অদেখা চোখে অক্টোবর দুর্ঘটনা ও কিছু ভাবনা

With the silence of the mind there comes another change, a very important one but more difficult to distinguish for sometimes it extends over a number of years and its signs are at first imperceptible; this is what may be called the emergence of a new mode of knowledge and therefore of a new mode of action...SRI Aurobindo, (Sri Aurobindo or The Adventure of Consciousness, P.42).

মনস্তাত্ত্বিক নীরবতা নতুন নতুন পরিবর্তন আনে সমাজ ও রাষ্ট্রে। মানুষের জীবন কঠিন। কেউ হয়তো বলবে না সহজ। আবার কেউ বলবে একেবারে সহজ। কারও উপলব্ধি ভালোমন্দের মিশেলে জীবন। সকাল-বিকেল-রাত্রি-দিন—এ তো চলমান প্রক্রিয়া। ইতিহাস কখনো নিষ্ঠুর। সময়কে বাদ দিয়ে ইতিহাসকে ভাবা যায় না। সময়কে বাদ দিয়ে ইতিহাস অর্থহীন। তবে ইতিহাস কথা বলে নীরবে, বিপ্লব তৈরি করে সময়ে। তখন সময়গুলো হয়ে ওঠে একেকটি স্তম্ভ, হয়ে ওঠে শক্তির আধার; বদলে দেয় সমাজকাঠামো। অন্তরাত্মায় গেয়ে ওঠে একটি ভালোবাসার গান।

কখনো কখনো সমাজকাঠামোয় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠে একটি শক্তি ও প্রতিবাদের প্রতীক। বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় তখন। নিষ্ঠুর নিয়তি তখন একটু–আধটু অসহায় হয়ে পড়ে। কখনোবা সত্যের কাছে হার মেনে চলে তারা। তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে নিয়তির দর–কষাকষিতে হেরে গিয়েছিল মানবতা। হার মেনেছিল সময়। তবে সবকিছুকে শেষমেশ হার মানিয়ে রচনা হয়েছিল মানবতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। এর রয়েছে বিশাল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাকালীন তিনটি হলের রয়েছে বিশাল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ঐতিহ্যবাহী তিনটি হলের মধ্যে জগন্নাথ হলেরও রয়েছে বিশেষ অবদান। শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংকটে এই হলের ছাত্রদের রয়েছে বিশেষ অবদান। হলের ছাত্ররা আজ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছেন, অবদান রাখছেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তজার্তিক পরিমণ্ডলে। তবে নানা কারণে এ হলের ছাত্রদের সমস্যায় পড়তে হয়, হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ভূমিকা রেখেছে ধর্মীয় রাজনীতিক পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধির চর্চাকেন্দ্র। শিক্ষার্থীরা মুক্তমনে এখানে পড়াশোনা ও জ্ঞানের চর্চা করে থাকে। সেই উর্বর প্রতিষ্ঠানে সবকিছুতে সামষ্টিক ও সমতার ভিত্তিতে দেখাটাই সুন্দর ও সাবলীল। সেখানে যতদূর জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ হলের ক্ষেত্রে নানাভাবে নানা সময়ে শোষণ ও বঞ্চনা করা হতো।

দুটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করতে হয়। একটি বিষয় হচ্ছেÑমানুষের বিচার–বিবেচনাবোধ ও পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা। অন্যটি হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, মমত্ববোধ ও আবেগময় চেতনা, যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে দেখা যায়। প্রথম ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত জগন্নাথ হলের টিভি রুম, যেটি ১৯৮৫ সালে ১৫ অক্টোবর ভেঙে গিয়েছিল এবং যেটিকে ‘দুর্ঘটনা’ বলা হয়ে থাকে। সেটির জন্য হল কর্তপক্ষ বরাবর চিঠি দেওয়ার পরও প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যেটির কারণে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাতে হয়েছিল সেদিন। এটি ভীষণরকম দুঃখজনক। একটি পরিবারের সব চাওয়া–পাওয়া মুহূর্তের মধ্যেই উধাও হয়ে গেল সন্ধ্যাতারায়। সেটি যদি অবহেলাপ্রসূত হয়ে থাকে, সে বেদনার ভার বহন করা কঠিন। কারণ, একজন পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানে সে শুধু একজন নয়, জড়িয়ে আছে পুরো পরিবার। এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ঘটনা আমি চোখে দেখিনি।

পত্রপত্রিকায় দেখেছি, পড়েছি এবং জানার চেষ্টা করেছি। মনুষ্যকৃত দুর্ঘটনার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অসংখ্যবার তৎকালীন জগন্নাথ হলের প্রভোষ্ট মহোদয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে এ ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ উদাসীন ছিলেন। সেই কথাই বারবার চলে আসছে চোখের সামনে। সেদিন ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর এর দুর্ঘটনা প্রশাসনের অবহেলা ও উদাসীনতারই ফল। জগন্নাথ হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ রংগলাল সেন জ্যোতির্ময় ‘জগন্নাথ হল’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সন হতে ১৯৮৩ সন পর্যন্ত এক দশক কাল যখনই যিনি হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন, তিনিই অ্যাসেম্বলি ভবনের ছাদ মেরামত করার জন্য বহু চিঠি লিখেছেন, যার সংখ্যা অর্ধশতাধিক হবে।’

অর্থাৎ অধ্যাপক সেনের প্রায় অর্ধশতাধিক চিঠি বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে ছাদ সংস্কারের জন্য, অথচ সেদিকে কোনো লক্ষ্যই করেনি তৎকালীন প্রশাসন। বঞ্চনা ও অবহেলার উদাহরণ এর থেকে আর কী হতে পারে! মেধাবীদের নির্মম পুনর্বাসন কীভাবে করল তৎকালীন প্রশাসন! জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারাতে হলো অবহেলায়। একজন অনুজ প্রজন্ম হিসেবে ভাবলে কষ্টই জমা থাকে। আবার বিদ্রোহের অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে চোখের সামনে। মনে হয়, নিষ্ঠুর নিয়তিকে মেনে নেওয়া আমাদের কাজ। জন্মই বোধ হয় কর্তৃত্ববাদীদের থাবার দ্বারা নির্যাতিত হওয়া। এসব প্রশ্ন ভেসে আসে একজন অনুজÑপ্রজন্মের চোখের সামনে। ভাবলেই আঁতকে উঠতে হয়—চোখের সামনেই বহমান রক্ত আর রক্ত। অবাক হতে হয় পাশের রুমের বন্ধুটি মুহূর্তের মধ্যেই পৃথিবীর অচেনা মানুষ। আজ সে আর নেই। ভাবতে কষ্ট হয় প্রিয় বন্ধুটি আজ পঙ্গু। এগুলো আমি কল্পনায় ভেসে বলছি। কিন্তু সত্য তো তা–ই, যখন তাপস কান্তি সমাদ্দার ও বঙ্কিমদার মতো প্রত্যক্ষদর্শী ভাগ্যের জোরে সেদিন জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। তাঁরা এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। এখন স্বপ্নের মধ্যে খুঁজে ফেরেন পুরোনো বন্ধু, দাদাদের মৃত আত্মার শব্দ। খুঁজে ফেরেন আহত মনোজ দা, রামকৃষ্ণদাদাদের। এখনো শুনতে পান ভয়ে কাতর হয়ে চোখের সামনে দিয়ে ‘হঠাৎ কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ’। শুনতে পান বেদনার শব্দ। সেখানে খুঁজে ফেরেন চেনা চোখের অচেনা মুখগুলো। ভালোবাসার চোখের মুখগুলো আজ যেন বিবর্ণ, নিঃস্ব ও রিক্ত।

দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি এভাবেই বলতে হয় হলের ছাদ ভেঙে ৫০টি তরতাজা প্রাণ হারানোর পরের উপলব্ধি। সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। দুর্ঘটনার দিন উদ্ধার অভিযানে যুক্ত হলো মানুষ। চারদিকে শুধু রক্তের প্রয়োজন। মাইকিং হচ্ছে। রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসছেন। সবাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। রক্ত দেওয়ার জন্য লম্বা লাইন। সবাই যেন এক হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নেই কোনো ভেদাভেদ। দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই খবর পেয়ে হলের অন্যান্য ভবনের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষক, কর্মচারী ও সাধারণ মানুষ আর্তদের মাঝে এগিয়ে এসেছেন। উদ্ধার ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ, হলি ফ্যামিলি, পঙ্গু ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালগুলোতে। এ কাজগুলো কিন্তু মানুষেরাই করেছে। বলা হয়ে থাকে, ‘রক্তদানে আগ্রহীদের ভিড় স্মরণকালে আর এমন দেখা যায়নি’।

দুটি দুই রকমের ঘটনা বলার চেষ্টায় বোঝা যায়, সময়ে সময়ে মানুষের আচরণ ও ব্যবহার ভিন্ন। অবহেলা ও পরিকল্পনার অভাবে ওই দিন যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটি খুব দুঃখজনক। বংশপরম্পরায় যার দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। জগন্নাথ হলের মেধাবী ছাত্রদের তথা কোনো ছাত্রদের আর যেন কোনোকালে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়। অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ‘অক্টোবর দুর্ঘটনা এবং তারপর’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘অক্টোবর মাস গেঁথে দেয় কোনো এক অদৃশ্য সুতোয়, মমতার অদেখা রাখিতে’। সত্যিই ভীষণ কষ্টের মাস অক্টোবর। এ দিন এলে এখনো অঝোরে কাঁদে জগন্নাথ হল। কাঁদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কাঁদে অক্টোবরে নিহত–আহত ব্যক্তিদের পরিবার–পরিজন। আবার কখনো মনে হয়, এখানে জড়িয়ে আছে একটি অদৃশ্য সুতার বন্ধন, মমতার অদেখা ভালোবাসার বন্ধন।

লেখক: ড. তুহিন রায়, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা