ইংরেজি নিয়ে ভয় ব্যবসা

ইংরেজি নিয়ে ভয় পাবেন না। ভীতি দূর করে চেষ্টা চালিয়ে গেলেই হবে।
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ইংরেজিতে বোর্ডে ফেল করে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। হিসাবে লাখে প্রায় ২৫ হাজার। মানে ১০ লাখ পরীক্ষার্থী থাকলে গড়ে আড়াই লাখ ইংরেজিতে ফেল করেন। কী ভয়ংকর। কী আরাধ্য বিষয় ইংরেজি! কেন ৩৩ নম্বর পাচ্ছেন না?

কেন ভাষাগত একটি বিষয়ে এত ফেল! এটা তো রকেট সায়েন্স না। কেন ইংরেজির ভিতটা শক্তভাবে গড়ে ওঠে না, প্রতিবেশী ভারত ইংরেজি ডালভাত করে ফেলেছে। পাশাপাশি দেশে একদম ভিন্ন চিত্র। আমরা কেন মাত্র ৩৩ পেয়ে পাস করছি। কেন?

অথচ দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ইংরেজি খুব প্রায়োরিটি দিয়ে পড়ানো হয় বা অন্তত অন্য বিষয়ের চেয়ে জোর দেওয়া হয়। বলা যায় বহুবিধ কারণ আছে—কারিকুলাম ভালো না, দক্ষ শিক্ষক নেই, গ্রামাঞ্চলে অবকাঠামো নেই ইত্যাদি! তবে বড় যে মানসিক বৈকল্য দিয়ে ইংরেজিকে আটকানো হচ্ছে তা কেউ বলছেন না, তা হলো ইংরেজি ফোবিয়া, ইংরেজির ভয় তৈরি করা।

কথায় আছে চলেন, একটু ভাবি।

ইংরেজি একটা ভাষা, যেটা আমরা ক্লাস ওয়ান থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়ি। বলা যায় প্রায় ১৭ বছর। তবে তারপরও কেন আমরা Impromptu (প্রত্যুৎপন্ন) কিছু লিখতে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। ৫ মিনিট কথা বলতে ইংরেজিতে বুক কাঁপে। কনফিউশন চলে আসে। ঠিক হচ্ছে তো। টেনসটা ভুল হলো না তো! উচ্চারণ কি এভাবে না ওভাবে। ভুল হচ্ছে মনে হয়। লোকে কী যে বলে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

কারণ অনেক আছে, তবে আমার মতে যা অন্যতম এবং যা নিয়ে কাজ করা উচিত, যেটা হলো কীভাবে এ ভয় জয় করা যায়। মানসিক উন্নয়ন ও ভয় দূরীকরণ।

মানসিক উন্নয়ন ও ভয় দূর করলে ইংরেজিভীতি কাটানো যায়।
ছবি: সংগৃহীত

এবার বলি ইংরেজি নিয়ে ভয়ের মনোপলি ব্যবসা। ইংরেজি খুব কঠিন। অশুদ্ধ শেখাচ্ছে। ইংলিশে পাস তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ! ইংলিশ তো পারবেই না। এরূপ নানা ধরনের ফোবিয়া মিথ চালু করা আছে। বর্তমানে ইংরেজির ভয়ের ব্যবসার বাজার ভালো। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা ইংরেজির যে ভয় ব্যবসা চালু করেছেন, তাতেও ভালোই আয় হয়।

প্রথম দিনেই বলে দেন, ‘তোমরা তো দেখি কিছুই পারো না।’ কী করতে হবে তা না বলে কী করে ফেলছে তা নিয়েই পড়ে থাকেন। ইংরেজি ভয়ের বাজার তৈরির জন্য ‘খাতায় যে জঘন্য লিখেছেন’ তা বলেন। তবে না লেখার জন্য কোচিংয়ে যেতে বলেন। কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন ‘ইংরেজিতে ভয় আর নয়’ অথবা ‘ইংলিশ শেখাব ইংলিশের মতোই’ ভীতিকর ট্যাগ লাইনে বিশ্বাসী।

আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ইংরেজিতেই পড়ান। কেমন করে ইংরেজির ভয়কে জয় করবেন, তা তো বলেন না। তাঁরা ধরে নেন এটা শিখে এসেছেন শিক্ষার্থীরা। আমার কাজ সেটা না। সহমত।

তবে এতে যে উদ্বেগ (Classroom Anxiety) তৈরি হয়, তা থেকে অনেকেই বের হতে পারেন না। অনেক শিক্ষক আবার ক্রিটিসাইজ করেন। আনন্দের সঙ্গেই। এসব ইংরেজির ভয়ের ব্যবসার মূলধন। মজার ব্যাপার হলো ইংরেজির এ ভয় নিয়েই অনেক ব্যবসা করা যায়। এ ব্যবসার প্রোডাক্ট ভালো এবং মার্কেটে চাহিদাও বেশি।

যেমন: ধরি লেখার (Writing) ব্যবসা, গ্রামার শেখানোর ব্যবসা, ফনেট্রিক্স শেখানোর ব্যবসা, আইএলটিএস ব্যবসা, জুনিয়র ইংরেজি কোর্স, সিনিয়র ইংরেজি কোর্স, প্রফেশনাল ইংরেজিÑহেনতেন নানা প্রোডাক্ট।

ধরি, ন্যূনতম তিন মাসের কোর্সে যদি ৫০০০ টাকা করেও নেওয়া হয়, এ ধরনের কোর্সে সব মিলিয়ে ন্যূনতম ৫০০ শিক্ষার্থী থাকেন, তাহলে ১২ মাসের আয় কিন্তু চোখে লাগার মতো। (৫০০ * ৫০০০ * ১২ = ৩ কোটি টাকা। ধরলাম খরচ বাদ দিয়ে টার্ন ওভার ১ কোটি টাকা। এটা একটা কোর্সের কথা বললাম।
এটাকে কি ইন্ডাস্ট্রি বলা যায় না?
ইংলিশ লার্নিং ইন্ডাস্ট্রি।
এবার আসি ভীতি দূরীকরণের উপায় নিয়ে ২৬টি বর্ণের এ ভাষা যার আ-কার, ই-কারের ঝামেলা নেই। একবার চিন্তা করলেই বোঝা যায় তা এত কঠিন হওয়ার কথা না। কলোনিয়াল হায়ার্কির মধ্যে ছিলাম বলে কিছুটা তো আগেই পেয়েছি। আর আমাদের ব্রেন কল্পনা ও বাস্তবের ভীতির তফাত করতে পারে না। নিউরোসায়েন্টিস্টরা অন্তত তা-ই বলেন। এ কারণেই সিনেমায় নায়ক বেদনায় জর্জরিত হয়ে যখন সুইসাইড করতে যান, তখন আমরাও কেঁদে বুক ভাসাই। আহা! নায়কটা মারা যাচ্ছেন। পরের সিনেমায় এই নায়ক যে কবর থেকে উঠে আবার নাচানাচি করবেন! সব যে সিনেমার শুটিং—এ ধ্রুবসত্য ব্রেন ধরতে দেয় না।

ফলে ইংরেজি কঠিন। পারবে না। ভয়ের বিষয় এটাও এভাবে আমাদের হৃদমাঝারে বিরাজমান। ইংরেজি কী এত কঠিন কিছু যে ১৭ বছরে অন্ততপক্ষে মধ্যম লেভেলে আনা যাবে না। ভীতিময়তা আর আমাদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। কেউ তো আর ব্রিটিশ হতে বলছে না। পাস করানো যাবে না। ৫০ পেতে পারবে না। তাও আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করতে পারে না। ইংরেজি যে অসাধ্য বিষয় না, তা ভাবতে পারছে না। আমি অন্তত বলব মাধ্যমিকে শিক্ষক দুর্বলতা, অভিভাবকের কোচিংপ্রিয়তা বাদে অন্যতম কারণ ইংরেজির ভয়ের ব্যবসা।

আজ কেউ ইংরেজি শিখতে চাইলে শত শত ইউটিউব টিউটোরিয়াল আছে। ইংলিশ লার্নিংয়ের যা চাইবেন তা একবার করে দেখলেও হবে। পড়ুন, যা ইচ্ছা। ফিকশন, নন-ফিকশন, পত্রিকা, যেটা পড়তে ভালো লাগে। তাই ইংরেজিতে পড়ুন। সেটা খেলার পাতা বা ক্যাটরিনা কাইফের বিয়ের খবরই হোক। ১০ থেকে ২০ মিনিট, ব্যস।

আমরা যা শুনি তা–ই বলি। ছোট্ট বাচ্চারা শুনেই কথা শেখে। শোনা থেকে টানা এক মাস বোঝেন না বোঝেন শুনুন। এমনিতেই ভালো লাগবে। দেশের ছোট্ট বাচ্চারও ডোরেমন কার্টুন দেখে হিন্দিতে ফ্লুয়েন্ট হয়ে গেল। বোঝেন Power of listening! সিনেমা দেখেন, বিবিসি দেখেন। আল–জাজিরা দেখেন। শাকিরার গান দেখেন। ভয়টা দূর করেন।

আর কিছু না। নিয়মিত ইংরেজি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ভুল হোক, আর ঠিক হোক। লজ্জাশরম সব তোলা রাখতে হবে। আপনি যদি কাউকে লন্ডনে টেমস নদীর পারে ৫ বছর রেখে দেন দেখবেন কী সুন্দর ইংরেজি বলছে ৫ বছর পর। চারপাশের পরিবেশটা খুব কাজে দেয়।

সবচেয়ে বড় কথা সাহস করুন, প্রতিটা কাজে সাহসই সব। যত সফল ব্যক্তি সবাই মেধাবী তো অবশ্যই ছিলেন তবে সাহসী ছিলেন অনেক বেশি। যা ইচ্ছা ছিল বিশ্বাস করতেন, তা সাহসের সঙ্গেই করতেন।

ইংরেজি ফোবিয়া বা ভীতিকে একবার বাই বাই বলুন। ব্যস।

  • প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা