উপাচার্যদের দুর্নীতি এবং আমাদের আকাঙ্ক্ষা

প্রথম আলো ফাইল ছবি

ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এবং প্রশাসনিক প্রধান। উপাচার্য শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত প্রখর মেধাসম্পন্ন ব্যক্তি, দক্ষ গবেষক, নিপুণ প্রশাসক এবং সর্বোপরি একজন আস্থাভাজন অভিভাবকের চেহারা ভেসে ওঠে, যিনি পরম মমতায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আগলে রাখবেন এবং একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যাবেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির শিখরে।  
২.
কিন্তু সম্প্রতি আমরা জানতে পারি, দেশের আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত শুরু হয়েছে। কাজটি করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক সংস্থা হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে শেষের দুটির সাবেক এবং প্রথম ছয়টির বর্তমান উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এর বাইরে আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে তদন্ত শেষ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। আইনে সংশোধন ও শর্ত শিথিল করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করে আগের জায়গায় আইন ফিরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। পত্রিকার মাধ্যমে উপাচার্য কর্তৃক ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে অবৈধভাবে শিক্ষক বহিষ্কার ও অপসারণের মতো তুঘলকি কাণ্ডও আমরা জানতে পারছি। উপাচার্যরা কেন এবং কীভাবে এ-জাতীয় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন, সেটি নিয়ে গবেষণা হতে পারে। পত্রিকায় উপাচার্যদের অনিয়মের যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উপাচার্য সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে। এমনকি সৎ হিসেবে পরিচিত অনেক উপাচার্যও পত্রিকার এসব সংবাদে বিব্রত হচ্ছেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

৩.
অভিযোগের যে চিত্রগুলো দেখা যায়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের শিক্ষা, জ্ঞান, গবেষণা এবং সর্বোপরি পদের সঙ্গে বড়ই বেমানান। কারণ, উপাচার্য এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যনির্বাহী প্রধান, যেটিকে শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়, জ্ঞানের চর্চা হয়, গবেষণার ফলকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান দানের পাশাপাশি সংস্কৃতিমনা এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে তৈরি করা হয়। এক কথায়, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান ও মানবসম্পদ তৈরির তীর্থস্থান। আর এখানে নেতৃত্বে দিতে হয় একজন উপাচার্যকেই। শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি উপাচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক বিষয়টিও দেখতে হয়। এটিও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে হয়, কারণ এই কাজগুলো শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
উপাচার্যকে শিক্ষার মান উন্নয়নের পাশাপাশি আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতে হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে হয় এবং সর্বোপরি সরকারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে হয়। শিক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, গবেষণায় দক্ষ, প্রকল্প পরিচালনায় চৌকস এবং প্রশাসন পরিচালনায় অভিজ্ঞ—এসব গুণাবলিসম্পন্ন একজন যোগ্য ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব এই দায়িত্বগুলো সুচারুভাবে পালন করা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

৪.
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের বিভিন্ন রকম নিয়ম রয়েছে। সরকারের তরফে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। উপাচার্য হওয়ার জন্য অনেকে শিক্ষকই নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেন। একজন অধ্যাপক শিক্ষাদান, গবেষণাকর্ম, প্রকল্প পরিচালনা ইত্যাদি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। তিনি কেন উপাচার্য হওয়ার জন্য তদবির করবেন? মনে রাখতে হবে, উপাচার্যের পদ কোনো চাকরি নয়, এটি একটি দায়িত্ব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সার্চ কমিটি বা অন্য কোনো প্রচলিত উপায়ে যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাঁকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। যিনি উপাচার্য হওয়ার জন্য তদবির, দৌড়াদৌড়ি বা লম্ফঝম্ফ করেন, তিনি উপাচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে কী দিতে পারবেন? তিনি কি পারবেন উপাচার্যের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে?

৫.
গত কিছুদিন পত্রিকায় যেভাবে উপাচার্যদের নানা রকম অনিয়ম এবং দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো নিয়মিত বিরতিতে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা প্রদর্শনের সময় এসেছে। শিক্ষায়, গবেষণায়, প্রশাসন চালানোয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দেখতে চায় সবাই।

ক. উপাচার্যকে হতে হবে স্বপ্নদ্রষ্টা
শিক্ষার পরিবেশ ও মান উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে উপাচার্যকে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং একই সঙ্গে এই স্বপ্নপূরণে সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হবে।

খ. উপাচার্য হবেন আদর্শ শিক্ষাবিদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যতম কাজই হলো শিক্ষা কার্যক্রম। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই পাঠদানের সঙ্গে যুক্ত। কাজেই উপাচার্যকে হতে হবে রোল মডেল শিক্ষাবিদ, যাঁকে সবাই আদর্শ মেনে শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখবেন।

গ. উপাচার্যকে দক্ষ গবেষক হতে হবে
শ্রেণিকক্ষে ও ল্যাবরেটরিতে শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো গবেষণা, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করে তোলে। কেবল একজন ভালো ও দক্ষ গবেষকই পারেন গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতৃত্ব দিতে, দেশে-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম কুড়িয়ে আনতে এবং আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নীত করতে।

ঘ. চৌকস এবং সংবেদনশীল প্রশাসকের ভূমিকা পালন করতে হবে উপাচার্যকে
উপাচার্যকে একজন দক্ষ এবং কৌশলী প্রশাসক হতে হবে। অভিভাবক হিসেবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী—সবাইকে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো ভাবতে হবে। প্রয়োজনের সময় যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি কোমলতায় সবাইকে আপন করে নিতে হবে। ব্যক্তিগত আক্রোশে প্রতিশোধ, শাস্তি বা বহিষ্কারের মতো গর্হিত কাজ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সবাইকে আগলে রাখার পাশাপাশি সবাইকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতে হবে। উপাচার্যকে ভয় নয় সবাই শ্রদ্ধা করবে।

ঙ. জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত
বর্তমান যুগে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তুমুল প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি কোষাগার থেকে টাকা এলেও গবেষণার জন্য বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে চুক্তি করে যৌথভাবে গবেষণা সম্পন্ন করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবে উপাচার্যকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি উপাচার্য হলে এই জাতীয় ফান্ড সংগ্রহ এবং চুক্তির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাবে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

চ. উপাচার্য হবেন সৎ এবং কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ
উপাচার্যকে নিজের কাজের প্রতি সৎ ও নিবেদিত থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজ দুটোকেই ভালোবাসতে হবে এবং পরিকল্পনামতো কাজ করে যেতে হবে। কাজে স্বচ্ছতা থাকতে হবে এবং অবশ্যই অবশ্যই উপাচার্যকে আর্থিক ও নৈতিকভাবে সৎ হতে হবে।

ছ. নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উপাচার্য
অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাকালে অস্থায়ী ও দায়সারা গোছের সমাধান দিতে চেষ্টা করেন। এ-জাতীয় ক্ষেত্রে উপাচার্যরা মেয়াদ শেষে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার কারণে উপাচার্যের দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহির সুযোগ থাকে না। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়েই কেউ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলে অনিয়ম ও দুর্নীতি অনেকাংশে হ্রাস পাবে, কারণ উপাচার্যের মেয়াদ শেষে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যেতে হবে বিধায় তিনি জবাবদিহির মধ্যে থাকবেন।

*লেখক: ড. আবু শামীম মোহাম্মদ আরিফ, অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়