উচ্চশিক্ষার জন্য এত শিক্ষার্থী কেন চীনে যাচ্ছেন

নানা দেশের শিক্ষার্থীরা পড়তে যাচ্ছেন চীনে
ছবি: রাহাত কবির

চীনে আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ২ হাজার ৮৫০টি, যার মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাই প্রায় আড়াই হাজার। এ ছাড়া বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৩০০। চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৭ সালে বাইরে থেকে চীনে পড়তে গেছেন প্রায় ৪ লাখ ৪২ হাজার শিক্ষার্থী। ২০০০ সালে সংখ্যাটা ৫২ হাজার ১৫০ জন। ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর অন্তত ৬ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী নেওয়ার পরিকল্পনা করছে চীন। মানসম্মত শিক্ষা, বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্য, ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ, বৃত্তিসুবিধা এবং তুলনামূলক কম খরচের কারণে বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের জন্য চীনমুখী হচ্ছেন।

চীনে পড়াশোনার পর

রুবেল মেহেদী চীন থেকে পড়াশোনা করে বাংলাদেশে এসেছেন বছর কয়েক আগে। চীনের একটি মুঠোফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার যোগাযোগের দিকটা তিনি দেখেন। বলছিলেন, ‘আমার সময় মাত্র ছয়জন গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। মানবিক বিভাগ থেকে আমি একাই ছিলাম। শুরুতে চীনের তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চীনা ভাষা শিখি। পরের বছর থেকে শুরু হয় অর্থনীতির পাঠ। ডিগ্রি নিই লিয়াওনিং প্রদেশের দালিয়ান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি থেকে। চীনে পড়াশোনার সুবাদেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে আমার বেশ ভালো ধারণা হয়েছিল।’

চীনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মিলনমেলা
ছবি: সংগৃহীত

২০১১ সালে দেশে ফিরে প্রায় দুই বছর মেঘনা ঘাট এবং বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্প সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর বৃত্তি নিয়ে আবার স্নাতকোত্তর করতে যান ২০১৩ সালে, বেইজিংয়ের ইউনিভার্সিটি অব কেমিক্যাল টেকনোলজিতে। সেখানে এমবিএ শেষ করে ২০১৬ সালে দেশে ফেরেন তিনি। পরের বছরই একটি বহুজাতিক স্মার্টফোন কোম্পানিতে যোগ দেন।

ঢাকার নটর ডেম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র অমিত কুমার দাশ পড়েছেন বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে। পড়াশোনা শেষে দেখলেন, তাঁর বন্ধুরা চাকরি নিয়ে নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ছেন। অমিতও বেশ কয়েক জায়গায় আবেদন করেছিলেন। এখন থিতু হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে কাজ করছেন তিনি। অমিত জানান, চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পড়াশোনার মান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে তারা এগিয়ে আছে বলেই প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের পড়ালেখার ওপর ভরসা রাখে।

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র কিশোর কুমার বিশ্বাস এখন বেইজিং ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে পাস করা আরেক তরুণ তারেকুল ইসলাম সে দেশের জি ই কোম্পানির অ্যাপ্লিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। লিমন ও সন্দীপ রায় নামে আরও দুজনের কথা জানান তাঁরা, যাঁরা চীনে পড়ালেখা শেষে সে দেশের স্মার্টফোন প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়েতে চাকরি করছেন। এই তরুণদের মতো আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা বৃত্তি নিয়ে চীনে পড়তে গিয়েছিলেন। এখন দেশে-বিদেশে কর্মক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছেন।

কেন চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে?

অমিত কুমার দাশ বললেন, ‘চীনের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনিময় কর্মসূচি (এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম) চালু আছে। কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টিই চীনা।’ চীনের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ২০ ছাড়িয়ে যাবে।

চীনের পড়ালেখার পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে
ছবি: রাহাত কবির

তবে চীনে কীভাবে যাবেন, কোথায় পড়বেন, কীভাবে ভর্তি হবেন, পড়াশোনার খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ—এসব তথ্য খুব সহজলভ্য নয়। বিস্তারিত জানতে হলে আপনাকে অনলাইনে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। চীনে প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির জন্য বৃত্তি দেওয়া হয়। বৃত্তির বিভিন্ন প্রকার আছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি, হোস্টেল ফি মওকুফের পাশাপাশি মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও আছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এসব সুবিধা দেয়, তাদের কিছু শর্ত থাকে। যেমন ক্লাসে ৯০ শতাংশ উপস্থিতি, সব বিষয়ে কৃতকার্যতা, সব বিষয়ে ৭০-৮০ শতাংশ নম্বর ইত্যাদি। তাই যাঁরা মনে করেন এ রকম শর্ত মেনে চলা কঠিন হবে, তাঁদের জন্য নিঃশর্ত বৃত্তিই (আনকন্ডিশনাল স্কলারশিপ) ভালো।

বৃত্তি পেতে হলে পছন্দসই চীনা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চায়নিজ স্কলারশিপ কাউন্সিলের (সিএসসি) ওয়েবসাইটে চোখ রাখতে পারেন। সিএসসি মূলত চীনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি অলাভজনক সংস্থা, যারা চীনে পড়ালেখার ক্ষেত্রে বিদেশি শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে। বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও নিয়মিত চীনা বৃত্তিসংক্রান্ত সার্কুলার দেওয়া হয়। সে জন্য চোখ রাখতে পারেন এই ওয়েবসাইটে। অভিজ্ঞরা বলছেন, দূতাবাসের মাধ্যমে আবেদন না করে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলে বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

কম খরচ ও ভাতার সুবিধা

চীনের সাংহাইয়ের টংজি ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর করছেন বাংলাদেশের শহিদুল ইসলাম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে চীনের পানির মান নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি ও ভাতা সম্পর্কে একটা ধারণা দিলেন শহিদুল। তিনি বলেন, ‘এখানে পড়ালেখার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো চীনের সরকারি বৃত্তি। অফিশিয়ালি প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থীকে ওরা এই বৃত্তি দেয়। টিউশন ফি, হোস্টেল ফি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিমানভাড়াও বৃত্তির আওতাভুক্ত। এ ছাড়া ভাতা দেওয়া হয়। স্নাতক পর্যায়ে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা এবং পিএইচডি পর্যায়ে আপনি প্রায় ৫৫ হাজার টাকা ভাতা পাবেন।’ শহিদুল জানান, চীনের সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই ‘রেসিডেন্ট ক্যাম্পাস’ আছে। অর্থাৎ ক্যাম্পাসে থেকেই আপনাকে পড়ালেখা করতে হবে। ক্যানটিন বা নিজস্ব ব্যবস্থা, যেভাবেই আপনি খাওয়াদাওয়া করেন না কেন, মাসে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। সরকারি বৃত্তি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে বৃত্তি দেয়, সেখানে ভাতা না থাকলেও টিউশন ফি প্রায় সব ক্ষেত্রেই মওকুফ করা হয়।

চীনা ভাষা কি জানতেই হবে?

চীনে পড়তে গেলে চীনা ভাষা জানতেই হবে—এমন নয়। শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এমন অনেককেই আমি চিনি, চীনা ভাষায় যাঁদের পুরোপুরি দখল নেই, তারপরও পড়ালেখা শেষ করে তাঁরা শিক্ষক হয়ে গেছেন। তবে ভাষা না জানলে আপনাকে চীনে অবস্থানরত অন্যান্য দেশের কোম্পানিতে চাকরি করতে হবে। অবশ্য চীনের পরিবেশটাই এমন, কেউ দুই বছর থাকলে এমনিতেই ভাষাটা শেখা হয়ে যায়। তা ছাড়া সব বিশ্ববিদ্যালয়েই বিনা মূল্যে চীনা ভাষার কোর্স আছে। তাই ভাষা খুব একটা বাধা নয়।’ সাধারণত চীনে পড়ার জন্য আইইএলটিএস দরকার হয় না। তবে ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে হলে আইইএলটিএসের মতো ভাষাদক্ষতার প্রমাণ প্রয়োজন হতে পারে।

কোথায় পাব চীনা বৃত্তির খোঁজ

চীন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের এখন প্রচুর বৃত্তি দিচ্ছে। এসব বৃত্তির মধ্যে আছে—সিএসসি স্কলারশিপ, কাস টাওয়াস স্কলারশিপ, মফকম স্কলারশিপ, চায়না-বাংলাদেশ এক্সচেঞ্জ স্কলারশিপ, দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ স্কলারশিপ ইত্যাদি।

শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে গবেষণা করতে পারেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার খুব উন্নত, প্রচুর তহবিলও (ফান্ড) থাকে। প্রায় প্রত্যেক অধ্যাপকই নিজস্ব প্রকল্পের জন্য আলাদা তহবিল পান। অনেকে সেই তহবিল থেকে তাঁর সঙ্গে কর্মরত শিক্ষার্থীদের মাসিক বা বার্ষিক সম্মানী দেন। তাই গবেষণার অভিজ্ঞতা বা এ–সংক্রান্ত আগ্রহ থাকলেও আপনি উচ্চশিক্ষার জন্য চীনকে বিবেচনায় রাখতে পারেন।