শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, নেই পরিকল্পিত সমাধান
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কুয়েটে উপাচার্যসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কুয়েটে তিন মাস ধরে অচলাবস্থা চলছে।
নাম পরিবর্তনের দাবিতে ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতেও চার মাস ধরে অচলাবস্থা।
পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। কোথাও উপাচার্য অপসারণ, কোথাও নাম পরিবর্তনের দাবি, আবার কোথাও আবাসন-সংকটের মতো বিষয় নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন থামে তো আরেকটিতে শুরু হয়। বেশ কিছু দিন ধরে অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনাস্থাসহ ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম, তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক জটিলতাও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার এমন সংকট নিরসনে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখাচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কেবল কোনো ঘটনা ঘটলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছে। অথচ শিক্ষা খাত নিয়ে সংস্কার কমিশনও গঠন করা হয়নি। শিক্ষাবিদদের পরামর্শ, কোনো ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয় সরকার। এরপর ১ মে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক মো. হযরত আলীকে কুয়েটের অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গত মার্চে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার)। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান অস্থিরতার বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারের সঙ্গে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। আর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়ের কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কীভাবে আরও জোরদার করা যায়, সে জন্য টিএসসি-কেন্দ্রিক কার্যক্রম বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ, কোনো ঘটনা ঘটলেই কেবল প্রতিক্রিয়া নয়, সামগ্রিকভাবে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনা করে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা নিতে হবে।
উচ্চশিক্ষায় ধাক্কা
বর্তমানে দেশে ৫১টি সরকারি ও ৪টি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া প্রায় সব কটি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ শীর্ষ পর্যায়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেন। এ কারণে প্রথমে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করাই ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। পরে ধীরে ধীরে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন উপাচার্য দেয়।
উপাচার্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসতে শুরু করে। তবে এরই মধ্যে আবারও শুরু হয় অস্থিরতা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ শীর্ষ পদে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে সরকারকে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপাচার্য ও সহ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয় সরকার। এরপর ১ মে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) অধ্যাপক মো. হযরত আলীকে কুয়েটের অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। ওই সংঘর্ষ ও শিক্ষক লাঞ্ছিতের ঘটনায় বিচারিক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার অভিযোগে শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। কর্মবিরতির পর এখন প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকেও বিরত থাকার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক সমিতি। এসব কারণে তিন মাস ধরে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ আছে প্রকৌশল শিক্ষার এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ৭ হাজার।
নিয়োগের কয়েক মাসের মাথায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষ তিনটি পদে থাকা অধ্যাপকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৩ মে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে সরিয়ে দেয় সরকার। এখন সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলমকে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। একজন শিক্ষককে পুনর্বহাল এবং রেজিস্ট্রারকে অপসারণের দাবিকে কেন্দ্র করে গত ২৭ এপ্রিল থেকে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে উপাচার্য অপসারণেও দাবি ওঠে। এর ফলে কয়েক দিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনার জেরে আন্দোলনে নেমেছে সংগঠনটি। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করেছে সংগঠনটি।
আবাসন-সংকটের সমাধানসহ (৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা অন্তর্ভুক্তির দাবিসহ) কয়েকটি দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টানা তিন দিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ মে সরকার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
দুই দশক আগে কলেজ থেকে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ছাত্রদের জন্য এখনো কোনো আবাসিক হল তৈরি হয়নি। ছাত্রীদের জন্য শুধু একটি আবাসিক হল থাকলেও সেটিও চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।
নিয়োগের কয়েক মাসের মাথায় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষ তিনটি পদে থাকা অধ্যাপকদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৩ মে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে সরিয়ে দেয় সরকার। এখন সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌফিক আলমকে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে।
সরকারের একজন নীতিনির্ধারণ প্রথম আলোকে বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার পর অনেক সময় চলে গেলেও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়টি অবহেলা করা হয়েছে। এ কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আছে।
এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসেও দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা; কিন্তু বাস্তবতা হলো সমস্যার সমাধান করা হয়নি।
অবশ্য কমবেশি আবাসন-সংকট আছে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই। ২০২২ সালের তথ্য নিয়ে করা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ-মাদ্রাসা ছাড়া) অধ্যয়নরত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০ শতাংশের আবাসিক সুবিধা নেই। বাকি ৪০ শতাংশের এই সুবিধা আছে।
আবাসন-সংকটের সমাধানসহ (৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন ভাতা অন্তর্ভুক্তির দাবিসহ) কয়েকটি দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টানা তিন দিনের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ মে সরকার দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
নাম পরিবর্তন নিয়ে চার মাস ধরে অচলাবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবিতে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্দোলন করছেন গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ’। অন্তর্বর্তী সরকার গত ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি করেছে। যদিও প্রথমে বাংলাদেশ ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি নামকরণের পর থেকেই ক্ষুব্ধ হন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা প্রথমে বাংলাদেশ ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি নামের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। দাবি আদায়ে স্মারকলিপি, মানববন্ধন, শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা, ‘রেল ব্লকেড’, ‘শাটডাউন’সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এর মধ্যে আশ্বাসের ভিত্তিতে কখনো কখনো কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও এখনো দাবি পূরণ হয়নি। তাঁরা এখন চারটি নাম প্রস্তাব করে তার মধ্য থেকে যেকোনো একটি চূড়ান্ত করার দাবি জানিয়েছেন। প্রস্তাবিত চারটি নাম হলো বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবিতে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্দোলন করছেন গাজীপুর ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।
এই দাবিতে সোমবার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনেও তারা কর্মসূচি পালন করেছে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মো. ফখরুল হাসান ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, পরবর্তী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব ওঠার আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি চলবে।
অনেকটা অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ইউজিসির কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা। এ কারণে প্রায় চার মাস ধরে একধরনের অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রায় পৌনে ৫০০ শিক্ষার্থী।
গত জানুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটা বাতিলসহ তিন দাবিতে প্রশাসন ভবনে তালাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। একই দাবিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রশাসনিক ভবন অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল।
পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আন্দোলন হলে দ্রুতই দাবি পূরণ হচ্ছে; কিন্তু তার আগে সংকটগুলো চিহ্নিত করে তা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনার জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করেছে সংগঠনটি।
সাত কলেজ নিয়েও আছে সংকট
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত ইউজিসির তত্ত্বাবধানে সমন্বিত কাঠামোর অধীন চলবে ঢাকার সরকারি সাত কলেজের কার্যক্রম। অন্তর্বর্তী এই ব্যবস্থায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে কাজটি আটকে ছিল। এ নিয়ে গত শনিবার আবারও আন্দোলনের হুমকি দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
এ রকম পরিস্থিতিতে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াসকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে তাঁকে আগামী দুই বছরের জন্য ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গত রোববারই প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
অভিযোগ উঠেছে, এই সিদ্ধান্ত অনেক আগেই হয়েছিল; কিন্তু প্রশাসক পদে মিরপুর বাঙলা কলেজের একজন শিক্ষকের চেষ্টা ছিল। মূলত এ কারণেই বিষয়টি আটকে ছিল।
দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে কারণ ও যুক্তি দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এমন আন্দোলন আমরা দেখতে চাই না। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুর
ঢাকার এই সাত সরকারি কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজের মোট শিক্ষার্থী প্রায় দুই লাখ।
অবশ্য সাত কলেজকে নিয়ে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ গঠনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাঁদের দাবি, সাত কলেজ থেকে তিতুমীরকে আলাদা করে স্বতন্ত্র কাঠামো গঠনের মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করতে হবে।
এই কলেজগুলো একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ছিল। ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। তখন থেকে নানা সমস্যা চলছিল।
জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ পদোন্নতির কোটা বাতিলসহ ছয় দফা দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিল ‘শাটডাউন’ সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ। গত এপ্রিল থেকেই এসব আন্দোলন চলছে। এর মধ্যে ২৯ এপ্রিল থেকে ৭ মে পর্যন্ত ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি চলে। অবশ্য এখন শ্রেণি কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত ইউজিসির তত্ত্বাবধানে সমন্বিত কাঠামোর অধীন চলবে ঢাকার সরকারি সাত কলেজের কার্যক্রম। অন্তর্বর্তী এই ব্যবস্থায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে কাজটি আটকে ছিল। এ নিয়ে গত শনিবার আবারও আন্দোলনের হুমকি দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সমাধান কী
এর আগে গত বছর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে এইচএসসির কয়েকটি পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এ ছাড়াও বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে অপমান-অপদস্থ করার ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এখন আবার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতার বিষয়টি সামনে এসেছে।
জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ পদোন্নতির কোটা বাতিলসহ ছয় দফা দাবিতে বেশ কিছু দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুর প্রথম আলোকে বলেন, দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে কারণ ও যুক্তি দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, এমন আন্দোলন আমরা দেখতে চাই না। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। সংক্ষুব্ধ অংশের কথা শুনতে হবে। আন্দোলনকারীদেরও উচিত ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি জানানো। শুরুতেই আলটিমেটাম দিয়ে আন্দোলনকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিকতার সঙ্গে নজর দেওয়ার জন্য বলতে পারে। যেসব দাবি সরাসরি সরকারের কাছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা যাচাই করার জন্য উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে দিতে পারে।