‘দুটি ল্যাপটপ, ছয়টি প্ল্যাগ’: কোরিয়ায় ক্যাফেতে শিক্ষার্থী ও চাকরীপ্রার্থীদের পড়াশোনা, বিপাকে মালিকেরা

প্রতীকী ছবিপ্রথম আলো গ্রাফিকস

দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো কফি শপে একজন গ্রাহক এসে কফি অর্ডার করলেন। অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে দুটি ল্যাপটপ, ছয়টি প্ল্যাগ, কি–বোর্ড, মাউস আর লম্বা তারের সংযোগ নিয়ে আয়েশ করে একটি আসনে বসে পড়লেন। শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রার্থীদের এ বসা সারা দিনের জন্য। কোরিয়ার ক্যাফেগুলোর এ ব্যাপারটিকে বলা হয় ‘ক্যাগংজোক’ সংস্কৃতি। ক্যাগংজোকদের এমন কর্মকাণ্ডে বিপাকে ক্যাফের মালিকেরা। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের ক্যাফেতে দিনভর থাকা কেন আর মালিকেরা কী ঝামেলায় পড়ছেন, তা নিয়ে বিবিসি কোরিয়ার প্রতিবেদক জুনা মুনের প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।

দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের অভিজাত এলাকা দেইচিতে একটি ক্যাফের মালিক হিউন সুং-জু। সে ক্যাফের ঘটনা এটি। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং দক্ষিণ কোরিয়ার ক্যাফেমালিকদের জন্য এমন ঘটনা নিত্যদিনের। আর এটি মালিকদের জন্য মাথাব্যথারও। কারণ, শিক্ষার্থী সারা দিন ক্যাফেতে বসে পড়াশোনা করছেন। এ নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া তরুণ-তরুণীদেরই বলা হচ্ছে ক্যাগংজোক। এটি একটি কোরিয়ান শব্দ, যা দিয়ে সেসব তরুণ-তরুণীকে বোঝানো হয়, যাঁরা ক্যাফেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়াশোনা বা কাজ করতে ভালোবাসেন।

আরও পড়ুন

হিউন সুং-জু বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমি পাওয়ার আউটলেটগুলোই (বিদ্যুৎ–সংযোগ) বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। দেইচির মতো জায়গায় দোকানের ভাড়া অনেক বেশি। যদি একজন গ্রাহক সারা দিন একটি আসন দখল করে রাখেন, তাহলে আমাদের ক্যাফে চালানো খুব কঠিন হয়ে যায়। কারণ, এ এলাকায় ক্যাফে চালানো কঠিন।’

কোরিয়ার যেসব এলাকায় ছাত্রছাত্রী ও অফিস কর্মীদের আনাগোনা বেশি, সেখানে ক্যাগংজোক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যুক্তরাজ্যের ক্যাফেগুলোয় পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে মানুষের যাতায়াত দেখা যায়, কিন্তু কোরিয়ার ক্যাফেগুলোয় ক্যাগংজোকদের দাপট বেশি।

প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো গ্রাফিকস

স্টারবাকস বদলাচ্ছে নিয়ম

চলতি মাসে আমেরিকান বহুজাতিক কফি হাউস স্টারবাকস জানিয়েছে, কিছু গ্রাহক ল্যাপটপ বাদ দিয়ে ডেস্কটপ মনিটর, প্রিন্টার নিয়ে আসছেন। অনেকে টেবিলে কাজের পর দীর্ঘ সময়ের জন্য টেবিল খালি রেখে বাইরে খেতে চলে যাচ্ছেন। এ সমস্যার সমাধানে স্টারবাকস কোরিয়া নতুন কিছু নির্দেশিকা চালু করেছে। এর লক্ষ্য হলো ‘কিছু ঘটনা’ নিয়ন্ত্রণ করা, যা অন্য গ্রাহকদের জন্য অসুবিধা তৈরি করে।

স্টারবাকস জানিয়েছে, কর্মীরা গ্রাহকদের সরাসরি চলে যেতে বলবেন না; বরং প্রয়োজনে নম্রভাবে ‘নির্দেশনা’ দেবেন। অতীতে গ্রাহকদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের মূল্যবান জিনিসপত্র চুরির ঘটনাও ঘটেছে। তাই এ নতুন নির্দেশিকাকে ‘আরও আরামদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরির পদক্ষেপ’ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

তবে মনে হচ্ছে না যে এ নতুন নিয়ম মাঝারি মাপের ক্যাগংজোকদের আটকাতে পারছে। সম্প্রতি এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিউলের গ্যাংনাম জেলার একটি স্টারবাকস শাখায় দেখা গেল, অনেক গ্রাহক শান্তভাবে ল্যাপটপ ও বই নিয়ে পড়াশোনা করছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘সুনেউং’-এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমি বেলা ১১টার দিকে এখানে আসি এবং রাত ১০টা পর্যন্ত থাকি। কখনো কখনো আমি আমার জিনিসপত্র রেখেই কাছাকাছি কোথাও খেতে চলে যাই।’

৭ আগস্ট নতুন নির্দেশিকা জারির পর স্টারবাকসে কোনো ডেস্কটপ মনিটর বা প্রিন্টারের মতো বড় সরঞ্জাম আর চোখে পড়ছে না। তবে স্ট্যান্ডে রেখে ল্যাপটপ, কি–বোর্ড ও মাউসের ব্যবহার চলছে। নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে কি না, জানতে চাইলে স্টারবাকস কোরিয়া বিবিসিকে জানিয়েছে, বিষয়টি ‘নিশ্চিত করা কঠিন’।

আরও পড়ুন

মিশ্র প্রতিক্রিয়া

স্টারবাকসের এ পদক্ষেপে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বেশির ভাগ মানুষই এ নীতিকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিশেষ করে যাঁরা স্টারবাকসে আড্ডা দিতে বা আরাম করতে আসেন। তাঁরা বলছেন, ক্যাগংজোকদের কারণে আসন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল এবং সেখানকার নিস্তব্ধ পরিবেশের কারণে তাঁরা স্বাধীনভাবে কথা বলতেও অস্বস্তি বোধ করতেন। অন্যদিকে কয়েকজন এর সমালোচনা করে বলেছেন, চেইন শপটি তাদের আগের উদার নীতি থেকে সরে এসেছে।

এ ঘটনা দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্যাগংজোক নিয়ে নানা আলোচনা–সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়েছিল ক্যাগংজোক সংস্কৃতি। ওই সময় থেকেই দেশটিতে কফি চেইনের ব্যাপক বিস্তার ঘটতে থাকে। চাকরিদাতা বা নিয়োগদাতা প্ল্যাটফর্ম জিনহাকসা ক্যাচের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, দুই হাজারের বেশি জেন–জি চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা সপ্তাহে অন্তত একবার ক্যাফেতে দিনভর পড়াশোনা করেন।

প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো গ্রাফিকস

অন্য ক্যাফের ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ

‘আসন দখল’–সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবিলা করা স্বাধীন ক্যাফেমালিকদের জন্য কঠিন কাজ। হিউন বলেন, যদিও কিছু গ্রাহক একাধিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে আসেন, তবে এ ধরনের চরম ঘটনা খুব বিরল। ১৫ বছর ধরে ক্যাফে চালানো হিউন বলেন, ‘১০০ জনের মধ্যে হয়তো ২–৩ জন এমন করেন। বেশির ভাগ মানুষই বিবেচক। কেউ কেউ দীর্ঘ সময় থাকলে আরেকটি ড্রিংক অর্ডার করেন এবং তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

তবে সব মালিক কিন্তু হিউনের মতো এতটা উদার নন। জিওনজু শহরের এক ক্যাফেমালিক কিম বারবার চেয়ার–টেবিল দখলের অভিযোগ পাওয়ার পর একটি ‘নো স্টাডি জোন’ নীতি চালু করেছেন। তিনি বলেন, ‘২ জন মানুষ এসে ১০ জনের বসার জায়গা নিত। কখনো কখনো তারা খেতে বাইরে যেত এবং ফিরে এসে আবার পড়াশোনা করত সাত-আট ঘণ্টার জন্য। অবশেষে আমরা একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছি।’ সাইনবোর্ড লেখা আছে, ‘এ জায়গা কথা বলার জন্য, পড়াশোনার জন্য নয়।’ এখন তাঁর ক্যাফেতে যাঁরা পড়াশোনা বা কাজ করার জন্য আসেন, তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো গ্রাফিকস

কেন শিক্ষার্থীরা পড়তে ক্যাফে যাচ্ছেন

এখন মনে হতে পারে কেমন এমন ঘটছে, এর পেছনের কারণ কী। কেন দক্ষিণ কোরিয়ার লাইব্রেরি বা বাড়ির পরিবর্তে ক্যাফেতে কাজ বা পড়াশোনা করার প্রয়োজন মনে করছেন?

আসলে কারও কারও জন্য ক্যাফে কেবল শান্ত পরিবেশের জায়গা নয়, নিজেকে খুঁজে পাওয়ারও জায়গা। ২৯ বছর বয়সী ইউ-জিন মো বিবিসিকে এক কঠিন শৈশবের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন। তিনি বলেন, ‘বাড়ি আমার জন্য কখনো নিরাপদ জায়গা ছিল না। আমি আমার বাবার সঙ্গে একটি ছোট কনটেইনারে থাকতাম এবং কখনো কখনো তিনি বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে আমাকে একা রেখে যেতেন।’ এমনকি এখন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তিনি একা থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটি ক্যাফেতে চলে যাই। লাইব্রেরি ও স্টাডি ক্যাফেতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেগুলো আমার কাছে শ্বাসরুদ্ধকর মনে হয়েছিল।’

কোরিয়ার আনসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চোই রা-ইয়ং দুই দশকের বেশি সময় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করছেন। ক্যাগংজোককে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার তীব্র প্রতিযোগিতামূলক সমাজের একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাদের তৈরি করা সমাজের দ্বারাই সৃষ্ট একটি যুব সংস্কৃতি। বেশির ভাগ ক্যাগংজোকই সম্ভবত চাকরিপ্রার্থী বা শিক্ষার্থী। তাঁরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছেন। পড়াশোনার চাপ, চাকরির নিরাপত্তাহীনতা, জানালাহীন বাসায় ও পড়াশোনার জায়গাবিহীন আবাসনের কারণে তাঁরা এটা করছেন। একদিক থেকে এই তরুণেরা এমন একটি ব্যবস্থার শিকার, যা তাঁদের কাজ বা শেখার জন্য পর্যাপ্ত স্থান সরবরাহ করে না। তাঁদের উপদ্রব মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁরা আসলে এ সামাজিক কাঠামোরই একটি ফল।’

আরও পড়ুন

অধ্যাপক চোই রা-ইয়ং মনে করেন, ‘এখন সময় এসেছে অন্তর্ভুক্তিমূলক জায়গা তৈরি করার। যদি আমরা এ সংস্কৃতিকে বাস্তবসম্মতভাবে জায়গা দিতে চাই, তাহলে আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যা অন্যদের বিরক্ত না করে ক্যাফেতে পড়াশোনার অনুমতি মেলে।’