রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাচ্ছে বড় ৯টি কলেজ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোকে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঢাকার বড় সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার সাত বছর পর এবার নয়টি সরকারি কলেজকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জেলা শহরে অবস্থিত সীমিত সংখ্যাক আরও কলেজকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হচ্ছে রাজশাহী জেলায় অবস্থিত চারটি কলেজ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলায় অবস্থিত পাঁচটি সরকারি কলেজ। এই কলেজগুলো এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার জন্য যে কলেজগুলো নির্বাচন করা হয়েছে সেগুলো হলো রাজশাহী সরকারি কলেজ, রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ এবং রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ। আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, চট্টগ্রামের হাজী মুহম্মদ মহসিন সরকারি কলেজ ও সরকারি কমার্স কলেজ, বোয়ালখালীর স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ এবং সাতকানিয়া সরকারি কলেজ।

এ বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া নির্দেশনা ও অনুশাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই কলেজগুলোকে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ যেমন, বিদ্যমান বিধিবিধান সংশোধন (প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে) ও অপরাপর করণীয় বিষয় সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়ার জন্য রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবু তাহের আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচটি কলেজকে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়েছেন। আগামীকালই ওই সব কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে সভা করার জন্য ডেকেছেন।

বর্তমানে সারা দেশে অনুমোদিত পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১৬৯টি। স্বায়ত্তশাসিত ৪টিসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৫টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১৪টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোট শিক্ষার্থী ৩১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি, যা দেশে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৭২ শতাংশ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ আছে ২ হাজার ২৫৭টি। ৫৫৫টি সরকারি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট কলেজের মধ্যে ৮৮১টিতে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়।

একসময় কলেজগুলো মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই চলত। একপর্যায়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপ কমাতে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কলেজগুলো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়। এখানে স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনা হয়। কিছু পেশাগত কোর্সেও ডিগ্রি দেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যে চিন্তা থেকে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, নানা কারণে তা পূরণ হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে দেশে কলেজের সংখ্যা কম ছিল। তারপরও প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে ইউজিসির বিভিন্ন সময়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর পড়াশোনার মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন আছে। ঠিকমতো ক্লাস না করে পরীক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার অভিযোগ আছে। বাস্তবতা ও চাহিদার মধ্যে সমন্বয় না করেই দীর্ঘদিন ধরে ঢালাওভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কলেজে স্নাতক (সম্মান) চালু করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ কলেজেই উচ্চশিক্ষায় পড়ানোর মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। শিক্ষার্থী ও কলেজের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সব কলেজকে ঠিকমতো দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আলোচনা আছে। ফলে এসব কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন না।

এ অবস্থায় এক দশক আগে ২০১৪ সাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সরকারি কলেজগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার আলোচনা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রথম দিকে এসব কলেজের পরীক্ষা ও ফলাফল নিয়ে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছিল। এখনো পুরোপুরি সব সংকট না কাটলেও ধীরে ধীরে ক্লাস-পরীক্ষা পরিস্থিতির উন্নত হয়েছে।

আরও পড়ুন

নানা কারণে ওই সাত কলেজের পর আর নতুন কোনো কলেজকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়নি। উদ্যোগটি থেমে ছিল। নতুন সরকারে নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দায়িত্ব নেওয়ার পর আবারও সেই উদ্যোগটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সঙ্গে বৈঠক হয় নতুন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর। ওই বৈঠকেই সরকারি কলেজগুলোকে অধিভুক্ত করে ‘একাডেমিক মনিটরিংয়ের’ দায়িত্ব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে প্রস্তাব করেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, এ জন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজন হলে সরকার তা করবে। এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে আগ্রহী বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এরপর এই উদ্যোগটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নয়টি কলেজকে দুটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর পড়ালেখার অবস্থা ভালো না, এটি সত্য। কিন্তু সরকারি কলেজগুলো অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারকির আওতায় নিলে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটি আগেই ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে ধাপে ধাপে কাজটি করতে হবে।