সেটি অনুসরণ করে বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।

 ৮. বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া।

 ৯. শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সম্মানজনক বেতন প্রদান করা।

 ১০. নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য বিদ্যারয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও অর্থ সরবরাহ করা।

 সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনা ‘সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সংগতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য’এ পরিবর্তন অপরিহার্য। তবে পরিবর্তনে শুধু দেশ নয়, বিশ্ব পরিমণ্ডল বিবেচনায় নিতে হবে। যুগোপযোগী ও সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন সহজ কাজ নয়। প্রস্তাবিত কারিকুলাম এবং তার আলোকে লিখিত পাঠ্যপুস্তকে কোন অসংগতি থাকলে তা সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

 ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে এবং তারও আগে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২১ বাস্তবায়ন হবে আমাদের পথরেখা যার মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যাব কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।

অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা ও বাস্তবতা— 

 বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় লেখক লুৎফর রহমানের কয়েকটি আলোচিত মহৎ জীবন, উন্নত জীবন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘কোনো ছেলে যদি বলে সে বাজারে যায়নি, বা বাজার করেনি কিংবা কোনো মেয়ে যদি বলে সে রান্না ঘরে যায়নি ও রান্না করেনি, তাহলে তারা দুজনই অপদার্থ। কোনো কাজ না পারার ভেতরে কোনো গৌরব নেই, গৌরব পারার ভেতরেই।’

 বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় জ্ঞান নির্ভর শিক্ষাক্রম অনুশীলন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান লাভ করলেও দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সবই ‘জানে’ কিন্তু ‘করতে পারে না’। এখন সময়টা হচ্ছে ‘পারার’ শুধু, ‘জানার’ নয়।

 অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের ভবিষতের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের মতো এত ‘অতি সচেতন’ অভিভাবক বিশ্বে কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই বা বিদেশে যতটুকু পড়েছি ও ঘুরেছি চোখে পড়েনি। সেখানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করে একটি সিস্টেমের মধ্যে। বাচ্চারা স্কুলে যাতায়াত করে স্কুল বাসে বা নিজ দায়িত্বে। হলুদ রঙের স্কুল বাস দেখলে সবাই জায়গা দেয়, সম্মান করে। বেশিরভাগ দেশে কোনো কেন্দ্রীয় শিক্ষাক্রম নেই, কারিকুলাম তৈরি করা হয় ওই অঞ্চলের প্রয়োজনকে ভিত্তি করে। পাশের দেশ ভারতেও রাজ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রম বিদ্যমান রয়েছে।

 আমাদের ব্যর্থতা হলো, স্বাধীনতার পর আমরা কোনো শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ১৯৭৪ সালের ৩০ মে প্রথম ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ বা ‘ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে রিপোর্ট জমা দেন। কিন্তু এই রিপোর্ট বাস্তবায়নের আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়। ফলে এই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে এ পর্যন্ত অনেকগুলো শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও কোনো কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে দেশের শিক্ষাদর্শন, শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, পাঠদান পদ্ধতি ও মূল্যায়ন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে মনে হচ্ছে।

 কোনো কিছুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের আগে সে বিষয়টি ভালো করে জানতে হবে। অভিভাবক ও যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের আগে পুরো কারিকুলাম এবং তার আলোকে লিখিত পাঠ্যপুস্তক, অনুসন্ধানী বই, শিক্ষক সহায়িকা ও মূল্যায়ন নির্দেশনা পড়ে দেখতে হবে। কোনো আপত্তি থাকলে তা সরকারকে জানানোর সুযোগ রয়েছে। কারণ, বর্তমান শিক্ষাক্রম–সংশ্লিষ্ট সব প্রকাশনারই ‘পরীক্ষণমূলক সংস্করণ’ অর্থাৎ এগুলো চূড়ান্ত নয়। এখানে জনগণ বা বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিয়ে বইগুলোর সংযোজন-বিয়োজন করে সম্পাদনার কাজটি করে একটি পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

 ‘স্কুলে শুধু আলুভর্তা, ডিম ভাজা আর ভাত রান্না করা শেখানো হয়, এগুলো শিখে কী করবে আমাদের বাচ্চারা?’ এমন অভিযোগ অভিভাবকদের। আমার বিনয়ী জিজ্ঞাসা তাঁদের কাছে, কোনো কিছু বাস্তবভাবে শেখা কি অন্যায়? অবস্থাই (সিচুয়েশন) বলে দেবে সে আলুভর্তা, ডিম ভাজা আর ভাত রান্না করবে কি করবে না। তা ছাড়া বিশ্বব্যাপী পেশা ও তার মর্যাদার পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমানে কোনো পেশাকেই আর ছোটো করে দেখা হয় না; বরং অপরিচিত বা নতুন সৃষ্ট পেশায় আয় ও মর্যাদা বেশি। যেমন যারা চুল কাটে, তাদের নাপিত বলা হতো এবং সামাজিকভাবে হেয় মনে করা হতো। অথচ বিশ্বব্যাপী এটি উচ্চ আয়ের একটি পেশা। এমনকি বাংলাদেশেও এখন ‘সেলুন’ প্রতিষ্ঠিত পেশা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। কাজেই উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরির চেয়ে কম শিক্ষিত দক্ষতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী এখন বেশি প্রয়োজন।

 উচ্চশিক্ষা বা কর্মোপলক্ষে বর্তমানে হাজারো ছেলেমেয়ে বিদেশে যাচ্ছেন, সেখানে যাওয়ার পর তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ কে করবে। আমেরিকা বা ইউরোপে কাজের জন্য ঘণ্টা হিসেবে মজুরি পাওয়া যায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সমান। এখন তাকে যদি কাজের জন্য সাহায্যকারী বা গৃহকর্মী রাখতে হয়, তাহলে গৃহকর্মীর মজুরি ও নিজের রোজগার সমান হলে জীবন কীভাবে চলবে? অতএব নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে আর এ শিক্ষাই দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমে। তাহলে হাতের কাজ শেখাতে সমস্যা কোথায়?

এ প্রসঙ্গে নিজের কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। ২০০৯-১০ সময়ে সরকারি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ফিলিপাইনের ডিলা সাল্লে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই মাস্টার অব এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করতে। সেখানে একজন শিক্ষক আমাদের একটি কোর্স পড়াতেন। পাঠদানে চার দিন ছিল মুখোমুখি ক্লাস ও দুই দিন অনলাইনে। কোনো পরীক্ষা নেই। মূল্যায়নের নম্বর ছিল এ রকম— উপস্থিতি ২৫%, ক্লাস পারফরম্যান্স ২৫% এবং অ্যাস্যাইনমেন্ট ৫০%, মোট ১০০। তবে অ্যাস্যাইনসেন্ট লেখার ২টি শর্ত ছিল— ১. ন্যূনতম ১০টি রেফারেন্স থাকবে, ২. প্রকাশিত রেফারেন্স হবে ২০০০ সালের পর। শর্ত দেখে প্রথমে খুব আনন্দ লাগলেও পরে বুঝেছি অ্যাসাইনমেন্ট লেখার ঠেলা। অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে গিয়ে নাওয়া-খাওয়া হারাম, মাথার চুল ছিঁড়ি সারাক্ষণ। মনের মতো কিছু পাই না। কোনোটা ভালো লাগলে দেখা যায়, সেটি ২০০০ সালের আগে প্রকাশিত। অভিধান দেখে ইংরেজি বুঝতে গিয়ে জীবন ত্যানা ত্যানা। কিন্তু ডিগ্রি অর্জন করে অপার প্রশান্তি লাগে, পরীক্ষা ছাড়াও কীভাবে বিদ্যার্জন করা যায়, তা দেখে অভিভূত হই।

ফাইল ছবি

এই কোর্সের অংশ হিসেবে আমরা কিছু স্কুল পরিদর্শন করি, সেখানে শ্রেণিভিত্তিক পড়ার চেয়ে কর্মভিত্তিক পড়ার প্রসার দেখেছি। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা আমাদের কেক, নুডলস বানিয়ে খাইয়েছে, তারা শারীরিক কসরত দেখিয়েছে। ম্যানিলা থেকে জাহাজে সেবু দ্বীপে যাওয়ার পথে শিক্ষার্থীদের দেখেছি কোর্সের অংশ হিসেবে জাহাজ পরিষ্কার করতে। এগুলো তারা আনন্দের সঙ্গে করছে।

 সিডার সহায়তায় সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আইসিটি অ্যান্ড পেডাগোজিক্যাল ডেভেলপটমেন্ট’–এর ওপর ডিপ্লোমা কোর্স করতে প্রায় এক মাস সুইডেনের স্টকহোম ও কার্লস্টাডে অবস্থান করতে হয়েছে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে স্টকহোমের একটি বিদ্যালয় পরিদর্শনের সুযোগ হয়। আমরা বিদ্যালয়ে পৌঁছলে শিক্ষার্থীরা স্বাগত জানায় এবং গাইডের কাজ করে। আমি একটি ক্লাসে ঢুকে দেখি, কেউ নেই। পরে শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের পাওয়া গেল মাঠের পাশে গাছের তলায়। বিষয় ও বিষয়বস্তুর প্রয়োজনে তারা শ্রেণিকক্ষের বাইরে ক্লাস করছে।

 প্রাথমিক স্তরের অন্য একটি ক্লাসে গিয়ে দেখা গেল, শিশু শিক্ষার্থীরা ইলেকট্রিক যন্ত্র দিয়ে কাঠের কাজ করছে। প্রথমে দেখে ঝুঁকিপুর্ণ মনে হলেও পরে দেখি, প্রত্যেক শিক্ষার্থী পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসামগ্রী ব্যবহার করেছে। একজন শিশু একটি কাঠের টুকরার ওপর যস্ত্র দিয়ে আমার নাম খোদাই করে লিখে দিয়েছে, যা আজও স্মৃতি হিসেবে আমার কাছে রক্ষিত আছে।

 সুইডেনে আমার থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন ড. হেনরিখ হেনসন। অসম্ভব ভালো মানুষ, দুনিয়াব্যাপী রয়েছে তাঁর পিএইচডি ফেলো। আমার সঙ্গে সম্পর্কের জের ধরে আমি বললাম, ‘ডিয়ার হেনরিখ (সুইডেনে সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকে, স্যার বলে না), শিক্ষাজীবনে আমার আটটি সনদ আছে, আমি কি তোমার স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতে পারি।’

 ড. হেনরিখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘ওয়েল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগে দেখবে যে কাজের জন্য তোমাকে নিয়োগ করা হবে, সে কাজটি তুমি পারো কি না, যদি পারো, তাহলে তারা তোমার সনদ খুঁজবে, অন্যথায় নয়।’

 বর্তমান বিশ্ব যোগ্য ও দক্ষ কর্মী খোঁজে, উত্তম সনদধারীকে নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী কর্মকুশল জনগোষ্ঠী তৈরিতে বর্তমান কারিকুলাম অত্যন্ত যৌক্তিক। এতে দুর্বলতা থাকতে পারে, যা খুঁজে বের করে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। ঢালাও সমালোচনা না করে মাইন্ড সেট পরিবর্তন করে বর্তমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সবার ভূমিকা রাখা একান্ত কর্তব্য বলে মনে করি। এই কারিকুলাম সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শুরু হবে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথচলা।

 *লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা