যুক্তরাষ্ট্র হারাতে যাচ্ছে ১৫০০০০ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি, শিক্ষায় বড় ধাক্কা
মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের সম্ভাবনা।
৬০ হাজারের বেশি চাকরি হুমকির মুখে পড়তে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া-নিউইয়র্ক বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসছে শরতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমবে। ফলে ১ লাখ ৫০ হাজার পর্যন্ত শিক্ষার্থী হারাতে পারে দেশটি। এতে মার্কিন উচ্চশিক্ষা খাতে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (৭০০ কোটি ডলার) রাজস্ব হারানোর ঝুঁকি বা ক্ষতি হতে পারে। এ কারণে ৬০ হাজারের বেশি চাকরি হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। দেশটির অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেটরস এবং জেবি ইন্টারন্যাশনালের (এনএএফএসএ) এক গবেষণায় এ কথা জানিয়েছে। মার্কিন স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেম (এসইভিআইএস) ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাম্প্রতিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এ অনুমান করেছে এনএএফএসএ।
মার্কিন শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের উৎস নন; বরং মার্কিন অর্থনীতিতে, গবেষণায় ও বৈচিত্র্যময় ক্যাম্পাস সংস্কৃতিতে বিশাল অবদান রাখেন। ফলে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটে ঘাটতি, গবেষণা ও শিক্ষার মানে পতন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে ব্যয় কমে যাওয়া (যেমন হাউজিং, খাবার, পরিবহন) ইত্যাদি।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন কর্তৃক সাম্প্রতিক ভিসা নীতি, নানা নির্বাহী আদেশ এবং নানা যাচাই-বাছাইব্যবস্থার কারণে প্রত্যাশিত শিক্ষার্থী হ্রাসের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আগস্টের মধ্যে শিক্ষার্থী ভিসা ইস্যুর দ্রুত সমাধান না হলে বা আগের অবস্থায় না ফিরলে, মোট আন্তর্জাতিক মিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা ১৫ শতাংশ হ্রাস হতে পারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে গবেষণায়।
২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে, মার্কিন কলেজগুলোতে ১ কোটি ১২ লাখ ৬ হাজার ৬৯০ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক শিক্ষা ইনস্টিটিউটের ওপেন ডোরস রিপোর্ট অনুসারে এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এই শিক্ষার্থীরা মোট মার্কিন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীর ৬ শতাংশ ছিলেন এবং যাঁরা পড়াশোনার সঙ্গে অস্থায়ী কর্মসংস্থানের জন্য যুক্ত থাকেন।
গুরুত্বপূর্ণ কোন কোন অঙ্গরাজ্য বড় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে
এনএএফএসএর প্রতিবেদন অনুসারে, নতুন বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে এর প্রভাব পড়বে। কেবল ক্যালিফোর্নিয়ারই ক্ষতি হবে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। নিউইয়র্কের ক্ষতিও প্রায় কাছাকাছি হতে পারে। ইলিনয়, ম্যাসাচুসেটস, ওহিও, টেক্সাস, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও ফ্লোরিডা ক্ষতি হতে পারে ২০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি।
ভিসার সাক্ষাৎকার স্থগিতকরণ
এ বছরের ২৭ মে থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকার স্থগিত করা হয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত ভারত, চীন, নাইজেরিয়া ও জাপান থেকে কোনো শিক্ষার্থী ভিসা পাননি। ফলে শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা প্রায় বন্ধ ছিল (আগের ইস্যু করা ভিসায় যাতায়াত হয়েছে)। সর্বোচ্চ সময় ভিসা সাক্ষাৎকার বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছে। মার্কিন সরকার কনস্যুলেটগুলোকে এখন আবেদনকারীদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ভিসা প্রদান হ্রাস
২০২৫ সালে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভিসা এফ–১ (F-1) পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১২ শতাংশ, মে মাসে ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যদিও জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকায় পুরো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে হ্রাসের এ সংখ্যা ৯০ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ভিসা নিষেধাজ্ঞা
এ বছরের ৪ জুন রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প ১৯টি দেশের ভিসা আবেদনকারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। আসছে সময়ে আরও ৩৬টি দেশ এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বলে এনএএফএসএর প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
এনএএফএসএ বলেছে যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ টিউশন ফি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা ফি প্রদান করেন। ফলে মার্কিন কলেজগুলোকে দেশি শিক্ষার্থীদের খরচে ভর্তুকি দিতে সাহায্য করে।
এনএএফএসএ বলেছে, অভিবাসনবিরোধী নীতির ফলে শিক্ষার্থী ভর্তি কমে যাওয়া এবং রাজস্বের প্রভাব ফেলার বা ক্ষতির পূর্বাভাস উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ট্রাম্প বনাম বিদেশি শিক্ষার্থী
গত কয়েক মাসে ট্রাম্প প্রশাসন কয়েক হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, স্থগিত করেছে, বিশেষ করে যাঁরা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সহানুভূতিশীল বলে বিবেচিত। ২০২৫ সালের এপ্রিলের মধ্যে এক হাজারের বেশি ভিসা বাতিল করা হয়েছিল। হামাসের মতো সংঘটন বা ইহুদিবিরোধী কার্যকলাপের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা সহানুভূতিশীল বা সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের শিক্ষার্থী ভিসা বাতিল এবং ভিসা নবায়ন স্থগিত করা হয়েছিল। এটিকে ট্রাম্প প্রশাসনের ‘ধর এবং প্রত্যাহার’ কৌশল বাস্তবায়নের অংশ। এ সময় ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী মাহমুদ খলিল এক মামলায় জড়িত অভিযোগে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিনি বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের। এই আইন লঙ্ঘনের জন্য নানা সমালোচনার মুখে পড়ে ট্রাম্প প্রশাসন।
এদিকে ২০২৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ‘চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত বা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অধ্যয়নরত চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করবে’ এবং এর সঙ্গে এফ, এম এবং জে ভিসা আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাচাই-বাছাই বৃদ্ধি করা হবে। মার্কিন কনস্যুলেটগুলো মে মাসের শেষের দিক থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকার সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছিল। পরে কঠোর নিয়মের মাধ্যমে আবার ভিসা আবেদন শুরু হয়েছে এই শর্তে যে আবেদনকারী তাঁদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল পর্যালোচনার জন্য পাবলিক করে রাখবেন। এই নীতি বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয় বাড়িয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে ওপর প্রভাব ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে এবং নতুন আবেদনকারীদের আকৃষ্ট করতে নানা নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। তবে সরকারিভাবে দ্রুত সমাধান না হলে এ প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চশিক্ষা খাতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।