উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ কি বাড়ছে?

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি (৫০.৪৩ শতাংশ) নারী। তাই দেশকে উন্নয়নের পথে এগোতে হলে নারীসমাজকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। দেশে বর্তমান প্রায়োগিক সাক্ষরতাসম্পন্ন মানুষের হার ৬২.৯২ (৭+)। তবে ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সাক্ষরতায় পুরুষের চেয়ে নারীরা এগিয়ে রয়েছে। এটা সবার জানা যে শিক্ষার সঙ্গে নারীর উন্নয়ন বা ক্ষমতায়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মূলত নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ। সেই সুযোগের শুরু হয় শিক্ষা দিয়ে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ ও সফলতার হার আগের তুলনায় বাড়ছে। দেশে প্রায় সব পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পাসের হার এবং সিজিপিএ উভয় ক্ষেত্রেই এগিয়ে থাকছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা কার্যক্রমে ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে থাকার পর মেয়েদের এ অগ্রযাত্রা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।

যেকোনো দেশের অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে সে দেশের উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি ও মানের ওপর। বর্তমানে দেশে সার্বিকভাবে শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। এ স্তরে ভর্তির সংখ্যা ও ছাত্রী ভর্তির অনুপাতও বেড়েছে। গত ১০ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালে ছাত্রী ভর্তির হার ছিল প্রায় ৩৮ শতাংশ। সেখানে গত বছর (২০২৪) তা বেড়ে হয়েছে ৫০.৪১ শতাংশ। এ ছাড়া বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৬১.৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ৫৫ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় প্রায় ৫১.৮৩ শতাংশই নারী। অর্থাৎ দেশে সব পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সমান। এ ছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৫ শতাংশের বেশি ছাত্রী। তবে কারিগরি শিক্ষায় ছাত্রীদের হার ২৯ শতাংশের একটু বেশি। যদিও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েদের ভর্তিকে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। পক্ষান্তরে ছেলেদের এ শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। তারপরও সামাজিক সচেতনতার কারণে এ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে।

আরও পড়ুন
সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে নারীদের উচ্চশিক্ষার পথ আরও সহজ হওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, আবাসন ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

ইউনেসকোর এক তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশই নারী (স্নাতক পর্যায়ে এ হার ৪৪ শতাংশ ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে (৫৫ শতাংশ) এবং পিএইচডি পর্যায়ে ৪৩ শতাংশ। বৈশ্বিক হিসাবে উচ্চশিক্ষায় নারীরা পুরুষের প্রায় সমকক্ষ। অধুনা নারীর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবে সহায়তা করে। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। নারী মস্তিষ্ক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও অঙ্ক শেখার উপযোগী নয়, এমন বদ্ধ ধারণা একসময় এ দেশের সমাজে বেশ প্রবল ছিল। নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখার পক্ষে ছিল অভিভাবক সমাজ। বিআইজিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নারীদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন এখনো স্বল্পশিক্ষিত নারীদের প্রায়ই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু একই শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী পুরুষদের এভাবে বিচার করা হয় না। আশার বাণী হলো, ক্রমেই দেশে নারীশিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করায় সমাজের সেই মনোজাগতিক অবস্থার খানিকটা হলেও পরিবর্তন ঘটেছে।

প্রতীকী ছবি

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে¯স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৪১ শতাংশ নারী লেখাপড়া করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৪৭ শতাংশ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত যথাক্রমে ৫২ ও ৪৮ শতাংশ। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের সংখ্যা আরও কম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা ৭১ শতাংশ আর ছাত্রী মাত্র ২৯ শতাংশ। তবে কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ২ হাজার ৩৩ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে নারী শিক্ষার্থী মাত্র ৫৮৯ জন (২১.২৫ শতাংশ) এবং ৫৪৮ জন শিক্ষকের মধ্যে নারী মাত্র ১৭৪ জন (২৪.০৯ শতাংশ)। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি–বেসরকারি মাস্টার্স স্তরে ৩৪ শতাংশ, ডিগ্রি (সম্মান) স্তরে ২৭ শতাংশ, ডিগ্রি (পাস) স্তরে ২৩ শতাংশ, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মাত্র ২৩ শতাংশ নারী শিক্ষক কর্মরত। এ ছাড়া চিকিৎসা, আইন, কৃষিশিক্ষাসহ দেশের পেশাগত শিক্ষায় যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার মধ্যে ৬১ শতাংশের বেশি নারী। এছাড়া দেশে পেশাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিপ্রাপ্ত মোট শিক্ষার্থীর ৬১.৫০ শতাংশ নারী। আবার চিকিৎসা শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ১০৯টি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশ নারী।

আরও পড়ুন

দেশ যতই এগিয়ে চলেছে, পুরুষের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তারা শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশে বিসিএসসহ নানা প্রতিযোগিতায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তা ব্যাপক না হওয়ায় সমাজে নারীর শক্ত কোনো অবস্থানের জানান দিতে পারছে না; ফলে আর্থসামাজিক কাঠামোয় নারীর জন্য খুব বেশি ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে না। সরকারি কর্মকমিশনের তথ্যানুযায়ী, ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় চাকরির জন্য সুপারিশ কৃত ২২০৪ জনের মধ্যে ১৬১১ জন (৭৩.০৯ শতাংশ) পুরুষ এবং ৫৯৩ জন (২৬.৯১ শতাংশ) নারী। এর আগে ৩৭তম বিসিএসে সুপারিশকৃত ১৩১৩ জনের মধ্যে ৯৯০ জন (৭৫.৪০ শতাংশ) পুরুষ এবং ৩২৩ জন (২৪.৬০ শতাংশ) নারী। ৪০তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশকৃত ৪০০০ জনের মধ্যে ২০৩৯ জন (৫০.৯৮ শতাংশ) পুরুষ এবং নারী ১৯৬১ জন (৪৯.০২ শতাংশ)। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের সফলতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

প্রতীকী ছবি

নারীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সমাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে দারিদ্র্য, উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আবাসনের সুবিধা না থাকা, বাল্যবিবাহ, সমাজিক নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তারপরও বিভিন্নভাবে নারীদের শিক্ষামুখী করার চেষ্টা চলছে। সরকারি প্রতিবেদন, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি, অভিভাবকদের সচেতনতা এবং শিক্ষার মর্যাদা উপলব্ধি থেকে শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণের হার দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনা মূল্যে বই প্রদান, আর্থিক সহায়তা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু, নিয়মিত মনিটরিং, উপবৃত্তিসহ নানা প্রণোদনার কারণে মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে, তারা নিয়মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসছে, ভালো ফলও করছে। অর্থাৎ শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়ায় নারীরা বেশ এগিয়েও যাচ্ছে। তবে সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যৌথ উদ্যোগে নারীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ আরও সহজ হওয়া দরকার। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, আবাসন ও পরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই উচ্চশিক্ষায় যাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে সে লক্ষ্যে নারীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। নারীরা যেভাবে শিক্ষায় এগিয়ে চলেছে, তাদের সে ধারা যেন অব্যাহত থাক। সমাজে শিক্ষা আলো হয়ে নারী-পুরুষ উভয়কে সঠিক পথে পরিচালিত করুক। সেটাই হোক আজকের দিনের প্রত্যাশা।

*লেখক: সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর