উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: কী এবং কাদের জন্য

বছর দশেক আগেও এই শিরোনামের লেখা প্রায়ই চোখে পড়ত আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলোতে। আমি ছোটবেলায় ওই লেখাগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম আর ভাবতাম, বড় হয়ে আমিও বিদেশে পড়তে যাব আর কাগজে এ রকম একটা লেখা বের হবে আমাকে নিয়ে। আমার বিদেশে পড়তে আসা হয়েছে ঠিকই, এক-দুবার নয়, তিন–তিনবার; কিন্তু ওই লেখা শেষ পর্যন্ত কোনো কাগজে বের হয়নি। এই কষ্ট আমার সারা জীবন থাকবে। যদিও একই ধরনের লেখা এখনো মাঝেমধ্যে দেখা যায়, তবে সেগুলো খবরের কাগজে নয়, ফেসবুকের দেয়ালে।

একসময় অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল, বিদেশে পড়তে যেতে হলে অনেক ভালো একাডেমিক ফল অথবা অনেক টাকা থাকতে হয়। দুটোই আংশিক সত্য। তার উদাহরণ আমি নিজেই। দেশে আমার স্নাতক (সম্মান) আর স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল খুব ভালো ছিল না, যাকে বলা যেতে পারে অল্পের জন্য তৃতীয় শ্রেণি পাওয়ার হাত থেকে বেঁচে এসেছি। আর বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি জোগানোর মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা আমার পরিবারের ছিল না। কিন্তু আমার আগ্রহ ছিল তীব্র, তাই ভাবলাম, একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী?

বিদেশ মানেই পৃথিবীর অপর প্রান্ত নয়

এ কথা এখনো অনেকে মানতে চান না। যখন বলি আমি ভারতে পড়াশোনা করেছি, অনেকেই জানতে চান, এত দেশ থাকতে আমি ভারতে কেন গেলাম? আমি তাঁদের কীভাবে বোঝাই, ভারতও তো বিদেশ? সেখানেও ভালো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছে বৃত্তির ব্যবস্থা। তাহলে কেন নয়? আসলে অনেকেই বিদেশ বলতে শুধু ইউরোপ-আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়াকে বোঝেন। আবার অনেকে ভালো বিশ্ববিদ্যালয় বলতে শুধু হার্ভার্ড-অক্সফোর্ডের নামই জানেন। কিন্তু এর বাইরেও যে অনেক দেশে অনেক ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেখানেও বিশ্বমানের পড়াশোনা-গবেষণা হচ্ছে, সে বিষয়ে অনেকেরই ভালো ধারণা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে তাকালেই দেখবেন, বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের প্রতিবেশী দেশসহ এশিয়ার বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেই তালিকায়। উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলা যাবে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা ও গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আগ্রহী যে কেউ একটু খোঁজ করলেই প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেয়ে যাবেন অনলাইনে।
আপনার আগ্রহ আছে কি না, সেটা কীভাবে বুঝবেন? এই লেখাপড়ার পর যদি আপনি আমাকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা ভালো কোনো বৃত্তির ব্যাপারে তথ্য খুঁজে দিতে বলেন, তাহলে বুঝবেন, বিদেশে পড়ার ব্যাপারে আপনার পর্যাপ্ত আগ্রহ নেই। আপনি দয়া করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিন।

বিদেশি ডিগ্রি, অভিবাসন ও ভালো বেতনের চাবিকাঠি কী

অনেকে মনে করেন, বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই সেই দেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়া যায় অথবা ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফেরার সঙ্গে ছয় অঙ্কের বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। এ ধারণা থাকলে আপনি হতাশ হতে পারেন। বরং পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হলে দরকার আরও বেশি কিছু। এই যেমন আপনার নিজের সামর্থ্য আর দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা, অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজের ধরনের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া আর প্রতিদিনই নতুন নতুন বিষয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করার ইচ্ছা ও সামর্থ্য। এগুলো না থাকলে আপনার দেশি-বিদেশি কোনো ডিগ্রিই খুব একটা কাজে আসবে না। আমি অনেককে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে ভালো চাকরি বা ব্যবসা করতে যেমন দেখেছি, তেমনি অনেককে দেখেছি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে থাকতে।
তাই প্রথমেই নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, আপনি ঠিক কী কারণে বিদেশে পড়তে যেতে চান। যদি পড়ালেখা শেষ করে বিদেশে অভিবাসন ও চাকরির সুযোগ থাকে, তবে দেশ ও শহরভেদে সেই সুযোগের তারতম্য হতে পারে। আপনার যদি সে রকম ইচ্ছা থাকে, আগে থেকেই ভালোমতো খোঁজখবর নিয়ে রওনা হবেন। তা না হলে মাঝপথে আপনার আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন–উপযোগী পেশার তালিকার ওপরের দিকে ছিল ‘হিসাবরক্ষক’। তাই অনেকেই অস্ট্রেলিয়ায় হিসাববিজ্ঞান পড়তে গিয়েছিলেন। কিন্তু গত দু-তিন বছরে এই পেশার চাহিদা কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই এখন যাঁরা এই বিষয়ে পড়ছেন বা আগামীতে পড়তে যেতে চান, তাঁরা দয়া করে বিকল্প চিন্তা করুন।

উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: কী এবং কাদের জন্য

কখনো ভেবে দেখেছেন কি উচ্চশিক্ষা আর গবেষণা শব্দ দুটি প্রায়ই একসঙ্গে থাকে কেন? কারণ, এই দুটো বিষয় একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উচ্চশিক্ষা বলতে সাধারণত শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ওপরের স্তরকে বোঝায়। সেই হিসাবে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল আর পিএইচডি ডিগ্রিকে উচ্চশিক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষার এই স্তরগুলোতে শুধু পড়া মুখস্ত করে, তা পরীক্ষার খাতায় পুনরুৎপাদন করাই যথেষ্ট নয়। এখানে যাচাই করা হয় পঠিত বিষয়ের ওপর জটিল সমস্যা সমাধান, নিজস্ব মতামত ও মূল্যায়ন এবং নতুন ধারণা প্রদানের সূক্ষ্মতা। আর গবেষণার মাধ্যমেই কেবল এগুলোতে ভালো করা সম্ভব। তাই স্নাতক আর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ছোট ছোট রচনা/অ্যাসাইনমেন্ট/প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে এই গবেষণায় হাতেখড়ি হয়। আর এমফিল-পিএইচডি পর্যায়ে বড় গবেষণাপত্র লেখার মধ্য দিয়ে হাত পাকে। এ জন্য যাঁরা দেশে বা বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে ইচ্ছুক, তাঁদের গবেষণা করার মানসিকতা থাকতেই হবে। কিন্তু আপনি যদি শুধু বই পড়ে পরীক্ষা পাস করতে চান, দয়া করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিন।

অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি: কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন

গবেষণার কথা যখন এল, তখন পিএইচডিতে ভর্তি ও স্কলারশিপের বিষয়ে কয়েকটি কথা বলে রাখি। অনেকেই জানতে চান, বিদেশে পিএইচডি করতে হলে কীভাবে এগোতে হবে। পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির শর্ত ও নিয়মকানুন দেশ ও বিষয়ভেদে আলাদা হয়। আগে আপনাকে জেনে নিতে হবে আপনি কোন বিষয়ে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তথা কোন দেশে পিএইচডি গবেষণা করতে চান আর সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আমি এখানে খুব সংক্ষেপে অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে বলব।

অস্ট্রেলিয়ায় ভালো মানের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আছে। প্রায় সব কটিতেই বছরব্যাপী পিএইচডিতে ভর্তির প্রক্রিয়া চলে। সাধারণত কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিসার্চ কম্পোনেন্টসহ মাস্টার্স ডিগ্রি, ভালো জার্নালে এক বা একাধিক প্রকাশনা আর ইংরেজি ভাষায় ভালো দখল থাকলে পিএইচডিতে ভর্তির আবেদন করা যায়। অনেকগুলো ধাপে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে আপনি আপনার একটা একডেমিক সিভি আর গবেষণা প্রস্তাব (রিসার্চ প্রপোজাল) তৈরি করবেন। তারপর আপনার প্রস্তাবিত বিষয়ে পড়ানো ও গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এ রকম এক বা একাধিক (শতাধিকও হতে পারে) সম্ভাব্য সুপারভাইজারের কাছে আপনার প্রস্তাবনা আর সিভি ই–মেইল করবেন। দয়া করে একই ই–মেইল সবাইকে পাঠাবেন না। অনেকেই হয়তো আপনার ই–মেইলের জবাব দেবেন না আর অনেকে তাঁদের অপারগতা জানাবেন। এতে ভেঙে পড়বেন না। আপনি কত প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারেন, সেটাই একটা পরীক্ষা। তবে অনেকেই আপনার গবেষণা সুপারভাইজ করতে আগ্রহী হতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করুন।

দ্বিতীয় ধাপে যখন একজন সম্ভাব্য সুপারভাইজারের সঙ্গে আপনার আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবে, তখন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তির আবেদন করবেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের সঙ্গেই স্কলারশিপের আবেদনও করতে হয়। আবার কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আলাদা করে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে হতে পারে। আপনার ভর্তির আবেদন গৃহীত হলে আপনাকে ‘অফার অব অ্যাডমিশন’ লেটার পাঠাবে। একই সঙ্গে বা পরবর্তী সময়ে আপনার স্কলারশিপের আবেদনের ফলাফল জানানো হবে। আবেদন গৃহীত হলে ‘অফার অব স্কলারশিপ’ লেটার পাঠানো হবে। ব্যস, আপনি দুটো অফারই অ্যাকসেপ্ট করে ব্যাগ গোছাতে শুরু করবেন।

তৃতীয় ধাপে আপনাকে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে এবং ভিসা পাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত দপ্তরে সশরীর উপস্থিত হয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।

কোথায় সাহায্য পাবেন

আমার জানামতে, বিশ্বের প্রথম সারির অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি শিক্ষক ও গবেষক রয়েছেন। সেখানে তাঁরা নিজ নিজ বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আপনার পছন্দের তালিকায় থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি কোনো বাংলাদেশি শিক্ষক ও গবেষক থেকে থাকেন, তাহলে আপনি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আমার বিশ্বাস, তাঁরা আপনাকে হতাশ করবেন না। আমি যখন ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকোয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির আবেদন করেছিলাম, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাংলাদেশি অধ্যাপক আমাকে সব রকম সহযোগিতা করেছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দেশের মানুষের জন্য অন্যরাও সাধ্যমতো তাঁদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।

বিদেশের সব কি ভালো?

এখনকার প্রেক্ষাপটে এ ধারণা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্তই কম হবে না। কিন্তু আসলেই কি তাই? এমনিতেই ‘ভালো’ ব্যাপারটা আপেক্ষিক, তার ওপর সেটা একান্তই ব্যক্তিনিষ্ঠ। অন্যদের কাছে যা ভালো, আপনার কাছে সেটা ভালো না–ও লাগতে পারে।

তাই অন্যদের থেকে শুনে বা তাঁদের ফেসবুকের লেখা পড়ে বিদেশের সবকিছুকে ভালো বা খারাপ হিসেবে ধরে নেবেন না। নিজের জ্ঞান ও বিবেচনাশক্তি কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। বিদেশে অনেকেরই পরিবার, নিকটাত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব থাকে না, তাই পরিবার–পরিজন ছেড়ে থাকতে যদি আপনার অনেক অসুবিধা হয়, তাহলে বিদেশে যাওয়ার আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন। বিদেশে পড়তে এসে অনেকেই একাকিত্বে ভোগেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শরীর ও মনের ওপর এবং সে কারণে পড়ালেখা বা গবেষণায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বিদেশে নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। টিউশন ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ জোগাতে অনেককেই পড়ালেখার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিও করতে হয়। সব মিলে বিদেশে পড়ার সময়টা নানা রকম লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আপনি যদি এত সব চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত না থাকেন, তাহলে বাসায় বসে বিসিএস, ব্যাংক বা দেশের সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেন।

*লেখক: আবদুল্লাহ আল আরিফ, শিক্ষক ও গবেষক, পোস্টডক্টরাল ফেলো, ইয়োকোহামা সিটি ইউনিভার্সিটি, ইয়োকোহামা, জাপান